শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
এহসান বিন মুজাহির॥ আজ পহেলা মে আর্ন্তাতিক মে দিবস। পৃথিবীর শ্রমজীবি মানুষের জন্য আজকের দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমের মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই দিনে শ্রমিকরা প্রতিবাদ-সংগ্রাম করেছে মালিকদের বিরুদ্ধে। অবশেষে রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে তারা শ্রম-অধিকার ও মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে। আর সে থেকেই পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে মে দিবস পেরিয়েছে ১৩৬ বছর। এত বছর পরও নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষেরর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই করোনাকালেও শ্রমিকরা বেতন ও ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য জীবনবাজী রেখে লকডাউন এর মাঝেও বিক্ষোভ-প্রতিবাদে রাজপথে সোচ্চার! এই করোনা দূর্যোগো বকেয়া বেতন না পেয়ে কাঁদছেন শ্রমজীবী মানুষ। একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবি হলো, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হযরত আদমই (আ.) শুধু নন; সকল নবী-রাসূল এমনকি আমাদের প্রিয় নবী, শ্রমিকের অধিকার ও শ্রম আইনের পথপ্রদর্শক হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা উপার্জন করতেন। সুতরাং শ্রমিকের হাত আল্লাহর কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয়।
শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কুরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আজ অবধি পৃথিবীতে যা কিছু গড়ে উঠেছে তা সবই শ্রমের ফল এবং শ্রমিকের কৃতিত্ব। ইসলাম শ্রমিক এবং শ্রমকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছে। একমাত্র ইসলাম ধর্মই শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে মূলনীতি ও বিধান প্রবর্তন করেছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-‘অতপর নামাজ সমাপ্ত হলে জীবিকার্জনের জন্য তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’। (সূরা আল জুমআহ, আয়াত নং : ১০)। আল্লাহ এরশাদ করেন-নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি’। (সূরা বালাদ, আয়াত নং : ৪)। কুরআনে আরও এরশাদ হয়েছে-‘সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে দৈহিক দিক দিয়ে শক্ত-সমর্থ্য ও আমানতদার।’ (সূরা কাসাস : ২৬)।
পৃথিবীর সর্ব প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হজরত আদমই (আ.) থেকে শুরু করে বহু নবী-রাসূল এমনকি সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহও (সা.) শ্রমজীবী ছিলেন। নবী-রাসূল এবং সাহাবায়ে কেরামগণ নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা উপার্জন করেছেন। আমাদের প্রথম নবি হজরত আদম (আ.) ছিলেন দুনিয়ার প্রথম চাষি, হজরত শুয়াইব (আ.) ও হজরত হারুন (আ.) এর পেশা ছিল পশু পালন ও দুধ বিক্রি। হজরত মুসা (আ.) ছিলেন একজন রাখাল। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এবং মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সৎ ব্যবসায়ী। এছাড়াও হজরত লুত ও হজরত শিস (আ.) ছিলেন কৃষক, হজরত ইদরিস (আ.) ছিলেন দর্জি, হজরত নুহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি, হজরত ইবরাহিম (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত হুদ (আ.) সালেহ (আ.) ছিলেন ব্যবসায়ী। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- আল্লাহ দুনিয়াতে এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি ছাগল ও ভেড়া চড়াননি। তখন সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল (সা.) আপনিও? রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, হ্যাঁ! আমিও মজুরীর বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল ও ভেড়া চরাতাম’। (বুখারি, হাদিস নং: ১৩৪০)। হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন-‘অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। (ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা নং :.২৬৯৭)। হজরত রাসূল (সা.) শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি গুরত্ব দিয়ে মালিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বলেন-‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও’। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ৮১৭)।
নবিজী বলেন-শ্রমিকরা তোমাদের ভাই, আল্লাহ এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহ তায়ালা যে ব্যক্তির ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন, তার উচিত সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরবে তাকেও তা পরাবে, আর যে কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয়, সে কাজের জন্য তাকে কষ্ট দেবে না। আর যদি কষ্ট দেয়, তাতে নিজেও তাকে সাহায্য করবে। (আবু দাউদ : ৩৩৭)।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও এরশাদ করেন-‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমি কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিপক্ষ। আর আমি যার প্রতিপক্ষ, তাকে পরাজিত করবই। তন্মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে, অতঃপর তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে নেয় কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না’। (বুখারি দ্বিতীয় খন্ড, হাদিস নং : ৭৭৬)
রাসুলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন ধরণের উপার্জন উত্তম ও শ্রেষ্ঠ? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ব্যক্তির নিজ হাতে কাজ করা এবং সৎ ব্যবসা। (সুয়ুতি আদদুররুল মানসুর, খ- ৬, পৃষ্ঠা ২২০)। হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুশয্যার সময়ও নামাজ এবং অধীনস্থদের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ৫১৯)। হাদিসে এরশাদ হয়েছে-‘কারও জন্য নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য বা খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাউদ (আঃ) নিজ হাতের কামাই খেতেন’। (মিশকাত শরিফ, হাদিস নং : ২৭৫৯)। একমাত্র ইসলাম ধর্মই শ্রম এবং শ্রমিকের যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করে যথার্থ মূল্যায়ন করেছে। মনে রাখতে হবে শ্রমিকরাও মানুষ। শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা নয়। তাদের যথাযথ সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা ইসলামের শিক্ষা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও অধ্যক্ষ, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন