(ভিডিও সহ) শ্রীমঙ্গলের হাজীপুরে আলোচিত প্রতিবন্ধী হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন : মূল পরিকল্পনাকারী চাচা গ্রেপ্তার
স্টাফ রিপোর্টার॥ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাজীপুর এলাকায় আলোচিত প্রতিবন্দী হত্যা মামলার মূল রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বাদী পক্ষের আটক ২ জন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার ১৮ জানুয়ারি দূপুরে পিবিআই কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং এ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেন জানান, পূর্বের শত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে আপন ভাতিজা বাক ও শারিরিক প্রতিবন্ধি আরিফুল ইসলাম আরিফ হত্যা করা হয়েছে। পিবিআই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মামলার ২ নং সাক্ষী মোঃ ইয়াকুত মিয়া ও মোঃ তোফায়েল আহমেদ নামের অপর একজন গ্রেফতার করেন। হত্যা কান্ডে ব্যবহৃত একটি সিএনজি উদ্ধার করে পিবিআই। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন আছে ও অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্ঠা অভ্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য ২০১৭ সালের ২৪ জুন সন্ধ্যার কিছু পূর্বে হাজীপুর গ্রামে একটি যৌথ পুকুরে রান্নায় ব্যবহৃত হান্ডিবাসন ধোয়াকে কেন্দ্র করে একই বাড়ির ২ পক্ষের মধ্যে কথাকাটাটির জের ধরে সংঘর্ষ হয়। এ সময় উভয় পক্ষে ইট পাটকেল নিক্ষেপ হলে এতে ৬/৭ জন আহত হয়। সংঘর্ষ থেমে গেলে আহতরা প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
এ ঘটনার প্রায় পৌনে এক ঘন্টাপর প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে একই বাড়ির প্রতিবন্ধী আরিফকে তার চাচা মোঃ ইয়াকুত মিয়া ঘর থেকে উঠানে এনে লাটি দিয়ে মাথায় আঘাত করে আহত করেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা আরো কয়েকজন সহযোগীর মাধ্যমে একটি সিএনজি অটোরিক্সা দিয়ে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানোর নামে রাস্তায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করে লাশ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে প্রথমে শ্রীমঙ্গল থানায় প্রতিবন্ধীর বাবা মোঃ আরবেশ আলী বাদী হয়ে ১৮ জনকে আসামী করে ২৬/০৬/১৭ তারিখে মামলা দায়ের করেন। শ্রীমঙ্গল থানার এস আই মোঃ রফিকুল ইসলাম এ মামলার তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে গত ২৪/০৯/১৭ তারিখে ১৮ জন আসামীর মধ্যে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র পাঠান। ৩ জনের নাম বাদ দেয়ার কারনে আদালতে না রাজি দেন মামলার বাদী মাঃ আরবেশ আলী। পরে আদালত পিবিআইকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। পিবিআইর তদন্তেÍ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মামলার ২ নং সাক্ষী মোঃ ইয়াকুত মিয়াকে ১৩ জানুয়ারি ও মোঃ তোফায়েল আহমেদ নামের অপর এক আসামীকে ১৬ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করেন। পিবিআইর জিজ্ঞাসাবাদে আটক দু’জন প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য তারা পরিকল্পিত ভাবে প্রতিবন্ধী আরিফকে হত্যা করেছেন। আটককৃতরা হত্যার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ন তথ্য দিয়েছে। পরে এ দু’জন আদালতে বিজ্ঞ বিচারকের কাছে প্রতিবন্ধী আরিফকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তে যা পাওয়া যায় :
গত ২৮ শে রমজান অর্থাৎ ২৪/০৬/২০১৭ খ্রিঃ তারিখ সকাল অনুমান ১১.০০ ঘটিকার সময় কাইয়ুম এর স্ত্রী সাফিয়া বেগম থালা-বাসন ধৌত করার জন্য তাদের যৌথ পুকুর ঘাটে যায়। থালা-বাসন ধৌত করার বিষয় নিয়া সাফিয়া বেগমের সাথে আসামী মোঃ ইয়াকুত মিয়ার চাচা মশ্বব আলীর কথা কাটাকাটি হয়। অতঃপর বেলা অনুমান ১ ঘটিকার সময় বাদীর চাচাতো ভাই কালাম মিয়ার ঘরে মোঃ ইয়াকুত মিয়া, জুনায়েদ, বেলাল এবং তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মশ্বব আলী ও সাফিয়া বেগমের কথা কাটাকাটির বিষয় নিয়া আব্দুল খালেক গং ঝগড়া বাঁধালে তারা মোঃ ইয়াকুত মিয়ার ভাতিজা প্রতিবন্ধি আরিফুল ইসলাম আরিফ হোসেনকে হত্যা করে তাদেরকে ফাঁসাবে।
এদিকে সাফিয়া বেগম ও মশ্বব আলীর মধ্যকার কথা কাটাকটির ঘটনাটি সাফিয়া বেগম তার পরিবারের লোকজনকে জানালে আব্দুল খালেকের ছেলে মোঃ সজ্জাদুর রহমান সজ্জাদ মিয়া (৩৪) আছরের পর তাদের বাড়ীর উঠানে দাঁড়াইয়া মশ্বব আলীকে উদ্দ্যেশ্য করিয়া গালিগালাজ করে। এতে বাদী মোঃ আরবেশ মিয়া প্রতিবাদ করলে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। তখন উভয়পক্ষের লোকজন উভয়কে নিবৃত্ত করে। উক্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে ইফতারের পর সন্ধ্যা অনুমান ৭ ঘটিকার সময় অত্র মামলার বাদী আরবেশ আলীর এবং বিবাদী আব্দুল খালিকের লোকজনদের মধ্যে ইট পাটকেল ছুড়াছুড়ি এবং মারামারির ঘটনা ঘটে। ইহাতে বাদী আরবেশ আলীসহ উভয় পক্ষের কয়েকজন আহত হন। উপস্থিত লোকজন জখমীদের মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেন। প্রায় আধা ঘন্টা পর মোঃ ইয়াকুত মিয়ার ঘরের সামনে থাকা প্রতিবন্ধী আরিফ হোসেনকে মোঃ ইয়াকুত মিয়া একটি বাঁশের টুকরা (গল্লা) দিয়া মাথায় বারি মারে। এতে আরিফ হোসেন রক্তাক্ত জখমপ্রাপ্ত হয়ে কাত হয়ে পরে যায়। তারপর জুনায়েদ, বেলাল এবং তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ তারা তিন জন আরিফ হোসেনকে ধরাধরি করে কালাম মিয়ার ঘরের বারান্দায় তুলে রাখে।
পরক্ষণে মোঃ ইয়াকুত মিয়া ১। বেলাল (৩২), পিতা-মৃত ছমির মিয়া, ২। জুনায়েদ (২৭), পিতা-মোঃ এশার মিয়া, উভয় সাং-হাজীপুর, ৫ নং কালাপুর ্ইউপি, থানা-শ্রীমঙ্গল, জেলা-মৌলভীবাজার এবং ৩। মোঃ তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ দেরকে ডেকে নির্দেশ দেয় যে, আরিফ হোসেনকে হাসপাতালে নেয়ার পথে মেরে ফেলবে। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক জুনায়েদ একটি অটোরিক্সা আনতে যায় এবং তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ শ্রীমঙ্গলে যায়। প্রায় ৫/১০ মিনিট পর জুনায়েদ ড্রাইভার শামসুল হকের সিএনজি অটোরিক্সা মৌলভীবাজার-থ-১২-৩১৪০ গাড়ীটি নিয়ে আসে। তখন জুনায়েদ ও বেলাল আহত আরিফ হোসেনকে ধরাধরি করে সিএনজি অটোরিক্সার পিছনের সিটে তুলে আরিফ হোসেনকে মধ্যে বসিয়ে দুজন দুই পাশে বসে।
ড্রাইভার শামসুল হক গাড়ীটি চালিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাত অনুমান ৮.১৫ ঘটিকার সময় জুনায়েদ তোফয়েল আহমেদ বল্লাদকে ফোন দিয়ে একটি দা আনতে বলে। তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ শ্রীমঙ্গলের পোষ্ট অফিস রোডের পুরানবাজার ফুটপাতের দোকান হতে ১৪০/-টাকা দিয়ে ১টি দা কিনে। দা কিনার পর সে শ্রীমঙ্গল থানার রাজাপুর মেইন রোডে এসে দাড়ায়। তখন ড্রাইভার শামসুল হকের চালিত অটোরিক্সাটি রাজাপুরে অপেক্ষমান তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ এর নিকট এসে দাঁড়ায়। সেখানে অপেক্ষমান তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ শ্রীমঙ্গল থেকে কিনে আনা নতুন দা’টি জুনায়েদের হাতে দেয় এবং সে নিজে ড্রাইভারের সাথে বাম পাশে বসে। অতঃপর তারা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।
গাড়ীটি ভৈরবগঞ্জ বাজারে পৌঁছলে জুনায়েদ ড্রাইভার শামসুল হক কে গাড়ীটি মাজদিহি চা বাগানের দিকে নিয়ে যেতে বলে। তার কথামত ড্রাইভার শামসুল হক গাড়ীটি চালিয়ে মাজদিহি চা বাগানের ৭ নং সেকশনে যায়। তখন রাত অনুমান ৯.১৫ ঘটিকা। সেখানে ভিকটিম আরিফ হোসেনকে বেলাল ও জুনায়েদ অটোরিক্সা থেকে নামায়। দুই মিনিট পর অপরদিক থেকে ১টি গাড়ী আলো দেখা গেলে জুনায়েদ ও বেলাল আরিফকে পূনরায় অটোরিক্সাতে তোলে। পরে গাড়ী ঘুরিয়ে প্রায় ৩০ গজ দূরে নিয়ে একটি কালভার্টের পাশে দাঁড়ায়। জুনায়েদ ও বেলাল আরিফ হোসেনকে রাস্তার পার্শ্বে নামায়। অতপর জুনায়েদ ও বেলাল দা দিয়ে আরিফ হোসেন এর পায়ের পিছন দিকে গোড়ালির উপর কোপ দেয়। মোঃ তোফায়েল আহমদ বল্লাদ ও ড্রাইভার শামসুল হক পাশে দাড়িয়ে থেকে পাহারা দেয়। বিপরীত দিক থেকে অন্য একটি গাড়ীর আলো দেখে মোঃ তোফায়েল আহমদ বল্লাদ ও ড্রাইভার শামসুল হক ইশারা দিলে বেলাল ও জুনায়েদ ভিকটিম আরিফ হোসেনকে অটোরিক্সায় তোলে দুই পাশের দুইটি পর্দা লাগিয়ে দেয়।
বেলাল ও জুনায়েদ গাড়ীতে উঠে পূর্বের ন্যায় আরিফ হোসেনকে মাঝখানে বসাইয়া রাখে। গাড়ী মেইন রোডে আসা মাত্র জুনায়েদ আরিফ হোসেনের মুখে চাপ দিয়ে ধরে। গিয়াসনগর পোঁছা মাত্র জুনায়েদ ড্রাইভার শামসুল হককে ধীরে চালাতে বলে। জুনায়েদ ও বেলাল তখন দা দিয়ে আরিফ হোসেনের মাথায় কয়েকটি কোপ দেয়। অতপর জুনায়েদ ভিকটিম আরিফ হোসেনের মুখ ও বেলাল দুই পা চেপে ধরে রাখে। জেলা কারাগারের সামনে আসা মাত্র আরিফ হোসেন জোরে ঢেকুর দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। গ্যাস লাইটের পিছনের আলোতে আরিফ হোসেন মারা গেছে মর্মে আসামীরা নিশ্চিত হয়।
এরপর জুনায়েদ ড্রাইভার শামসুল হক কে গাড়ী দ্রুত হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। রাত অনুমান ১০ ঘটিকার সময় তারা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে পৌছে। অতঃপর জুনায়েদ ও বেলাল ভিকটিম আরিফ হোসেনকে গাড়ী থেকে নামিয়ে হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ভিতরে রাখে। তখন হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার ভিকটিম আরিফ হোসেনকে মৃত ঘোষনা করেন। পরদিন ২৫/০৬/২০১৭ খ্রিঃ তারিখ সকাল অনুমান ৭ ঘটিকার সময় বেলাল মোঃ ইয়াকুত মিয়ার বাড়ীতে এসে ইয়াকুত মিয়াকে ভিকটিম আরিফ হোসেনকে খুন করার ঘটনার বর্ণনা দেয়। ঐ দিন সন্ধ্যা বেলায় মোঃ ইয়াকুত মিয়া তার বাড়ীতে জুনায়েদের মাধ্যমে মোঃ তোফায়েল আহমেদ বল্লাদকে ডেকে আনে। কালাম মিয়ার ঘরের পাশে মোঃ ইয়াকুত মিয়া, জুনায়েদ, বেলাল এবং তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ এই ৪ জন মিলে প্রতিজ্ঞা করে যে, জীবন গেলেও কোন দিন কারো কাছে উক্ত খুনের ঘটনা তারা প্রকাশ করবে না এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, ড্রাইভার শামসুল হককেও এ বিষয়ে সতর্ক করে দিতে হবে। ২/৩ দিন পর মোঃ ইয়াকুত মিয়া ড্রাইভার শামসুল হককে ডেকে এনে বলে যে, উক্ত ঘটনা কারও কাছে বললে তুমিও ফেসে যাবে। তারপর মোঃ ইয়াকুত মিয়া ড্রাইভার শামসুল হককে ৩ হাজার টাকা দেয়।
শ্রীমঙ্গলে প্রতিবন্ধি কিশোর খুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচনসহ প্রকৃত খুনীদের শাস্তি চায় এলাকাবাসী
ফলো আপ : হাজীপুরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষ : প্রতিবন্ধি কিশোর রহস্যজনক খুন
মন্তব্য করুন