শুভ-অশুভ লড়াইয়ের প্রতীক

October 14, 2018,

চৌধুরী ভাস্কর হোম॥ শারদীয় দুর্গোৎসব সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। উৎসবের দুটি দিক। একটি পূজা, প্রার্থনা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের দিক। অন্যটি নিখাদ সামাজিক উৎসব- নাচ-গান-বাজনা, সাজসজ্জা, নতুন কাপড় পরে আনন্দ করা, পরিবারের সদস্যদের পুনর্মিলনী এবং ভোজনবিলাস। শেষোক্তটা কোনো ধর্ম-বর্ণ-উঁচু-নিচু জাতপাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আর সে কারণেই এটি সার্বজনীন। সার্বজনীন দুর্গোৎসব। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রাদর্শ থেকে উৎসারিত উপলব্ধি হচ্ছে- ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।

বাংলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য মনোরম। বছরের বিভিন্ন সময় প্রকৃতিদেবী বিভিন্নভাবে তার রূপ পরিবর্তন করে। সেই পরিবর্তনকে লক্ষ্য করে প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিকে বারো মাসে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই ছয় ভাগকেই ষড়ঋতু বলা হয়। ছয় ঋতু বা বারো মাসেই বাঙালি হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। সে জন্য বলা হয়, বাঙালি হিন্দুদের বারো মাসে তের পার্বণ। হিন্দুদের সব পূজা-পার্বণের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ পার্বণ বা উৎসব দুর্গাপূজা শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয়। সে জন্য একে শারদীয় উৎসব হিসেবেও অভিহিত করা হয়। দুর্গা মাতৃরূপে মহাশক্তি মহামায়া, দেবী যোগমায়া। দেবী শুধু মানবকুলেরই আরাধ্য নন, তিনি দেবতাদেরও আরাধ্য। তিনি নিখিল বিশ্বের অধিশ্বরী, ইষ্ট ফলদায়িনী, সর্বদর্শিনী। তিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কারিণী। তিনি সত্যের রক্ষাকর্তা, দুষ্টের বিনাশকারিণী। তাইএ পূজা আমাদের অজ্ঞাতসারেই আমাদের সমগ্র চেতনায় সংযুক্ত হয়ে মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো আমাদের চৈতন্য সত্তাকে আলোড়িত করে তোলে। এ পূজা আমাদের সমগ্র জাতিসত্তায় মনুষ্যত্বের জাগরণ সৃষ্টি করে। এর প্রতিটি মন্ত্রে আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে আরম্ভ করে বিশ্বজীবনের মঙ্গল বার্তা উচ্চারিত হয়ে থাকে। আমাদের এ পূজা মানবকল্যাণের পূজা, বিশ্ব কল্যাণের পূজা।

আজ আমাদের সমাজের সর্বত্রই দেখা যায় অমঙ্গলের ঘনঘটা। বাতাসের প্রতিকূল স্রোতে আজ আমরা যেন এক অঘিœকুন্ডে বাস করছি। চারদিকে অশুভ শক্তির প্রবল উত্তাপে আমরা দিশেহারা। কীভাবে এ অঘিœবলয় থেকে বের হওয়া যায়- পথ খুঁজে পাচ্ছি না। সমাজের সর্বত্রই দেখা যায়, ধর্মের নামে চলছে অধর্ম। কল্যাণের নামে চলছে অকল্যাণ। কথা ও কাজের কোনো মিল নেই। আমরা প্রেমের কথা বলি, কিন্তু হূদয়ে বিন্দুমাত্র প্রেম নেই; ভালোবাসার কথা বলি, কিন্তু ভালোবাসার চিহ্নমাত্র নেই, ভক্তির কথা বলি- কিন্তু তিলমাত্র ভক্তি নেই। আমাদের আছে শুধু সংকীর্ণ মন। সেই মন যেন মাকড়সার জালের বিস্তার করে আছে লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, অকৃতজ্ঞতা, পঙ্কিলতা, জিঘাংসা, কৃতঘœতা ইত্যাদিতে। আজ আমাদের চারদিকে অশান্তির আগুন বিরাজ করছে- এর মূল কারণ কী? এর মূলে রয়েছে আমাদের হূদয়ে অশুভ শক্তির ছায়া। যার ফলে আমাদের মনুষ্যত্বকে সমূলে বিনাশ করে ফেলেছে। এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার জন্যই মা আনন্দময়ী দুর্গার ধরাধামে আগমন। মা দুর্গা স্বহস্তে অসুর শক্তিকে বিনাশ করে সবার হূদয়ে আনন্দের জোয়ার ভাঙানোর জন্য মর্ত্যধামে অবতীর্ণ হন।

বিজয়া দশমীতে দেবী দুর্গা ভক্তদের পু®পাঞ্জলি-অর্ঘ্যে সিক্ত হয়ে কৈলাসে ফিরে যেতে যেতে যে মঙ্গলালোক ছড়িয়ে দেবেন, তা সবার জীবনকেই আলোকিত করবে। শরতের শুভ্র মেঘ, সাদা কাশফুল আর স্বচ্ছ-শান্ত নদ-নদী দুর্গাপূজার দিনগুলোতে যে আনন্দের আবহ সৃষ্টি করে, তা বছরভর অব্যাহত থাকবে। আমাদের কাছে দেবীর বরণ যেমন আনন্দময়, বিদায় তেমনই বিষাদের ছায়ামাখা। কিন্তু এই বিষাদ আশাবাদেরও- ফের ফিরবেন দেবী, শিউলি-ঝরা পথ ধরে, আলো ও আনন্দ নিয়ে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ভক্তরা প্রত্যয়ী হবেন পরিবার, সমাজ ও প্রিয় স্বদেশের জন্য নিজেদের নিয়োজিত রাখতে। আমরা দেবী দুর্গাকে শুভ ও অশুভের চিরন্তন প্রতীক হিসেবে দেখি। শুভ দুর্গা যেমন অশুভ অসুরকে পরাজিত করেন, তেমনিভাবে অশুভের বিরুদ্ধে সব শুভর লড়াই-ই নিরন্তর। আমরা জানি, ধর্ম নির্বিশেষে সত্য ও সুন্দরের জন্য লড়াই কতটা প্রাসঙ্গিক। আমরা দেখতে চাই, দুর্গাপূজা ছাড়াও দেশের সব শুভ কাজে শুভবুদ্ধিস¤পন্ন সবাই এগিয়ে এসেছে। আবহমান বাংলার অন্যতম প্রধান উৎসব দুর্গাপূজার আবাহন কিন্তু সেটাই। এটাই আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মর্মবাণী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান প্রেরণা। অশুভের বিরুদ্ধে ধর্ম নির্বিশেষে শুভবোধের সেই ঐক্যে শারদীয় উৎসব প্রেরণা হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

আসুন, আমরা সমবেতভাবে মায়ের পাদপদ্মে পু®পাঞ্জলি প্রদানের মাধ্যমে প্রার্থনা করি, যেন কৃপাময়ী মায়ের কৃপায় নব অবয়বপ্রাপ্ত অসুরকুল ধ্বংস হয়। বসুন্ধরা আবার যেন অমিয় শান্তিধারা বরিষণে সুষমামন্ডিত হয়ে ওঠে। আর দুর্গোৎসব ধর্মে ধর্মে মানুষে মানুষে বর্ণে বর্ণে জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতির মেলবন্ধন গড়ে তুলুক- এ কামনা করি।

লেখকঃ নিজস্ব প্রতিবেদক, আরটিভি এবং দৈনিক আমাদের সময়

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com