ষাটের দশকের বিশিষ্ট সাংবাদিক- বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ- বীর মুক্তিযোদ্ধা গজনফর আলী চৌধুরীঃ আজীবন লড়াকু এক সৈনিকের শেষ বিদায়ঃ স্মরন।

May 14, 2018,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ মহাপবিত্র ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক আদমে আওলাদ-আশরাফুল মকলুকাত-মানবজাতির মৃত্যো অবধারিত। শ^াস্বত সত্য। ক্ষনস্থায়ী- রং এর এই দুনিয়া মুসাফির খানা। কবি ও দার্শনিক শেখ সাদীর ভাষায় -“জানে হগা জরুর-কোয়ি আগে-কোয়ি পিছে-”। মৃত্যো প্রসঙ্গে আসমানী কিতাব আল কোরআনে আল্লাহ পাক সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষনা করেন -“কুল্লিন নাফসীন জ্যায়িকাতুল মউত”- জগতের সকল প্রাণীকেই একদিন মৃত্যোর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। মৃত্যুর মুখোমুখী হতে হবে। মৃত্যোকে আলিঙ্গঁন করতে হবে। কর্ম্মবীর গজনফর আলী চৌধূরীও মৃত্যোকে আলিঙ্গঁন করে আমাদের কাছ থেকে চীর বিদায় নিলেন চীর তরে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অসুস্থ বয়োঃ বৃদ্ধ সত্তরোর্ধ গজনফর আলী চৌধুরীর মৃত্যো অকাল ও আকস্মিক না হলেও জেলা সদরে তাঁর মৃত্যো সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেঁ সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। স্থানীয় চ্যেনেল এম.সি.এন এর কর্নধার জেলা পরিষদ এর সদস্য প্যানেল চেয়ারম্যান ¯েœহ ভাজন হাসান আহমদ জাবেদ এক্ষেত্রে ধন্যবাদ পাবার হকদার। জীবন-মৃত্যো-জানাজা সংক্রান্ত মানবিক-প্রাসঙ্গিঁক সংবাদ সমূহ এম.সি.এন ব্রেকিং নিউজের মাধ্যমে প্রচারে সচেতন নাগরিক সমাজের প্রশংসা প্রাপ্ত হচ্ছেন। মোবাইল ফোনও এম.সি.এন এর মাধ্যমে এই শোক সংবাদটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

বিশে এপ্রিল শুক্রবার ছিল আমার মরহুম পিতার মৃত্যো বার্ষিকী। পিতা-মাতা-চাচা-চাচি কেউ ই বেঁচে নেই। আমার নিজেরই এখন পড়ন্ত বেলা জীবন সায়াহ্নে। সত্তোর পেরিয়ে গাড়ী চলে না-চলে না রে অবস্থা। পঁচাত্তোর উত্তর রাজনৈতিক সংকট-খন্দকার মুশতাক আহমদ এর দূঃ শাসনামলে দেশে একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অশান্তি বিদ্যমান ছিল। আমি তখন সক্রিয় রাজনীতিতে মহাব্যস্থ। তখন দেশীয় রাজনীতির প্রধান বিরোধী দল জাসদের প্রথম কাতারের প্রভাবশালী নেতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও বটে। খুনী মুশতাক চক্রের ধরপাকড়-ঝুলুম-নির্য্যাতন এড়িয়ে আধা আন্ডার গ্রাউন্ড- আধা স্বাভাবিকজীবন যাপন করছি। এমতাবস্থায় বাবা বিলেতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘাতক ব্যাধি কেন্সারে মৃত্যো বরন করেছিলেন। তাঁর শেষ সময় অসুস্থতা এবং মৃত্যো পরবর্তী কালেও প্রথম পুত্র হিসাবে কোন দায়িত্ব পালনই করতে পারিনি। এই দূঃখ ও বেদনাবোধ আমাকে এখনও পীড়া দেয়। হয়ত আজীবন অমনি তাড়িয়ে বেড়াবে। আমাদের গ্রামের বাড়ি রসুলপুর মিয়ার বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানে চীর শয়ানে শায়িত আমার প্রিয় পিতা। প্রত্যেক বৎসর বাবার মৃত্যো বার্ষিকীতে কোরআন খতম, মিলাদ মাহফিল শিরনীর আয়োজনে আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়না। বাড়িতে আকলিছ মিয়া চাচারা আছেন। তারাই এন্তেজাম করেন, আমি শুধু সময়মত শরীক হই মাত্র। সেদিন শুক্রবার রসুলপুর জামে মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় শেষে মিলাদ শিরনী বিতরন ও কবর জিয়ারত শেষে গ্রামীন আত্বীয় স্বজন এবং হাফেজ ইমাম সাহেবানদের সঙ্গেঁ সৌজন্য আলোচনা শেষে আমার সদ্য খোলা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। জেলা বারের সাধারন সম্পাদক বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট মিজানুর রহমানই দূঃসংবাদটি দিলেন গজনফর ভাই আর নেই। অদ্য বাদ জুম্মা তিনি ইন্তেকাল করেছেন। দূ-সংবাদটি শুনে গভীর মর্ম বেদনার সঙ্গেঁ উচ্চারন করলাম- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর মৃত্যো আকস্মিক কিংবা অকাল মৃত্যোও নয়, বরং বলা চলে তাঁর মৃত্যো সময়ের ব্যাপার মাত্র, কারন তিনি সম্প্রতি হৃদরোগ সহ বিভিন্ন জটিল, কঠিন ও দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভূগছিলেন। বিশেষতঃ তাঁর হার্টের অবস্থা ছিল খুবই ঝুকিপূর্ন। মহান আল্লাহর অপার রহমত এবং মনের জোরে এই বার্ধ্যক্যেও তিনি দেশে-বিদেশে চলাফেরা করেছেন। সামাজিক রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এই ক-মাস আগে আমি এবং দৈনিক মৌমাছি কন্ঠের সম্পাদক তাঁর ও আমার প্রিয় নাতি শেখ সিরাজুল ইসলাম তাঁকে বিদায় জানিয়ে ছিলাম। সুদুর আমেরিকা থেকেও তিনি আমাকে ফোন করে কুশল জানতেন। খোঁজ খবর নিতেন। জেলা বারের সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট রমাকান্ত দাশ গুপ্ত ও সিলেট থেকে মোবাইল মারফত গজনফর ভাইর আকস্মিক মৃত্যো সংবাদটি জানালেন, বল্লেন তিনি সিলেট থেকে রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমি ও আর কাল বিলম্ব না করে বাড়ি থেকে তাঁর ও আমার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

সৈয়দ শাহ মোস্তফা সড়কস্থ তাঁর বাসায় এসে ঢুকলাম। একশোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে আইনজীবী-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ সহ গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ এসেগেছেন। উত্তর ছিরানা হয়ে চোখ বুজে চীর শয়ানে শায়িত শুভ্র শম্ভ্র মন্ডিত কর্ম্মবীর গজনফর আলী চৌধুরী। আমাদের প্রজন্মের শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় গজনফর ভাই। তাঁর লাশের পাশে বসে মৌলানা সাহেবানগন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া দুরুদ করছেন। পরদিন শনিবার সকাল এগারোটায় স্থানীয় টাউন ঈদগাহ ময়দানে তাঁর নামাজে জানাজা।

একুশে এপ্রিল শনিবার সকাল এগারোটায় টাউন ঈদগাহে প্রকৃতিক গোলযোগকে উপেক্ষা করে সমাজের বিপুল সংখ্যক গন্যমান্য নাগরিক উপস্থিত হয়েছেন। ইতিপূর্বে মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব, সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠ সংলগ্ন শহীদ মিনার, তাঁর নিজের প্রতিষ্টিত জুলিয়া শপিং সিটি এবং গ্রামের বাড়ী বেকামুড়া এলাকায় তাঁর লাশের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়, রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। জানাজার পূর্বেও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংষদের পক্ষ থেকে পুস্পস্থবক ও শ্রদ্ধা শেষে একজন বীর মুক্তি যোদ্ধা হিসাবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা প্রশাসন এবং সদরস্থ মডেল থানা পুলিশ আন্তরিকতার সাথে প্রাসঙ্গিঁক দায়িত্ব পালন করেন। জানাজা পূর্ব মুছল্লি সমাবেশে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক এবং দায়িত্ব প্রাপ্ত জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মোঃ তোফায়েল ইসলাম এবং ঐক্য ন্যেপ এর কেন্দ্রীয় নেতা সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও গন্যমান্য নাগরিকগন। 

মরহুমের জানাজার নামাজ, মোনাজাত শেষে তাকে হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র)-র দরগা শরীফস্থ কবর স্থানে তাঁকে শেষ শয়ানে শায়িত করা হয়। আমরা তাঁর গুনগ্রাহীগন পহেলা জিয়ারত শেষে দরগা মহল্লা এলাকা ত্যাগ করি। আজকাল কিছু অতিবুঝদারগন জানাজার নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত এবং কবর জিয়ারত করতে নেতিবাচক মনোভাব পোষন করেন। প্রবীন রাজনীতিবিদ গজনফর আলী চৌধুরী মৃত্যোকালে স্ত্রী, সাবেক মহিলা এম.পি সৈয়দা হাসনা বেগম, পুত্র, কন্যা, পুত্র বধু, ভাই, বন্ধু, আত্বীয় স্বজন রেখে গেছেন। মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি।

অগ্রজ প্রতীম মরহুম গজনফর আলী চৌধুরীর সঙ্গেঁ আমার পরিচয় ও সম্পর্ক সেই ষাটের দশকের শুরু থেকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। তাঁর সঙ্গেঁ আমার সেই সম্পর্ক আজীবন বহাল ছিল। বরং বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গেঁ সঙ্গেঁ ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দিন দিন মজবুত হয়েছে। তিনি আমার বয়োঃজৈষ্ট ছিলেন। আমাদের কালে একদিনের বয়োঃজৈষ্টকে আমরা মুরব্বি মানতাম। তখন এখনকার মত মূল্যবোধের এত অবক্ষয়, ভ্রষ্টাচার, বানিজ্যায়ন, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ছিলনা। রাজনীতিগত ভাবে তিনি ছিলেন বাম প্রগতিশীল আমি ডান কিংবা মধ্যপন্থী। তিনি ছিলেন তৎকালীন বিশাল ব্যাপক ও বিস্তৃত ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের এতদাঞলীয় অন্যতম প্রতিষ্টাতা। বলিষ্ট সংঘঠক ও সুবক্তা। ঐ সময় বাম প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের আরও দুইজন নেতা ছিলেন শ্রদ্ধেও সৈয়দ মতিউর রহমান এবং শ্রদ্ধেও শফকতুল ওয়াহেদ। তাঁরা দুইজনও এখন পরলোকে। এই তিন তারকার দাপটে ও প্রভাবে ছাত্র ইউনিয়ন শক্তিশালী সংঘঠন ছিল। আন্দোলনে সংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্ম্মিদের বলিষ্ট ভূমিকা ছিল। ঐ দশকে সামরীক স্বৈর শাসক স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে সংগ্রামী ছাত্র সমাজকেই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে হয়েছে। তখন এবডো, প্রডো, পি.পি.আর, জাতীয় নিবর্তন মূলক আইনের কারনে রাজনৈতিক সংঘঠন সমূহ বিকষিত হতে পারেনি। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আপোষহীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কে (তখনও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রাপ্ত হননি) পাক সামরীক জান্টা বার বার কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। সর্ব শেষ তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহ আগঢ়তলা ষঢ়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী করে কারাগারে আটক করে রাখে। ঐ সময় হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন, উনসত্তোর সালে ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক এগারো দফর ছাত্র গন আন্দোলন এবং গনঅভ্যুত্থানে সংগ্রামী ছাত্র সমাজকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। এসব আন্দোলনের আপোষহীন ও নির্ভিক নেতা ছিলেন তৎকালীন ছাত্র নেতা গজনফর আলী চৌধুরী।

এসব আন্দোলন-সংগ্রামের কথা ও কাহিনী আমার শুনা কথা নয়,  আমার দেখা বিষয়। কারন আমিও ঐসব আন্দোলনের একজন কর্মি সংঘঠক ছিলাম। স্থানীয় ভাবে সে সময় ছাত্রলীগ প্রতিষ্টা ও কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিলেন মোহাম্মদ ফিরোজ (বর্তমানে জেলা আওয়ামীলীগের প্রবীন নেতা ও জাতীয় পরিষদ সদস্য) আমার সহপাঠি বন্ধুদ্বয় আজিজুল হক ইকবাল (দীর্ঘ কালীন সহ-সভাপতি, জেলা আওয়ামীলীগ, প্রবীন প্রধান শিক্ষক কা-আ-উচ্চ বিদ্যালয়, বর্তমানে পরলোকে) গিয়াস উদ্দিন আহমদ (কুলাউড়ার কৃতি সন্তান, জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা) প্রমুখ। আমি ঐ দশকে প্রথমে মৌলভীবাজার মহাবিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সংঘঠক হিসাবে তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে-সংগ্রামে কাজ করার সুযোগ পাই। তিনি তার দলীয় আদর্শের প্রতি আজীবন আনুগত্য পোষন করতঃ যখন যেখানে থেকেছেন সেখানে কাজ করেছেন। সর্ব্বশেষ ঐক্যনাপ কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। রাজনীতিবিদ গজনফর আলী চৌধুরী নিখাদ বাম ভাবাদর্শের অনুসারী- সাম্যবাদী চিন্তা চেতনার মুক্ত মনের মুক্ত মানুষ হলেও পরমতের প্রতি তাঁর সম্মান ও সহিঞ্চুতা ছিল। তাঁর সঙ্গেঁ রাজনীতিতে ভিন্ন মতাবলম্বি হয়ে আদর্শিক মতপার্থক্য থাকলেও মনোমালিন্য ঝগড়া বিবাদ হয়নি। বরং বয়োজৈষ্ট হিসাবে তিনি আমাকে খুবই ¯েœহ করতেন। আমাদের বাসা ছিল পাশাপাশি একে অন্যের নিকট প্রতিবেশি। গ্রামগত ভাবে একই ইউনিয়ন- পাঁচ নম্বর আখাইলকুরার আদি অধিবাসি। তিনি বেকামুড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরীর বাড়ির কৃতি সন্তান। মাতৃকূলের দিক দিয়ে তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী খান্দানী পরিবারের কৃতি কন্যার গর্ভজাত সু-সন্তান। পিতৃ-মাতৃ উভয় কূলের দিক দিয়ে খান্দানী ঐতিহ্যবাহী অভিজাত পরিবারের সু-সন্তান হিসাবে তার কোন অহংকার কিংবা অহংবোধ ছিলনা, বরং তিনি ছিলেন নিরহংকারী একজন সহজ সরল সাদা মনের মানুষ। তাঁর সঙ্গেঁ আমার অনেক উজ্জল স্মৃতি জড়িত। তিনি স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বাধীন পেশা হিসাবে আইন ব্যবসায় যোগদান করতঃ একজন আইনজীবী হিসাবে প্রচুর নামডাক খ্যাতি অর্জন করেন। আমি জেলা বারের দু মেয়াদে সম্পাদক এবং চার বার সভাপতি নির্ব্বাচিত হয়েছিলাম, অবশ্য এক মেয়াদে বিনা প্রতিদ্ধন্ধীতায়। আমার প্রত্যেক নির্ব্বাচনে তিনি প্রকাশ্য সমর্থক সংঘঠক ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাস জীবনেও কথা ও কাজের মানুষ গজনফর আলী চৌধুরী একজন কমিউনিটি লিডার হিসাবে প্রবাসীগনকে সর্ব বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা-সহায়তা করেছেন মর্মে প্রবাসী নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন। আমাদের আত্বীয় স্বজন ও কমিউনিটি লিডারদের কাছ থেকে এ সংবাদ জানা গেছে। সাংবাদিক আইনজীবী হিসাবে যেমন গজনফর আলী চৌধুরী সাফল্য প্রদর্শন করেছেন ঠিক তেমনি ব্যবসায়ী হিসাবেও তিনি দেশে বিদেশে নাম ডাক কুড়িয়ে ছিলেন। চৌমুহনাস্থ দৃষ্টি নন্দন স্থাপনার জুলিয়া শপিং সিটি তাঁর স্বপ্নের ফল ও ফসল। জুলিয়া শপিং সিটির শুরুতে তাঁর অফিসের পাশে আমার নৈশ কালীন চেম্বারের জন্য ছোট একটি কক্ষ বরাদ্দ করলেন। এই ভবনেই দৈনিক মৌমাছি কন্ঠের দপ্তর হল। মৌমাছির মালিক সম্পাদক প্রেস ক্লাবের নির্ব্বাচিত সহ সম্পাদক শেখ সিরাজের মুজিব ভাই থেকে দাদা ভাই হলাম। প্রত্যহ সন্ধ্যা গজনফর ভাইর অফিস, আমার চেম্বার এবং মৌমাছি কন্ঠের দপ্তরে আসর বসত। সর গরম থাকত। ক-বছর আগে তার প্রবাসি পুত্রের বিবাহে হৈ হৈ কান্ড রই রই ব্যাপার পড়ল। কনে পক্ষ আমার পূর্ব পরিচিত। দামান্দ নিয়ে বরযাত্রা গেলাম। বিয়ে খেলাম। আনন্দ ফূর্তি করলাম। পুত্রের বিবাহোত্তর বৌ-বাত সাদিয়া সেন্টারে। ছেলেটা অসুস্থ -ডাই রিয়েল ডিজিজ-সম্ভবত: ফুড পয়জনিং। ভাই-ভাবির মন স্বাভাবিক ভাবেই খারাপ। আমাকে বৌ-ভাতের দেকভালের গুরু দায়িত্ব দিলেন। আমি হাসি মুখে সেই গুরু দায়িত্ব নিলাম। আমার বয়স হয়ে গেলেও যখন যে কাজের দায়িত্ব নেই-পাই-আল্লাহ দেন-সে দায়িত্ব খালিছ নিয়তে আন্তরিকতার সাথে পালনের চেষ্টা করি। তাছাড়া জেলাবারের তরুন আইনজীবী, প্রেসক্লাবের নও যোয়ান সাংবাদিক-সর্ব্বোপরি দায়িত্ববান রাজনীতীবিদ- সুশীল সামাজ-ত আছেন-ই। আমি তার এবং আমার প্রিয় কলিগ এডভোকেট হাবিবুর রহমান মুকুলকে নিয়ে সাদিয়া সেন্টারে দায়িত্ব পালন করলাম। বিকেলের দিকে এলেন দেশের প্রবীন রাজনীতিবিদ-বীর মুক্তিযোদ্ধা ঐক্যন্যাপ প্রধান পংকজ ভট্টাচার্য্য। আমি নিজে তাকে স্বাগত জানিয়ে আপ্যায়নে দেকভাল নয় পরিবেশনের দায়িত্ব পালন করলাম। এ প্রজন্মের নবীন সাংবাদিকগনকে ষাটের দশকের তারকা ছাত্র রাজনীতিবিদ সুদর্শন ও সুবক্তা পংকজ ভট্টাচার্য্যরে সঙ্গেঁ পরিচয় করিয়ে দিলাম। আমাদের সেবা-সম্মানে খুবই খুশী হলেন ঢাকা থেকে আগত অতিথি বাবু পংকজ ভট্টাচার্য্য। খুশী মনে বল্লেন তোমাদের সিলেটীদের আথিতেয়তা-আন্তরিকতা তুলনাহীন। ছেলের পিতা-মাতা গজনফর আলী চৌধুরী-সৈয়দা হাসনা বেগম খুবই খুশী হলেন। আমাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। বৌভাতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন এন.আর.বি.সি.এর তৎকালীন চেয়ারম্যান রাজনগরের অধিবাসি ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী। অগ্রজ প্রতিম গজনফর আলী চৌধুরী আমার পারিবারিক শুভাকাংখী হিসাবে আমার একমাত্র জামাতা মুহিবুর রহমান রুমির ব্যাংক এ চাকুরির জন্য একান্তই উৎসাহী ও শুভাকাংখী ছিলেন। রুমি বানিজ্যে মাষ্টার্স। সাউথইষ্ট ব্যাংক এ দশবৎসর অফিসার হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা। ইতিপূর্বে চাকরি ছেড়ে এম.বি.বি.এ. পড়াতে লন্ডন চলে গিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীর চাকুরী হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করতেন। ফরাছত আলী সাহেব তাঁর খুবই ঘনিষ্ট ও কনিষ্ট। ইতিপূর্বে তার কথায় এন.আর.বি.সি ব্যাংক এ আবেদন করা হলেও আমাকে এবং রুমীকে ব্যাংক চেয়ারম্যান ও এম.ডি দেওয়ান মুজিবুর রহমান সাহেব একাধিক দিন ঘুরিয়েছেন। ব্যাংকের তৎকালীন অতিঃ এম.ডি. আমাদের শহরের এ.এস.এম বুলবুল আমার বাসায় বেড়াতে এলেন। ঘন্টা কয়েক গল্পের পর বল্লেন ব্যাংক এ অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত লোক দরকার রুমীর চাকরী বলতে গেলে হয়েই গেছে। শুধুমাত্র ব্যাংক চেয়ারম্যান সাহেবকে একটু ম্যানেজ করতে হবে। সেই মর্মে অগ্রজ প্রতিম গজনফর ভাই চেয়ারম্যান ফরাছত আলী সাহেবকে একাধিক বার ফোন মারফত অনুরোধ করলেন। আমার অনুরোধে তৎকালীন সমাজকল্যান মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী একাত্তোরে প্রিয় সহযোদ্ধার জামাতা হিসাবে সুপারিশ করেছিলেন। মাননীয় মন্ত্রীর সুপারিশে নাখোশ হয়ে ছিলেন এন.আর.বি.সি কর্তৃপক্ষ। এই আমি সংবাদটি সৈয়দ মহসীন আলীকে জানালে তাদের কি গর্দিস হত আল্লাহই জানেন। আমি ঝামেলা-ঝগড়া-বিবাদ পসন্দ করিনা বলে কাউকেই বলিনি। জানাইনি। ঢাকাতে বসবাস রত আমার অগ্রজ প্রতিম কাজি ফারুকুজ্জামান আহমদ ও আমার একজন পারিবারিক সুহৃদ ও গুরুজন। তাঁকেও হাটিয়েছেন তারা। শেষ তক এডি.এম.ডি.এ.এস.এম বুলবুল ফারুক ভাইর ফোনই রিসিভ করতেন না। অথছ ফারুক ভাইও রাস্থার মানুষ নন। তার পিতা আমার শ্রদ্ধেও শিক্ষাগুরু মৌলানা কাজি মোফাজ্জল হোসেন বৃটিশ ভারতে করিমগঞ্জের এম.এল.এ. ছিলেন। তাঁর জৈষ্ট ভ্রাতা ডক্টর কাজি খলীকুজ্জামান আহমদ একুশে পদক প্রাপ্য দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ এবং পল্লীকর্ম্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন-পি.কে.এস.এফ এর সম্মানিত চেয়ারপার্সন। এন.আর.বি.সি কর্তৃপক্ষ অসুস্থ বয়োঃবৃদ্ধ কাজি ফারুক ভাইকে অনেকদিন ঘুরিয়েছে। অবশেষে দাপুটে ও ডাক সাইটে অতিরিক্ত এম.ডি মিঃ এ.এস.এম বুলবুল ব্যাংক থেকে লাপাত্তা। তাঁর মামা জেলার সাবেক পি.পি. এডভোকেট মির্জা সিরাজ উদ্দিন বেগ সাহেব মারফত জানা গেল তিনি নিজেও তাঁর খুজ পাচ্ছেন না। খুজ খবর নিয়ে দেখা গেল মিডিয়া মারফত জানা গেল এন.আর.বি.সি ফার্মার্স ইত্যাদি নুতন বেসরকারি ব্যাংক ভূয়া কাগজাত ও ঋনের নামে অনিয়ম ও টাকা লুন্ঠন করছেন। চাকরি দেবার নাম করে নিয়োগ বানিজ্য করছেন। এন.আর.বি.সি- এর অনিয়ম লুন্ঠনের অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংক কড়া আইনী ব্যবস্থা নিয়েছেন- চেয়ারম্যান-এম.ডি অপসারিত হয়েছেন। এম.ডি সাহেব মহামান্য উচ্চ আদালতে আইনী লড়াইয়ে হেরেছেন। ঘুষ, দূর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন গজনফর ভাই। তার পুত্রের বৌভাতে সাদিয়া সেন্টারে এসেছিলেন ব্যাংক এর তৎকালীন চেয়ারম্যান মিঃ ফরাছত আলী। প্রকাশ্য-দিবালোকে-জনসম্মুখে সাদিয়া সেন্টারে যেকড়া ভাষায় কথা বল্লেন গজনফর ভাই তা চিন্তাই করা যায়না। রাগান্বিত হয়ে উচ্চ কন্ঠে সৎ মানুষ গজনফর আলী চৌধুরী সেদিন উচ্চারন করেছিলেন- ফরাছত মুজিবের দামান্দের চাকরি এখনও কেন হয়নি। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে চাকরি হবে। শুনলাম তোমরা নাকি ঘুষ খেয়ে চাকরি দিচ্ছ। কত টাকা চাই তোমার?  দশ লাখ ? আমি দেব দশ লাখ। এপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে দিও। গজনফর ভাই রাগান্বিত হয়ে আরো কিছু বলতে গেলে আমি নিষেধ দেই। বলি-চাকরির প্রয়োজন নেই, আপনার শরীর খারাপ, হার্টের অবস্থা ভালো নয়, আবেগ উত্তেজনা- দুটিই পরিহার করা উচিত। তাঁর সত্য কথনের বলিষ্টতা সৎ সাহস এবং আমার পরিবারের প্রতি তার মমত্ববোধ দেখে অনেকেই খুশী হলেন- আমি আবেগ আপ্লুত হলাম। তাঁর নব বিবাহিত পুত্রের আকস্মিক ও অকাল মৃত্যোতে তিনি খুবই মনোঃ কষ্ট পেয়েছিলেন, আমার গলা জড়িয়ে শিশুর মত হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। আমি তাঁর ছেলের সুস্থতা কামনায় আমাদের জেলা জামে মসজিদে একািধকবার দোয়া করিয়েছি। তিনি আমাকে প্রায়ই কৃতজ্ঞতা জানাতেন। তাঁর মধ্যে একটি কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল।

 কর্ম্মই জীবন- এই জীবন ঘনিষ্ট স্লোগানের সমর্থক ছিলেন কর্ম্মবীর গজনফর আলী চৌধুরী। একজন লড়াকু সৈনিক হিসাবে তিনি আজীবন আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন-বয়স্ক ও অসুস্থতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর চলে যাবার পর সমাহিত হবার পরও তিনি সম্মানিত হচ্ছেন। রবিবার মাননীয় জেলা জজ শেখ আবু তাহেরের সভাপতিতেত্ব জেলা বার সম্পাদক এডভোকেট মিজানুর রহমানের পরিচালনায় অনুষ্টিত হয় ফুল কোর্ট রেফারেন্স। আদালতের বিচারিক কার্য্যক্রম মূলতবি ঘোষনা করেন জেলা জজ মহোদয়। একাধিক মহতি কার্য্যক্রম করেছেন মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ। র্তার মৃত্যোর পর এই প্রতিষ্টাতা সদস্যের প্রতি সম্মানার্থে প্রেসক্লাব ভবনে একটি সচিত্র শোক ব্যানার টাঙ্গিঁয়েছেন-শোক সভাও করেছেন। এই জন্য প্রেসক্লাবের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি এম.এ ছালাম এবং সম্পাদক এস.এম. উমেদ আলী, নব নির্বাচিত সভাপতি আব্দুল হামিদ মাহবুব এবং সম্পাদক সালেহ এলাহি কুটি ধন্যবাদ পাবার হকদার। সালেহ এলাহি কুটি জানালেন নির্ব্বাচনের পর তার সঙ্গেঁ সৌজন্য সাক্ষাতে যে আলোকচিত্র উঠিয়েছিলেন সেটাই গজনফর ভাইর শেষ ফটোগ্রাফ। আমার খুব ভালো লাগছে যে আমি এই প্রেস ক্লাবের দীর্ঘকাল সম্পাদক, সভাপতি ছিলাম। জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে শোক সভার আয়োজন করা হয়েছে। মিলাদ মাহফিলও হবে। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে সাদিয়া সেন্টারে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে দশই-মে, দুপুরে। বিশিষ্ট আইনজীবী ও আমার প্রিয় কলিগ এডভোকেট মাসুক মিয়া জানালেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ কমরেড সৈয়দ আবু জাফর এবং বিশিষ্ট চিকিৎসক বাবু গোপেশ রঞ্জন দাশ প্রমুখের উদ্যোগে একটি নাগরিক শোক সভার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমি তাদের মহতি উদ্যোগের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েছি, সহযোগীতার আশ^াস দিয়েছি। তাঁর বর্নাঢ্য কর্ম্ম ও জীবন দর্শন নিয়ে এক খানি স্মারক সংকলন বের করা উচিত। সমাহিতের পরও অধিকর সম্মানিত করা উচিত।

প্রবীন রাজনীতিবিদ বর্ষীয়ান সাংবাদিক, বিশিষ্ট আইনজীবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সহজ সরল সাদা মনের ধর্মপ্রাণ মানুষ অগ্রজ প্রতীম গজনফর আলী চৌধুরী আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। আছে তাঁর কর্ম্ম ও জীবন দর্শন। উজ্জল স্মৃতি। আমি তাঁর রুহের মাগফিরাত এবং শোক সন্তপ্ত পরিবার বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করছি। মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন- এই মোনাজাত করছি।

[ষাটের দশকের সংবাদিক। মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট, জজ কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com