শিক্ষা পরিকল্পনা
সায়েক আহমদ॥ প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা কিছু আশাবাদ শুনিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বলছেন কোভিড-১৯ কে সঙ্গী করেই আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। সর্দি-কাশির মতো কোভিড-১৯ এর সঙ্গেই মানুষকে বসবাস করতে হবে। তারপরও বিজ্ঞানীরা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন যে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিস্কার করে তারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবেন। কিন্তু এর জন্য কতকাল অপেক্ষা করতে হবে কেউই তা বলতে পারবেন না।
যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, দুর্ভিক্ষের কারণে যুগে যুগে শিক্ষাব্যবস্থাকে সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধই তো চলেছিল নয়টি মাস ধরে। কাজেই আমাদেরকে ধরে নিতেই হবে যে, মাঝে মাঝে বহুবিধ কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় ধাক্কা লাগবেই। মহামারী হলে তো কথাই নেই। কাজেই এসব সংকটকালীন সময়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা পড়েছে এক অদ্ভুত সংকটে। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সিলেবাস, ক্লাস, পরীক্ষা, হোমওয়ার্ক ভিত্তিক সনাতন পদ্ধতিতে। এখনো আমরা পড়াশোনার ভার্চয়াল জগতে ব্যাপকভাবে পা রাখতে সক্ষম হইনি। তবে সীমিত আকারে হলেও অনলাইনে পড়াশোনা চলছে। তারপরও অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের কোন পদ্ধতি এখনো আমাদের দেশে চালু হয়নি।
আমাদের দেশে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে পড়াশোনা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই। তবে সেটা শুধুমাত্র টেলিভিশনে প্রচারিত লেকচারভিত্তিক ক্লাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। দূরশিক্ষণে এসএসসি থেকে বিএড পরীক্ষার প্রোগ্রামও আগে থেকেই কার্যকর আছে। তবে বর্তমান সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য দেশ যেসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে, দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা তা করতে পারছি না। করোনাকালে শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখতে অনেক দেশই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। আমাদের দেশেও কিন্তু দূরশিক্ষণের বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রচলিত আছে। সরকারিভাবে প্রযুক্তিগুলো প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পৌঁছিয়েও দেয়া হয়েছে। সরকারিভাবে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বছরের পর বছর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাবে সেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হচ্ছি। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা কিংবা কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সংকটকালীন সময়ে এসব প্রযুক্তি স্ব স্ব উদ্যোগে ব্যবহার করে শিক্ষাসেবা অব্যাহত রেখেছেন। কথায় আছে, ‘ঠেকায় পড়লে সবকিছু শেখা যায়।’ অনেককে ঠেকায় পড়ে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্ব স্ব দক্ষতা অনেক উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটুকুও এখন দৃশ্যমান।
বর্তমান পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর প্রয়োজনীয়তাটুকু আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস নামক আণুবীক্ষণিক জীবাণু। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং জেএসসি পরীক্ষা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তাও আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে।
শিক্ষক বাতায়ন এবং কিশোর বাতায়ন নামক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দুটো গ্রুপের মাধ্যমে সরকার শিক্ষা সহায়তা প্রদান করছে। কিন্তু এ গ্রুপগুলোতে ভাল মানের কিছু ডিজিটাল কন্টেন্ট আপলোড করা হলেও বেশিরভাগ কন্টেন্টই শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী উভয়কে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ শিক্ষক বাতায়নে অনেক কন্টেন্ট ভয়াবহ রকম যান্ত্রিক ও প্রাণহীন। সংসদ টেলিভিশনের ক্লাসগুলোর মধ্যেও অনেক ক্লাস দায়সারা গোছের হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হওয়ার পরিবর্তে বিরক্তই হচ্ছে। তারা নিজ থেকেই স্কুল কলেজে আবার ফিরে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।
বর্তমান সংকটকালীন সময়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার মত হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মোটেও উচিত হবে না। বরং অনলাইনে ক্লাস চালু রাখার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকেও এসব কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। পরিকল্পনা সাফল্যজনকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সবার আগে অনলাইনে এবং সরাসরি ক্লাসগুলো সাফল্যের সাথে পরিচালনা করতে সহযোগিতা করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইচ্ছে করলেই দেশের সব শিক্ষার্থীর ডেটাবেইস তৈরি করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসতে পারবে। এছাড়া সরকার চাইলেই মোবাইল অপারেটরগুলোকে শিক্ষাসেবার কাজে নিয়োজিত করতে পারে।
বর্তমান সময়ে শিক্ষাবিদদেরকে দ্রুত এবং সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষাব্যবস্থা একটি বড়োসড়ো ধাক্কা খাবে এটা নিশ্চিত। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে এইচএসসি পরীক্ষার মত একটি বিরাট পাবলিক পরীক্ষাসহ প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের বার্ষিক পরীক্ষাগুলোও এগিয়ে আসছে। কাজেই কীভাবে সিলেবাস সম্পূর্ণ করতে হবে, কীভাবে পরীক্ষাসমূহ গ্রহণ করতে হবে এবং সর্বোপরি অনলাইন ক্লাসগুলো কোন পদ্ধতিতে পরিচালনা করতে হবে তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দ্রুত গ্রহণ করা প্রয়োজন। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপারে দিকনির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকবৃন্দের মুখে হাসি ফুটাবেন।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন