শ্রীমঙ্গল প্রাথমিক শিক্ষা: শিশু শ্রেণির শিক্ষা উপকরন নিয়ে বাণিজ্য, শিক্ষকদের স্কুল ফাঁকির প্রবণতা, নাম মাত্র
সাইফুল ইসলাম॥ শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ নিয়ে শিক্ষক সমিতির নেতার বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের স্কুল ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় কমলমতি শিশুদের লেখাপড়ার মান ক্রমশ নিম্নমুখি হচ্ছে। এছাড়া উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষকরা পাঠদান করছেন ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা। পাঠ দানে ভাল হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান ঠেকানো শিক্ষকদের স্কুল ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা নাম মাত্র পাঠদানে ভাল হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়ার মান হিন্দু শিক্ষকরা পাঠদান করছেন ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা।
৭ মার্চ মঙ্গলবার ও বুধবার সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
বুধবার ১ মার্চ বেলা দুইটায় বরুনা ফয়জুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি ‘খ’ শাখায় গিয়ে দেখা যায় সহকারি শিক্ষিকা অষ্টমী দেব ১৬ জন ছাত্র ছাত্রীকে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার ওযুর চারটি ফরজ বোর্ডে লিখে পাঠদান করাচ্ছেন। পাশের কক্ষে সহকারী শিক্ষিকা সীতা রাণী রায় তৃতীয় শ্রেণির ‘ক’ শাখার ১৪ জন ছাত্র ছাত্রীকে একই বিষয়ে পাঠদান করছেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুশান্ত কুমার পালকে সঙ্গে নিয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে গিয়ে দেখা যায় সহকারী শিক্ষকা শেলী রাণী দেব ২৭ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে ইসলাম শিক্ষার ২য় অধ্যায় ইবাদত সম্পর্কে পাঠদান করাচ্ছেন। ৫ম শ্রেণিতে গিয়ে দেখা যায় সহকারী শিক্ষিকা দিপা পাল ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার সালাতের আরকান সম্পর্কে পাঠদান নিচ্ছেন। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের অনেকের কাছে জুপিটার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ২০১৭ গাইড বই দেখা যায়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুশান্ত কুমার পাল বলেন, অনেকদিন যাবত এ বিদ্যালয়ে মুসলিম শিক্ষক নেই। নয়নশ্রী ও মনারগাও স্কুলেও মুসলিম শিক্ষক নেই। সেকারণে হিন্দু শিক্ষকরা ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা পাঠদান করাতে হচ্ছে। বিকেল ৩ টার দিকে উত্তর বরুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সহকারি শিক্ষক রজত কান্তি দেব ৫ম শ্রেণির ৫২ জন শিক্ষার্থীকে সাধারণ গণিত শিক্ষা পাঠ দান করাচ্ছেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অঞ্জন দেবকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করে ওই শ্রেণির ২ নাম্বার ছাত্রী তানিয়া আক্তারকে ক্লাস ফাইভ ইরেজীতে লিখতে বললে সে পষধংং ভৎরাব লিখে। এ শ্রেণির মোট ৭৭জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৭ জন উপস্থিত ছিল। এরপর তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী নাদিয়া আক্তারকে (রোল নং ১) ক্লাস টু ইংরেজিতে লিখতে বললে সে বানান ভুল করে পষৎংঃ ঞড়ি লিখে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এ শ্রেণির কোনও শিক্ষার্থীই ইরেজীতে পষধংং লিখতে পারেনি। একই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজন আহমেদকে ক্লাস থ্রি ইংরেজিতে লিখতে বলা হলে সে লিখতে পারেনি। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক অঞ্জন দেব বলেন, তিনি ক্লাস টিচারকে এ বিষয়ে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসবেন।
২৮ ফ্রেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দুপুর ২টা ২২ মিনিটে শহরের চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, এ বিদ্যালয়টির মোট ১৭ জন শিক্ষককের মধ্যে প্রধান শিক্ষক জহর তরফদার বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। আর সহকারি শিক্ষিকা সুমা রাণী পাল ও রাবেয়া বেগম আছেন ক্যাজুয়েল লিভে। বিষয়টি জেনে সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আলী দ্রুত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে দেখেন প্রধান শিক্ষক জহর তরফদার বিদ্যালয়ে উপস্থিত নেই। শিক্ষক হাজিরা খাতায় ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি এ দু’দিনের স্বাক্ষরও নেই। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘২টা ২২ মিনিটে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখি প্রধান শিক্ষক উপস্থিত নেই। শিক্ষক হাজিরা খাতায় দেখি দুইদিন ধরে প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর নেই। এ বিষয়টি আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব’।
এদিকে চন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন সময়ে এ প্রতিবেদকের কাছে সংবাদ আসে শহরের দেওয়ান শামসুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল থেকে দিনভর প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষা উপকরণ শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে বিদ্যালয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। এর সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, ওই বিদ্যালয়টির একটি কক্ষে মাধবপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবশিষ্ট শিক্ষা উপকরণের মালামাল ফ্লোরে ফেলে রাখা। সেখানে উপস্থিত পাওয়া যায় বিদ্যালয়টির দপ্তরি কাম প্রহরী অনুকুল দাশকে। শিক্ষা উপকরণের মালামাল বিতরণের বিষয়ে জানতে চাইলে দপ্তরী অনুকুল বলেন, ‘ভাড়াউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী সবুজ দেব ও শিক্ষক সমিতির এক নেতা উপস্থিত থেকে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা দশ মিনিট পর্যন্ত উপজেলার ১০৮টি বিদ্যালয়ের প্রাক প্রাথমিকের (শিশু শ্রেণি) শিক্ষা উপকরণ মালামাল বিতরণ করেন। শিক্ষা উপকরণের মালামাল এ বিদ্যালয় থেকে বিতরণ করা হচ্ছে কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে অনুকুল বলেন, ‘গত বার জহর স্যারের চন্দ্রনাথ বিদ্যালয় থেকে শিশুদের এ উপকরণ দেওয়া হয়। এবার ওই স্কুলে জায়গার সমস্যার কারণে আমাদের স্কুল থেকে দেওয়া হয়েছে’। এ মালামাল বিতরণের সাথে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জড়িত না বলেও জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে বিদ্যালয় গুলোতে শিশু শ্রেণির জন্য খেলাধুলার উপকরণ কেনার জন্য ৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। এ টাকা থেকে ৩০০ টাকা ভ্যাট কেটে মোট ৪৭০০ টাকা অবশিষ্ট থাকে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে গঠিত ক্রয় কমিটির মাধ্যমে নিজ নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করার কথা থাকলেও গত কয়েকবছর যাবত উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহর তরফদার প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে একটি সিন্ডেকেট গড়ে তোলে এসব শিক্ষা সামগ্রী কম দামে কিনে বিদ্যালয় গুলোতে বেশি দামে বিক্রি করে নিজের পকেট ভারী করেছেন। এমনকি তিনি নিজে পার্বন লাইব্রেরি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ উঠেছে, তিনি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি থাকার সুবাদে নানা হয়রানী ও বদলীর ভয়ে উপজেলার ১৩৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয় গুলোর শিক্ষাউপকরণ তার লাইব্রেরী থেকে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহর তরফদার তাঁর বিরোদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষা উপকরণ নিয়ে বাণিজ্য করার অভিযোগ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষাউপকরণ মালামাল ক্রয়ে দামের সাশ্রয় ও গুণগত মান ভালর জন্য আমরা সকলে মিলে যৌথভাবে অর্ডার দিয়ে মালামাল ক্রয় করে থাকি। আগ্রহী শিক্ষকদের সাথে আমি নিজেও এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলাম’। তবে এ মালামাল ক্রয়ে কোনও মুনাফা করিনি’।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিটির সভাপতি ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রনধীর কুমার দেব বলেন, শিক্ষা উপকরণ নিয়ে বাণিজ্যের ঘটনায় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ডেকে এনে এ বিষয়ে যথাযথ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। একই কথা বলেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মোবাশশেরুল ইসলাম।
এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, ‘প্রাক-প্রাথমিকের উপকরণ নিয়ে বাণিজ্য, বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি ও সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার লেখা পড়ার মান নি¤œমুখির বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নিব।
মন্তব্য করুন