শ্রীমঙ্গলে হলুদে সেজেঁছে প্রকৃতি: চারদিকে কদমের মৌ মৌ গন্ধ
তোফায়েল আহমেদ পাপ্পু॥ বিকাল ৫টা শ্রীমঙ্গল শহরের শাহীবাগ রাস্তার মোড়ের চা স্টলে বসে এক কাপ চা হতে নিয়ে চা পান করতেই হটাৎ হালকা মৃদু বাতাসের সাথে পরিচিত একটি গন্ধ পেতেই মাথা তুলে তাকালাম এদিক ওদিক তাকালাম। ঠিক বামে দক্ষিন দিকে দেখলাম কদম গাছ। গাছটিতে অসংখ্য কদম ফুল। কিছু ফুটন্ত, কিছু ফুটবে এমন সমারোহে ভরে গেছে আশে পাশের অন্য কদম গাছগুলোও। প্রকৃতি যেন আপন হাতে সাজিয়ে রেখেছে ফুলগুলোকে। সাথে সাথেই মনে পড়ল কবিগুরুর বিখ্যাত একটি গান, “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান”। কিন্তু এটি কি বর্ষাকাল? মনে করার চেষ্টা করলাম এখন বাংলা কি মাস, মোবাইল ফোনে বাংলা ক্যালেন্ডারে দেখলাম জ্যৈষ্ঠ মাসের ১০ তারিখ।
কদম ফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত। প্রতিবছরই কদম ফুল বর্ষার আগাম বার্তা বয়ে আনে প্রকৃতির বুকে। বর্ষা ঋতুর প্রথম মাস আষাঢ়েই ফোটে কদম ফুল। আর এটাই আবহমান বাংলার চিরাচরিত নিয়ম। কিন্তু চলতি বছরের রূপ একটু ভিন্ন। আষাঢ়ের দুই মাস আগে থেকেই প্রায় প্রতিদিন, বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই মাঝারি বা ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। প্রকৃতিও যেন বর্ষার এই আগাম আগমনে বিভ্রান্ত, তাইতো জ্যৈষ্ঠ মাসেই পর্যটন এলাকা ব্যাস্ততম শ্রীমঙ্গলের অলি-গলিতে এখন হলুদে সেজেঁছে। শহরের বিভিন্ন মোড়ে দেখা মিলছে কদম ফুলের। এই বিরামহীন বর্ষনে গাছের শাখে শাখে সবুজ পাতার আড়ালে ফুটে উঠেছে অসংখ্য কদম ফুল।
কদম নামটি এসেছে সংস্কৃত নাম কদম্ব থেকে। প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে কদম ফুলের আধিপত্য। মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যেও কদম ফুলের সৌরভমাখা রাধা-কৃষ্ণের বিরহগাথা রয়েছে। ভগবত গীতাতেও রয়েছে কদম ফুলের সরব উপস্থিতি।
আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষাকাল। বাঙালির প্রিয় ঋতুর একটি। আর এই বর্ষাতেই কদম ফুলের ¯িœগ্ধ ঘ্রাণ যুগে যুগে শহর কিংবা গ্রামবাসীদের মুগ্ধ করে। বর্ষা এলেই কদম ফোটে, চোখ ধাঁধিয়ে দেয় ফুলপ্রেমীদের। খাল-বিলের উপচেপড়া পানি যেমন শাপলাকে সাজায়, তেমনি চারপাশের পরিবেশকে মাতিয়ে তোলে বর্ষার কদম ফুল। বর্ষা মানেই হলুদ-সাদা মিশ্র রঙের কদম ফুলে গাছ ছেয়ে যাওয়া। বর্ষা মানেই গুচ্ছ গুচ্ছ কদম ফুলের মিষ্টি সুবাস। বর্ষা মানেই কদম ফুলের মতো তুলতুলে নরম বৃষ্টির রিনিঝিনি ধ্বনি।
কদম ফুলের আরেক নাম হল নীপ। ফুলের সৌন্দর্যের মতো আরও কয়েকটি সুন্দর নাম রয়েছে- যেমন বৃত্তপু®প, সর্ষপ, ললনাপ্রিয়, সুরভি, মেঘাগমপ্রিয়, মঞ্জুকেশিনী, কর্ণপূরক, পুলকি, সিন্ধুপু®প ইত্যাদি। কদম বর্ণে, গন্ধে, সৌন্দর্যে এদেশের ফুল গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ফুলের বাহার যতই থাক, কদমের দারুমূল্য তেমন নেই। দ্রুত বেড়ে উঠলেও এর কাঠ নরম। ও দিয়ে মূল্যবান আসবাব হয় না। কদম ফুলের রয়েছে নানা উপকারিতা। তথ্যমতে জানা যায় কদম গাছের বাকল জ্বরে উপকারী, পাতার রস ছোদের কৃমিতে ব্যবহার্য। বাকল ও পাতা ব্যথানাশক। মুখের ঘায়েও পাতার রস কার্যকরী। কদম গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি হয় দিয়াশলাই।
কদম ফুলকে বলা হয় ঋতুর বাহক, প্রকৃতির হাসি। প্রকৃতির এই সাজ ও হাসিকে অব্যাহত রাখার জন্যই ঋতুতে ঋতুতে দেখা যায় চেনা অচেনা অসংখ্য ফুলের সমারোহ। এমনই একটি ঐতিহ্যবাহী বন ফুল হচ্ছে কদম ফুল। মোহনীয় গন্ধে ভরপুর এই কদম ফুলকে ঘিরে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য ছড়া, কবিতা গান ও উপন্যাস। বাঙ্গালী ও কদমফুল একই সূত্রে গাঁথা। বর্তমানে এই ফুল গাছটি প্রকৃতি থেকে একরকম বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। আগের মত যেখানে সেখানে দেখা যায়না এই অপরুপ সৌন্দর্যের প্রতীক কদম ফুল গাছ। যান্ত্রিক সভ্যতা ও নগরায়ণের যুগে মানুষ সামান্য প্রয়োজনেই কদমকে তুচ্ছ গাছ মনে করে কেটে ফেলছে। অন্যান্য গাছের মতো যতœ করে এখন আর কেউ এ গাছ রোপণ করে না। কোথাও অযতœ-অবহেলায় বেড়ে উঠে দু’একটি গাছ। শোভা বর্ধনের পাশাপাশি এই ফুলের রয়েছে অনেক ভেষজ এবং অর্থনৈতিক গুনাগুণ।
কদম ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম: অহঃযড়পবঢ়যধষঁং রহফরপঁং. আদি নিবাস ভারতের উষ্ণ অঞ্চল, চীন ও মালয়ে। কদম গাছের পাতা লম্বা, উজ্জ্বল সবুজ ও চকচকে। বসন্তের শুরুতে গাছে নতুন পাতা গজায় এবং শীতে গাছের পাতা ঝরে যায়। কদম ফুল গোলাকার। পুরো ফুলটিকে একটি ফুল মনে হলেও এটি আসলে অসংখ্য ফুলের গুচ্ছ। এ ফুলের ভেতরে রয়েছে মাংসল পু®পাধার, যাতে হলুদ রঙের ফানেলের মতো পাপড়িগুলো আটকে থাকে। পাপড়ির মাথায় থাকে সাদা রঙের পরাগদন্ড। ফল মাংসল, টক এবং বাদুড় ও কাঠবিড়ালির প্রিয় খাদ্য। ওরাই বীজ ছড়ানোর বাহন।
মন্তব্য করুন