সন্তানের সমকামীতা;ব্রিটেনে বহু বাংলাদেশী পরিবারে নীরব কান্না
মুনজের আহমদ চৌধুরী॥ ব্রিটেনে কোন মুসলমানের সধ্যে প্রথম সমকামী বিয়েটি নিবন্ধিত হয়েছে সম্প্রতি। সেটি এক বাংলাদেশী তরুনের। ২৪ বছর বয়সের তরুন,সিলেট শহরের অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারের তরুন জাহেদ চৌধুরী বাস করেন ডার্লিংটনে। আমাদের অনেক পাঠকের জন্যই ব্রিটেনের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খররটি নিয়ে আগ্রহ এখানেই শেষ হওয়ার কথা। যদি না জাহেদ তার নতুন বৈবাহিক সঙ্গীকে নিয়ে স্পেনে হলিডে কাটিয়ে ফেরার পর ডার্লিংটনে বড় পার্টির ঘোষনা দিয়ে ই থামতেন। যদি না জাহেদ না বলতেন,তিনি সবাইকে নিজের পরিচয়ে জানান দিতে চান, “তিনি একজন গে এবং একই সাথে একজন মুসলমানও”।
ছেলেবেলায় নিজের ভাই বোন যখন ফুটবলে মাতোয়ারা,তখন নিজের আগ্রহ ছিল টিভিতে ফ্যাশন শো দেখতে। এটুকু জানিয়ে ছেলেবেলায় গে হিসেবে পরিবার,সমাজ,বন্ধুবান্ধব এমনকি স্কুলেও নিগ্রহের শিকার হবার বিবরন দিয়েছেন জাহেদ।
দুই.
ব্রিটেনের বাংলাদেশী বহু পরিবারে এখন অশান্তির নতুন উপসর্গ হিসেবে আভিভূর্ত হয়েছে সন্তানের সমকামীতা।
সন্তানের সমকামী আচরন আগেও যে ব্রিটেনে বাংলাদেশী পরিবারে অশান্তির কারন হয় নি,তা নয় কিন্তু। তবে আগের প্রজন্মে তা ছিল অনেকটা আড়ালে-আবডালে। আগের প্রজন্মে সংখ্যায় ছিল তা বহুগুন কম। মাত্র কিছুদিন
দিন আগেও তা ছিল ‘গোপন’ সম্পর্ক।
একটা সময় স্বামী বা স্ত্রী বিয়ের পর সঙ্গীর সমকামী আচরন টের পেয়েও লোকলজ্জার ভয়ে,সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় বিষয়টি সয়ে গেছেন।
পরিবারে বিশেষ করে,মায়েরা ছেলের এমন পরিবর্তনের বিষয়টি টের পেলে দেশে নিয়ে ‘সুন্দরী’ মেয়ে দেখে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। এখনো যে করছেন না তাও নয়। কিন্তু, ছেলে ব্রিটেনে ফিরে আসার পর মেয়েটির আর খোজঁ নেয়নি,এমন ঘটনার উদাহরন অহরহ। অনেক ক্ষেত্রে,অভিভাবকদের চাপাচাপির কারনে ছেলেটি শেষ পর্যন্ত মেয়েটির ভিসার ব্যাবস্থা করে এদেশে এনে থিতু হবার পথ করে দিয়েছে। কিন্তু সংসার আর করেনি।
খুব বেশি নয়,এক দশক বা মাত্র বছর পাচেঁক আগেও ব্রিটেনের বাংলাদেশী অভিবাসী পরিবারগুলোতেও সমকামীতা এমন করে নীরব অশ্রু আর অশান্তির কারন হয়নি মা-বাবার।
কিন্তু,প্রজন্মের মনোজাগতিক পরিবর্তন,ব্রিটেনে সমকামী বিয়ের বৈধতা পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে দ্রুতলয়ে।
বিশেষ করে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস সহ বাংলাদেশী বসবাস বহুল এলাকাগুলো থেকে অনেক ক্ষেত্রে গে ক্লাব আর লেসবিয়ান পার্টিতে আমাদের সন্তানদের উপস্থিতি বেড়েছে বহুগুন। রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন আর ব্রিটেনের সমাজের একটি অংশ বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়ায় বহু বাংলাদেশী ব্রিটিশ সমকামী বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন। সমকামী সঙ্গীকে বিয়ে করে দেবার চেষ্টা করছেন সামাজিক-পারিবারিক স্বীকৃতি। কিন্তু বাংলাদেশী মা-বাবা সম্পর্কটিকে কেবল অস্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন না,বরং সন্তানকে ফেরাতে আপ্রাণ চেষ্টাও করছেন। আমি নিজে একটি পরিবারের কথা জানি। যেখানে পরিবারটির এইচএসবিসি কাজ করা বড় ছেলে সমকামী বড় পুত্র তার সঙ্গীকে বিয়ে করতে চান। তবে মায়ের আত্বহনণের হুমকিতে আটকে আছেন তিনি। মা এখনো ছেলের জন্য দেশী পাত্রী খুজঁছেন ছেলেকে ফেরানোর আশায়।
রিচার্ড ফ্রেইহার ইবিং সেই ১৮৮৬ সালে তার ‘সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সুয়ালিস’ বইটি মাধ্যমে সমকামের প্রথম কোন তত্বগত ভিত্তি পায় সমাজ। আমার আজকের লেখার গন্তব্য সমকামের ইতিহাস বেত্তায় সঠিক-বেঠিক সমীকরন নির্ধারন নয় নিশ্চিত ভাবেই।
পিটার প্রাইস নামের এক ব্যক্তিকে সমকামিতা থেকে মুক্ত করার জন্য একটি জানালাবিহীন ছোট্ট খুপড়িতে তিনদিন ধরে আটকে রাখা হয়। তাকে বাইরে থেকে গালিগালাজ সমৃদ্ধ টেপ শোনানো হয়, আর ঘন্টায় ঘন্টায় ইঞ্জেকশন দিয়ে বমি করানো হয়। সেই বমি, প্রশ্রাব আর নিজের বিষ্ঠার মধ্যেই থাকে থাকতে বাধ্য করা হয়। তার এই অত্যাচারের কাহিনী হয়তো আজ নাৎসী বাহিনীর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সাথে তুলনীয় মনে হবে। কিন্তু পার্থক্য একটাই – ব্যাপারটি ঘটেছিলো ব্রিটেনের একটি হাসপাতালে। যদিও দেশটি এখন সমকামী বিয়ের বৈধতা দিয়েছে।
গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে যে, সমকামী প্রবৃত্তিটি জীবনের প্রাথমিক পর্যায়েই তৈরী হয়ে যায়, এবং সম্ভবত তৈরী হয় জন্মেরও আগে। জনসংখ্যার প্রায় দশভাগ অংশ সমকামী, এবং এটি সংস্কৃতি নির্বিশেষে একই রকমই থাকে, এমনকি নৈতিকতার ভিন্নতা এবং মাপকাঠিতে বিস্তর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন১৯৮১ সালে সমকামিতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে অব্যহতি দেয়।
আমেরিকান ল ইন্সটিটিউট তাদের মডেল পেনাল কোড সংশোধন করে উল্লেখ করে –‘কারো ব্যক্তিগত যৌন আসক্তি এবং প্রবৃত্তিকে অপরাধের তালিকা হতে বাদ দেয়া হল’। আমেরিকান বার এসোসিয়েশন১৯৭৪ সালে এই মডেল পেনাল কোডের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে সমকামিতাকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
একাডেমী অব পেডিইয়াট্রিক্স এবং কাউন্সিল অব চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট হেলথ স্পষ্ট করেই বলে যে সমকামিতা কোন চয়েস বা পছন্দের ব্যাপার নয়, এবং এই প্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করা যায় না।সমকামিতা কোন ধরণের ‘ম্যালফাংশানিং’ নয়ৃ এটা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। সমকামিতা কোন জেনেটিক বিকৃতিও নয়, নয় কোন জেনেটিক রোগ।
জঙ্গিবাদে ব্রিটেনে বাংলাদেশী প্রজন্মের জড়িয়ে পড়ার বিষয় নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, আলোচনাও। এ বিষয়টি তবু প্রকাশ্য আলোচনায় আসছে না। উঠছে না পরিবারগুলোর খাবার টেবিলের আলাপচারীতায়। অনেক ক্ষেত্রে থাকছে কেবল সমকামীর সমালোচনা আর পরিবারের প্রতি ব্যাড ক্রিটিসজিম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
কিন্তু সমকামীতার মতো বিষয়টি আর সব ব্রিটিশ এশিয়ান পরিবারেরের মতো আমাদের পরিবারওগুলোতেও মা,বাবা ভাইবোনদের কাছে নিন্দিত। বরঞ্চ তা সমাজ, পরিবার থেকে আলাদা করে দিয়ে এসেছে এতকাল। তা জেনেও তরুন সমকামীরা দিচ্ছেন স্বঘোষনায় দিচ্ছেন বৈবাহিক,পারিবারিক স্বীকৃতি।
আর এতে করে সমকামীতায় আচ্ছন্ন সন্তানদের মা-বাবারা সমাজে,পরিবারে নেতিবাচকতায় নিগৃহীত হচ্ছেন। থাকছেন,সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় ভয়াবহভাবে উদ্বিগ্ন।
বিষয়টি নিয়ে ব্রিটেনের বাঙ্গালী পাড়ায় নীরব আলোচনা চলছে গেল কয়েক মাস ধরেই। কমিউনিটির বিভিন্ন সংকট সম্ভাবনার বিষয় নিয়ে আমি লিখি প্রবাস জীবনের শুরু থেকেই। একথা জেনে অনেকে বলেছেন,বিষয়টি নিয়ে লিখতে। অনেকে বিষয়টি ব্রিটেনে বাঙ্গালী কমিউনিটির জন্য খুব স্পর্শকাতর এটি বলে সতর্ক ভাবে লেখার পরামর্শ দিয়েছেন। তবু বলেছেন,তুমি না লিখলে কেউ লিখবেও না।
ব্রিটেনে এখন আল জান্নাহ নামে ব্রিটিশ সাউথ এশিয়ান মুসলিম দেশী গে-লেসবিয়ানদের রীতিমত সংগঠন রয়েছে। ফেসবুকে অনলাইনেও সংগঠনের প্রচার দেখা যাচ্ছে।
তা সত্বেও,ব্রিটেনের যে সংবাদপত্রগুলো গতকালও জাহেদের সমকামী বিয়ের খবর ছেপেছে,তারা প্রায় সবাই সংবাদটির ভেতরে নিজেদের এ মন্তব্যটুকুও ছেপেছে যে, ব্রিটেনে এশিয়ান ও মুসলমান পরিবার ও সমাজে বড় ট্যাবু হিসেবেই দেখা হয়।
তথ্য সুত্রঃ
১.এমআইবি ম্যাগাজিন ইউকে
2.Eric Marcus, Is It a Choice? Answers to the Most Frequently Asked Questions About Gay & Lesbian People, HarperOne; 3 Revised edition, 2005
‡jLKt hy³ivR¨ c«evmx mvsevw`K
মন্তব্য করুন