শ্রদ্ধাঞ্জলি এক অসমাপ্ত অধ্যায়ের মহাপ্রস্থান
চৌধুরী ভাস্কর হোম॥ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মরণ কবিতায় লিখেছেন, মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান- কিন্তু সব মৃত্যুই শ্যামের মতো সমান হয়ে ওঠে না। কোনও কোনও মৃত্যুর ক্লেশ আপনজনকে চিরদিনের জন্য কাঁটার মতো বিদ্ধ করে রাখে। যা শুধুমাত্র অশ্রুর প্লাবনে মুছে যায় না। বকুল পাল মহালদারের অকাল মৃত্যুও তাঁর স্বজন ও গুণগ্রাহীদের কাছে কাঁটার মতোই বিদ্ধ করেছে।
এটা ঠিক, তিনি ৬৬-এ পা দিয়েছিলেন, তাঁর ধর্মীয় আর সমাজসেবার বয়সও সাড়ে তিন দশক পেরিয়েছে; কিন্তু তাঁর এই মৃত্যুকে ‘অকাল’ বলতে আমার দ্বিধা নেই। কারণ মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তাঁকে সমাজসেবা মূলক কর্মকান্ডে সক্রিয় দেখা গেছে। তাঁর মেধা, অভিজ্ঞতা ও আদর্শ থেকে আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। সবাই জানেন, বকুল পাল মহালদার আমাদের দেশের একজন কৃতী, গুণী সমাজসেবক এবং ধর্মীয় সংগঠক ছিলেন। কিন্তু তিনি আর দশজন কৃতী সমাজসেবক থেকে কতটা স্বতন্ত্র, তাঁকে কাছ থেকে দেখলে বোঝা যেত। তাঁকে আধুনিক সমাজসেবার পথিকৃৎও বলা যায় নিঃসন্দেহে। ৬৬ বছর বয়সেও যে মানুষ এত কাজপাগল থাকেন, তাঁকে তো ভিন্ন মাত্রায় মূল্যায়ন করতেই হয়। বলতে গেলে তাঁর প্রায় অকস্মাৎ মৃত্যুকে ‘অকাল মৃত্যু’ই বলতে হয়। কারণ এই বয়সেও স্বপ্ন ধারণ করে তিনি ভবিষ্যৎ স¤পর্কে নতুন করে ভাবতেন, ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতেন। সমাজসেবায় তিনি ঝুঁকে থাকতেন গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে। তাঁর জীবদ্দশার কর্মময় জীবনের প্রতিটি দিন ধর্মীয় কর্মকান্ড আর সমাজসেবাকে ঘিরে ছিল ব্যস্থতা। তাঁর মেধা, অভিজ্ঞতা, আদর্শ আমাদের আরও অনেক কিছু দিতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা তা থেকে বঞ্চিত হলাম। তিনি আর দশজন কীর্তিমান মানুষের চেয়ে কতটা ভিন্ন ছিলেন এরও প্রমাণ পেয়েছি আমরা তাঁর সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়েই। তাঁর দক্ষতা-দূরদর্শিতার মূল্যায়ন নানাভাবেই হয়েছে।
বকুল পাল ১৯৫৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার রাজারবাজার পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তিনি রাজারবাজার উচ্চ বিদ্যালয় ও পরে বৃন্দাবন কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। আর্দশ ও সততার জন্য তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবসায়িক সফলতা লাভ করেন। রাজনৈতিক সচেতন বকুল পাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সকলের নিকট তিনি সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। অসাধারন সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী এই মানুষটি নিজ উদ্দ্যেগে এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেন দক্ষিন রুপসপুর শ্রী শ্রী দুর্গা বাড়ী। যা আজ একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজের ছোট বড় সকলের নিকট তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারনে সমাজের অপরাপর মানুষজন’কে তিনি সহজেই আকৃষ্ঠ করতে পেরেছিলেন। একজন আর্দশিক সালিশ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর গ্রহনযোগ্যতা ছিল সবার নিকট। কারও আনুকূল্যে নয়; নিজের শ্রম, মেধা ও যোগ্যতায় তিনি সামাজিকতায় নিজ অবস্থান তৈরি করেছেন। তার কাজ উত্তরসূরিদের অনুকরণের বিষয় হবে।’ সন্দেহ নেই, সমাজ সেবায় বকুল পাল মহালদার এর শূন্যতা পূরণ করা কঠিন। খুব সহজে আরেকজন বকুল পাল মহালদার তৈরি হবেন না। কিন্তু আমি জানি, তিনি অনেক কেই তৈরি করেছেন। আমি আশা করি, তাদের মধ্য থেকে কেউ না কেউ বেরিয়ে আসবেন। অনাগত প্রজন্মের কাছে বয়ে নিয়ে যাবেন আধুনিক ও মুক্ত সমাজসেবার মশাল।
নিষ্ঠুর মায়াবী পৃথিবী কখনও কখনও এক অপার্থিব জগতে আমাদের ছুঁড়ে দেয়। মৃত মানুষ, চৈতন্যের কোন অদ্ভুত অনুভূতিকে আঘাত করে তা আমাদের জানা নেই। ২৫ নভেম্বর ২০২০ইং বুধবার বিষাদের চিহ্ন বুকে নিয়ে এক রাত আসে, নেমে আসে স্বপ্নহীন অনাকাঙ্খিত এক বন্ধ্যা সময়। তারপর এলোমেলো রাতের বাতাস গায়ে মেখে সে রাত ছুটে চলে ভোরের অপেক্ষায়। আয়োজন চলে এক অসমাপ্ত অধ্যায়ের মহাপ্রস্থানে। মানুষের চাপা কান্নায় ভারি হয় বাড়ির আঙ্গিনা। সার্বজনীন বাড়ির স্বপ্নদ্রষ্ট ওপাড়ের ঐশ্বর্যে ধূপের ধোয়ায় ভেসে যায়। স্বপ্নরা ঘা ভাসায় ধূপের ধোয়ায়। শবদাহ চলে প্রিয়জনের কাঁধ হয়ে শেষ গন্তব্যে। সেখানে মানুষের অশ্রুসজল চোখে শেষ বারের মতো তাকে দেখার আকুতি যেন শেষ হয় না। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হতে হতে তার দেহ উঠে চিতায়। ২৬ নভেম্বর ২০২০ইং বৃহস্পতিবার সকাল ১০.৩০ মিনিটে চিতার আগুনে মহাপ্রস্থান ঘটে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের।
বকুল কাকু, সৃষ্টিকর্তা যেন আপনাকে স্বর্গবাসী করেন। যতদিন বেঁচে থাকব! আপনার ছবি আমার মানসপটে ভাসবে; মনে পড়বে ফেলে আসা সোনাঝরা দিনগুলোর কথা। আমার স্মৃতিতে আপনার স্থান হবে শীর্ষে। কবির কথা দিয়েই আমার লেখার সমাপ্তি টানছি: ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’
লেখক: সহ-সভাপতি, শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাব।
মন্তব্য করুন