সংবাদের সংকট
হোসাইন আহমদ॥ সংবাদকর্মীরা দেশ, সমাজ, নাগরিক, দেশের উন্নয়ন, অনিয়ম ও দুর্নীতি সহ নানা বিষয়ে প্রতিনিয়ত সংবাদ প্রকাশ করে আসছেন। এক্ষেত্রে অনেক সংবাদকর্মীকেই ঝুঁকি নিতে হয়। সকল দলের দুর্নীতিবাজ দলীয় ক্যাডার ও আমলাদের হাতে এপর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে অনেক সংবাদকর্মীকে। অনেকেই আবার মামলা ও হামলার স্বীকার হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকেই। ২০১৯ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এর আগের বছরের তুলনায় চার ধাপ নেমে ১৫০ এ দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের সমীক্ষা সূচকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১। আগের বছরের তুলনায় আমরা আরও এক ধাপ পিছিয়েছি। দুঃখজনক বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সবচেয়ে পিছিয়ে আছি। প্রতিনিয়তই বাংলাদেশে সংবাদকর্মীদের ঝুঁকি বাড়ছে। এর একমাত্র কারণ সাংবাদিকরা অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করা। এ বছরের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে দৈনিক পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল নিখোঁজ হওয়ার প্রায় দুই মাস পর গভীর রাতে বেনাপোলের রঘুনাথপুর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা ভারত থেকে ‘কথিত অবৈধভাবে প্রবেশের সময়’ তাকে আটক করে। এরপর বিজিবি তাকে অবৈধ অনপ্রবেশ আইনে মামলা দিয়ে বেনাপোল পোর্ট থানায় সোপর্দ করে। এদিকে সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় এপর্যন্ত ৭২ বার পিছিয়েছে। এভাবে শতশত ঝুঁকি নিয়েই সাংবাদিকরা দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। জীবন দিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো বিচার হয়নি।
সাংবাদিকতার একাধিক বই পড়ে, ক্লাস করে ও প্রশিক্ষণ থেকে শিখেছি বিমান আকাশে উড়লে সাধারণত এটা নিউজ নয়। বিমান দূর্ঘটনায় পড়লে এটা নিউজ হবে। প্রতিনিয়ত ট্রেন চললে এটা নিউজ নয়। ট্রেন দূর্ঘটনায় কবলিত হলে এটা নিউজ। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও ইউএনও সহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা নিয়মীত সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিতরণ, উদ্বোধন, দিবস পালন ও গতানুগতিক আলোচনা সভাকে ফলাও করে প্রকাশ করা সাংবাদিকদের মূল দায়িত্ব বলে আমি মনে করিনা। এক্ষেত্রে অনেকেই দেখে অতিরঞ্জিত করে বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসককে মানবিক জেলা প্রশাসক ও মানবিক পুলিশ সুপার সহ নানা উপাধি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছেন। কিছু কিছু সংবাদকর্মীরা সারা বছরই শুধু এধরনের নিউজ করে যাচ্ছেন। বরং যে সকল সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না তাদের গাফলতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা সাংবাদিকদের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে দেখলাম “প্রধানমন্ত্রীর হাতে লাগানো গাছে সবাইকে অবাক করে লটকন ধরেছে”। এখানে অবাক করার কি আছে? লটকন গাছে তো লটকন ধরবেই। এটা স্বাভাবিক। আম গাছে লটকন ধরলে অবাক করেছে বলা যেত। হয়তো প্রধানমন্ত্রী গাছটি লাগিয়েছেন বলে গাছটির গুরুত্ব বেড়েগেছে এটা ঠিক। প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করাও আমাদের দায়িত্ব। তবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, জেলা প্রশাসক সহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধি ও সরকারী কর্মকর্তাদের রোপনকৃত অন্যান্য গাছের কি অবস্থা এটা নিউজে তুলে আনলে আরও সুন্দর হতো। তাদের রোপনকৃত হাজার হাজার গাছ প্রতি বছর অবহেলায় মারা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ শহরের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও গোপনে গাছ কেটে বিক্রি করছেন। সরকার দলের জেলা পর্যায়ের নেতারাও রাস্তা থেকে সরকারি গাছ কেটে নেয়ার নজির রয়েছে। আমার জানামতে একজন সংসদ সদস্য প্রতি বছর সরকারি ভাবে ৫ হাজার চারা গাছ বরাদ্দ পান। এগুলো যায় কোথায়? আজ থেকে ৮/১০ বছর আগে রোপনকৃত গাছের অবস্থা কি? এগুলো নিয়ে আমরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে পারি। কিন্তু আমরা ঝুঁকি নিয়ে কিছু করতে রাজি নয়। আবার অন্য সহকর্মীর সমালোচনা করতেও আমরা পিছিয়ে নয়। যার দরুন আজকে আমাদের এ অবস্থ।
দেশ, জাতি, নাগরিক ও জেলার উন্নয়নে সাংবাদিকরা অতীতেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন আগামীতেও রাখবেন। রাষ্ট্রও সেই পরিবেশ তৈরি করে দিবে। ভালো থাকুন জেলার সকল সাংবাদিকরা। প্রতিকূল পরিবেশ সকলের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছি। সকলের জন্য শুভকামনা। আগামী দিনে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব সেই প্রত্যাশা।
লেখকঃ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন