‘ডিজিটাল বালাইনাশক নির্দেশিকা’ – ওয়েব ও মোবাইল এপ্লিকেশান’ তৈরী করলেন কৃষি অফিসার সুকল্প দাস,
সাইফুল ইসলাম॥ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ অনন্য সফলতা অর্জন করেছে কৃষি ক্ষেত্রে। দানা জাতীয় খাদ্য উৎপাদনে আজ দেশটি শূধু স্বয়ং সম্পূর্ণই নয়, এ বছর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৫০ হাজার মেঃটন চাল রপ্তানী করেছে শ্রীলংকায়।
১৯৭১ সনে যেখানে দেশের জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ৭ কোটি, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ কোটিতে। একইসাথে, দানাজাতীয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১ কোটি টন থেকে বেড়ে প্রায় ৪ কোটি টনে উপনীত হয়েছে।
পক্ষান্তরে আবাদী জমির পরিমাণ স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছর ১ থেকে ২ শতাংশ হারে কমছে। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশের এই সফলতা বিশ্মের নিকট এক আশ্চর্য উদাহরণ। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, নীতিনির্ধারক, সর্বোপরী দেশের আপামর কৃষকের মিলিত প্রচেষ্টায়।
বাংলাদেশের কৃষি Subsistence Agriculture থেকে Commercial Agricultureএর দ্বারপ্রান্তে উপনীত। কৃষি বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাত আবিষ্কার করার সাথে সাথেই কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের সহায়তায় তা ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে কৃষকদের কাছে।
কৃষকরা প্রতি একক জমিতে অধিক ফলন পেয়ে ব্যাপক উৎসাহে আবাদে আত নিয়োগ করছে। ফলে, কোন জমিই আর পতিত থাকছে না।
এতে করে বাংলাদেশের কৃষি এখন অনেক বেশী উপকরন-ঘন (Input Intensive) হয়ে পড়ছে।
ক্রমাগত ফসল উৎপাদনের ফলে জমির উৎপাদিকা শক্তি কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন কীটপতঙ্গের আক্রমণ বাড়ার সাখে সাথে বাড়ছে রাসায়নিক সার এবং বালাইনাশকের ব্যবহার।
বাংলাদেশের কৃষির এই অগ্রগতি দেখে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী কোম্পানী আমদানী করছে বিভিন্ন দেশের বীজ ও বালাইনাশক।
দেশে কৃষি ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রায় ২৫০ গ্রুপের প্রায ৫,৫০০ বালাইনাশক বাজারজাত করছে বিভিন্ন দেশী বিদেশী কোম্পানী। দিনদিন এ সংখ্যা বাড়ছে।
একেক ধরনের বালাইনাশক একেক ধরনের রোগ-পোকা-মাকড়ের বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন পদের সম্প্রসারণ কর্মীদের পক্ষে সকল ধরণের বালাইনাশকের নাম মনে রাখা বাস্তবিক অর্থেই চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষক পর্যায়ে সর্বশেষ কৃষি প্রযুক্তি প্রচার ও প্রসারের কাজে নিয়োজিত সরকারী সংস্থা। সংস্থাটির প্রশিক্ষিত জনবল জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত আছে।
কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, ফসলের মাঠ রোগ বা পোকা-মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রথমেই তারা কোন বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া স্থানীয় কোন বালাইনাশকের দোকান থেকে ঔষধ কিনে মাঠে স্প্রে করে।
কৃষকরা নিজেরা যেহেতু ফসলের রোগ বা পোকা-মাকড় সঠিকভাবে সনাক্ত করতে পারে না এবং স্থানীয় বালাইনাশক ব্যবসায়ীর যেহেতু এ সম্পর্কে কোন কারিগরী জ্ঞান নেই, তাই প্রয়োগকৃত ঔষধ দ্বারা কাঙ্খিত ফল লাভ হয়না।
উপরন্তু, কৃষকের সময়, অর্থ নাশ হয় এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্খ্যের ক্ষতি হয়। পরবর্তীতে, কৃষক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলে অনেক ক্ষেত্রে, তাদের কাছ থেকেও তাৎক্ষণিক সমাধান পায় না।
কারণ, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নিকট সর্বশেষ অনুমোদিত বালাইনাশকসমূহের তালিকা থাকে না।
উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বিশেষ রোগ-পোকা-মাকড়ের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত বালাইনাশক সনাক্ত করতে তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে বই-পুস্তক দেখতে হয়, বালাইনাশক কোম্পানীর প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়।
এতে সময় নষ্ট হয়, সরকারী কর্মকর্তাদের উপর কৃষকের আস্থা নষ্ট হয়। সর্বোপরি, সঠিক সময়ে প্রতিকার করতে না পারলে কৃষকের পুরো ফসল নষ্ট হতে পারে।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ টুআই কর্মসূচীর সহযোগিতায় শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অফিসার সুকল্প দাস পেস্টিসাইড সম্পর্কিত তথ্যাদি ডিজিটালাইজ করে ‘বালাইনাশক নির্দেশিকা’ বা `Pesticide Prescriber’ নামক একটি ওয়েব ও একটি মোবাইল এপ্লিকেশান তৈরী করে কৃষি সম্প্রসারণ সেবাদানকারীসহ সকল কৃষক, বিভিন্ন কোম্পানী, গবেষক, কৃষি শিক্ষায় নিয়োজিত ছাত্র-শিক্ষক এর নিকট পেস্টিসাইড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সহজলভ্য করেছেন।
বাজারে বিভিন্ন রোগ-পোকা-মাকড়ের বিরুদ্ধে কার্যকরী বিভিন্ন গ্রুপের অনেক বাণিজ্যিক নামের বালাইনাশক রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং অনুমোদিত বালাইনাশকের তালিকা নিয়ে নিয়মিত একটি প্রকাশনা বের করে যা Pesticide Technical Advisory Committee (PTAC) অনুমোদিত।
এ বইয়ের তথ্যাবলীকে ডিজিটালাইজ করেই কাজটি করা হয়েছে। বিষয়টি একটু উদাহরণ দিয়ে বলা যায়।
ধরা যাক, কৃষকের মাঠ পামরী পোকায় আক্রান্ত হয়েছে। পেস্টিসাইড সম্পর্কিত কম্পিউটার ওয়েবপেইজ বা মোবাইল অ্যাপস এ পামরী পোকার নাম লেখার সাথে সাথেই এর বিপরীতে কার্যকরী সকল বালাইনাশকের গ্রুপের নাম স্ক্রিনে আসবে।
স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী পোকার প্রাদুর্ভাব, স্থানীয় বাজারে সহজলভ্যতা বিবেচনা করে যে কোন একটি গ্রুপে ক্লিক করার সাথে সাথেই ঐ গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানী কর্তৃক বাজারজাতকৃত সকল বাণিজ্যিক নামের বালাইনাশকের নামের তালিকা আসবে।
যেকোন একটি বালাইনাশকে ক্লিক করার সাথেই এর প্রয়োগ মাত্রা এবং রেজিস্ট্রেশন নাম্বার জানা যাবে। অর্থাৎ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী কৃষকের মাঠে দাঁড়িয়েই তাৎক্ষণিকভাবে কৃষককে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবে।
যেহেতু বালাইনাশকটির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার সাথে সাথে জানা যাবে, এতে ঔষধটি আসল না নকল তাও সনাক্ত করা যাবে।
মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে তৈরীকৃত অটোপ্রেসক্রিপশানটি কৃষকের মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে দেয়া যাবে, আর ওয়েব অ্যাপস এর মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত অটোপ্রেসক্রিপশান প্রিন্ট করে প্রদান করা যাবে।
কৃষকরা যে কোন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে এই সেবাটি নিতে পারবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং মূলত বালাইনাশকের রেজিস্ট্রেশান প্রদানসহ এ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ করে থাকে।
সুকল্প দাস কর্তৃক উদ্ভাবিত ওয়েবপেইজ এবং মোবাইল অ্যাপসের এর মাধ্যমে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের মূল কাজটি অটোমেটেড হয়ে গেল। অর্থাৎ শ্রীমঙ্গল উপজেলার উদ্ভাবন সারা বাংলাদেশের কৃষিতে একটি বড় ভূমিকা রাখল।
‘বালাইনাশক নির্দেশিকা’ বা `Pesticide Prescriber’ এর বর্তমান ওয়েব লিংক pest2.bengalsols.com ।
মোবাইল এপ্লিকেশানটি Google Play Store G Pesticide Prescriber লিখে সার্চ দিয়ে এন্ড্রয়েড ফোনে ইনস্টল করে ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, কৃষক, বালাইনাশক কোম্পানী ও বিক্রেতা, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সকলেই উপকৃত হবেন।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরাপদ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপশি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে পেস্টিসাইড সম্পর্কিত তথ্যাদির ডিজিটালাইজেশান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
মন্তব্য করুন