শিশুদের উপর মোবাইল ফোনের খারাপ প্রভাব ও প্রতিকার

August 14, 2020,

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন॥ চোখ মানুষের অমূল্য সম্পদ। চোখ মানব দেহের একটি স্পর্শকাতর সংবেদনশীল অঙ্গ। যা মানব দেহের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের অন্যতম। চোখের সাহায্য আমরা সষ্টার সৃষ্টি এই সুন্দর পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে পাই, তার রূপ উপভোগ করি। মহান আল্লাহর দেয়া চোখ আমরা অযত্নে অবহেলায় নষ্ট করছি। আমরা আমাদের শিশুদেরকে মোবাইল ফোন ব্যবহারে উৎসাহিত করে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছি। গেইমস কার্টোন বা নানা ধরনের ভিডিও দেখার জন্য শিশুদের মোবাইলের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। শিশুদের আবদার মেটাতে অভিবাবকরা শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তোলে দিচ্ছি। আমরা আমাদের আদাদের শিশু একটু কাঁদলে, খাওয়াতে অনিহা দেখালে অথবা ঘরে মেহমান বা বন্ধু বান্ধব এসেছেন। তাদের সাথে কথা বলার সময় শিশুটি দুষ্টামি করছে। এটা থেকে বাঁচার জন্য আমরা আমাদের শিশুটির হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে শিশুটির কি ক্ষতি করছি একবারও ভেবে দেখছিনা। আমাদের দেশে শিশুদের খাওয়ানোর সময় মোবাইলে কার্টোন দেখিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। এতে করে শিশু খাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার মনোসংয়োগ কার্টোনের দিকে থাকায় তার হজমের জন্য যে সেলাইবা বা লালা কম হচ্ছে এতে তার খাবার হজমের জন্য যে পরিমান লালার প্রয়োজন তা পাচ্ছেনা। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলতে থাকলে শিশুর পেটের পিঁড়া সহ নানা জটিল রোগে ভোগতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা গেছে শিশুদের মোবাইল ব্যবহারে ১.৮ জন শিশু মস্তিকে ক্যান্সারে ভ’গছে। অনেক শিশু চোখের নানা সমস্যায় ভ’গফে অল্প বয়সয়েই। শিশুরা এক মিনিট মোবাইলে কথা বললে মস্তিষ্কে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তা স্থির হতে সময় লাগে কমপক্ষে দুই ঘন্টা। ওই গবেষণায় আরো দাবি করা হয়, যেসব বাচ্চারা দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘন্টা মোবাইল ব্যবহার করে তাদের বুদ্ধির বিকাশ সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে কম হয়। শিশুরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করার কারনে মানুষিক বিকাশ বাধা গ্রস্ত হচ্ছে, পাশা পাশি রয়েছে মস্তিকে ক্যান্সারেরও ঝুকি। তাছাড়া মোবাইলে বিভিন্ন যুদ্ধের গেইম, কার্টোন ও পর্ণো ছবি দেখে শিশুরা জঙ্গিবাদ সহ নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অপর এক গবেষণায় দেখা যায় ১১ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭০ জন নিয়মিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো গবেষণা প্রতিবেদন তৈরী না হলেও অনুমান করা হচ্ছে পরিমাণটা কম নয়। ভারত ও তার আশেপাশের রাষ্ট্রগুলোতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। চীনের মতো প্রযুক্তি বান্ধব রাষ্ট্রে যেখানে শিশুরা দৈনিক দুই ঘন্টা কম মোবাইল ফোনে ব্যবহার করে। সেখানে বাংলাদেশ ভারত ও তার আশেপাশের রাষ্ট্রগুলোতে শিশুরা গড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞরা তাদের গবেষনায় বলেন, আজকের শিশুরা রেডিও ফ্রেকুয়েন্সি ঘেরা এক পরিবেশের মধ্যে বড় হচ্ছে, মোবাইল ফোন থেকে যে রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি নির্গত হয় তা তাদের জন্য ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে । যে সমস্ত শিশুরা অধিক মাত্রায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তারা অপেক্ষাকৃত অনিদ্রা এবং অস্থিরতায় ভুগে থাকে। শিশুদের মস্তিষ্ক ইলেকট্রনিক্স পণ্য থেকে নির্গত ক্ষতিকর রস্মি ধারণের উপযুক্ত নয়। তাছাড়া মোবাইলের কম্পন খুবই ভয়াবহ। শিশুরা একনাগাড়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাদের মৃগি রোগ ও হাঁপানী রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মোবাই ফোনের অধিক ব্যবহার চোখের রেটিনা,কর্নিয়া এবং অন্যান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গবেষনায় আরো দেখা যায় এখন মা-বাবারা শিশুদের বিবেচনা ছাড়াই নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেন অথবা বিনোদনের জন্য ‘ট্যাব’ কিনে দেন। শিশুরা সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে মোবাইল বা ট্যাবের স্ক্রিনের দিকে। ফলে সে দূরের অথবা কাছের বস্তু ঝাপসা দেখে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। এই রোগটাকে বলা হয় চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি সমস্যা। এই রোগের কারণে ক্লাসের পেছনে বসলে সামনের বোর্ড স্পষ্ট দেখতে পায় না শিশুরা।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, শিশুদের চোখে অতিরিক্ত স্ক্রিন অ্যাক্টিভিটি বড়দের চোখের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে। কারণ তাদের চোখ এখনো পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি। কোমল চোখে স্ক্রিনের আলো পড়লে সেটা সহজেই চোখকে আক্রান্ত করতে পারে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে গ্রামের চেয়ে শহরের শিশুদের চোখে এই সমস্যা বেশি। এর কারণ অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহার করা। দীর্ঘ সময় চোখ স্ক্রিনে রাখার ফলে স্ক্রিন থেকে আসা রশ্মি শিশুদের চোখের ক্ষতি করছে এবং চোখ স্থির হয়ে থাকার কারণে চোখ শুকনো হয়ে যায়। ফলে চোখের বিভিন্ন ত্রুটি দেখা দেয়। মোবাইল ফোন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার জন্য নীরব ঘাতক। বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। মস্তিষ্কের গঠন নরম। ফলে মোবাইল ফোনসহ নানা ধরণের ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের ব্যবহার তাদের নানা ধরনের রোগের ঝুঁকিতে ফেলে।
শিশুদের যে সময় দূরের দৃষ্টি তৈরি হওয়ার কথা, সে সময়ই তারা মোবাইল ফোনের কিংবা ট্যাবের স্ক্রিনে দৃষ্টিকে আটকে রাখছে। যে কারণে দূরের দৃষ্টি প্রসারিত হতে পারছে না। ফলে তাদের দৃষ্টিশক্তি বাড়ছে না।
এসব বিষয় থেকে উত্তরণের জন্য অবিভাবকদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। শিশু যদি টিভির সামনে গিয়ে টিভি দেখে, ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা ঝাপসা দেখে তাহলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
এক দশক আগেও শিশুদের মধ্যে মোবাইল ব্যবহারের হার অনেক কম ছিল। বর্তমানে স্মার্টফোন আর ট্যাবের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে শিশুদের এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। আমরা আমাদের শিশুদের ভালোভাবে রাখতে চাই। যেহেতু ভালো রাখতে চাই, তাই স্মার্ট ফোন, ট্যাব থেকে দূরে রাখতে হবে তাদের। যদি বেশি ভালোবেসে, আদর আহলাদ করে তাদের হাতে লাগামহীনভাবে এসব যন্ত্র দিয়ে দেন, তাহলে চোখ নষ্ট হবে আপনার সন্তানেরই। তাই এই বিষয়ে সর্বদা সজাগ থাকা জরুরি মা-বাবা তথা অভিভাবকদের।
তবে শিশুর চোখ ভালো রাখার জন্য বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এই পরামর্শ গুলো আমরা মেনে চললে শিশুদের উপর ফোনের কু প্রভাব অনেকটা কমে যাবে।
১। আপনার শিশু মোবাইলে কথা বলার সময় এয়ারফোন ব্যবহার করা।
২। মোবাইলের পরিবর্তে তাদের হাতে বই তোলে দেয়া, পর্যাপ্ত খেলাধূলার সুযোগ দেয়া এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলোর চর্চা বাড়ানো।
৩। যেখানে আপনার মোবাইলের সংকেতের শক্তি দুর্বল সেখানে আপনার শিশুকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না দেয়া।
৫। প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে, মা-বাবা এবং বাড়ির অন্যান্য লোকেরা যখন শিশুদের আশেপাশে থাকেন তখন তাদের ফোন ব্যবহার সীমাবদ্ধ করা।
৬। বাচ্চাদের সাথে মোবাইলের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে কাউন্সেলিং করা। শিশুদের মাঠের রোদে খেলতে দেয়া এবং ট্যাব মোবাইল ফোনের স্ক্রিন থেকে দূরে রাখা।
৭। বাচ্চাদেরকে স্কুলে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার অনুমতি না দেয়া। বিদ্যালয়ের যোগাযোগের নম্বরটি নিজের কাছে রাখুন এবং জরুরী পরিস্থিতির জন্য আপনার নিজের মোবাইল নম্বরটি স্কুলে সরবরাহ করুন।
৮। মোবাইল ফোন আপনার সাথে নিরাপদে রাখুন এবং শোবার ঘরে শিশুকে ফোন নিতে না দেয়া।
৯। মোবাইল ফোনের টাওয়ার আপনার বাড়ির আশেপাশে বা সন্তানের বিদ্যালয়ের কাছাকাছি থাকলে অতিরিক্ত যত্ন নেয়া। কারন মোবাইল টাওয়ার কাছে তাই রেডিয়েশন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
১০। শিশুরা আধুনিক টেকনোলজি অবশ্যই ব্যবহার করবে তবে তা অতিরিক্ত না। এমনভাবে ব্যবহার করবে, যাতে তার কোনো ক্ষতি না হয়। আর তার জন্য সজাগ থাকতে হবে অভিভাবকদের। সন্তান আপনাদের, তাদের কীভাবে তৈরি করবেন সেটা দেখার দায়িত্ব আপনারই।
১০। ভ্রমণের সময়, আপনার শিশুকে বার বার মোবাইল ফোন দেয়া এড়ানো উচিত।
সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি বাংলা ভিশন ও দৈনিক জনকন্ঠ

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com