সমকালীন ভাবনা—— শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন
মোহাম্মদ ফখর উদ্দীন॥ উন্নয়নের ছোঁয়ায় এগিয়ে চলছে দেশ। আমূল পরিবর্তন আসছে সর্বত্রই। দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন প্রত্যাশার সেই কাঙ্খিত উন্নয়ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে প্রতিটি দেশ প্রেমিক নাগরীকের এযেন এক অন্যরকম অনুভূতি। বদলাচ্ছে আমাদের চারপাশ। গতির চাকা সচল হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির। বৃদ্ধি হচ্ছে মাথাপিছু আয়। সে সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও। এটা বাস্তব সত্য যে দেশ ও জাতি কাঙ্খিত উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছানোর অন্যতম সোপান হল শিক্ষা ব্যবস্থা। কথায় আছে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত,সে জাতি ততই বেশি উন্নত। চৌদ্দশত বছর পূর্বে ইসলাম ধর্মের পথ প্রর্দশক হযরত মোহাম্মদ (সা:) বলেছিলেন বিদ্যা শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদুর চীন দেশে যেতে হলেও সেখানে যাও। কারণ তোমার সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে হলে,তার সৃষ্টি জগতকে জানতে হলে,অবশ্যই বিদ্যা অর্জন করতে হবে। তাই ইসলাম ধর্মে বিদ্যা (জ্ঞান) আহরণ করা অত্যাবশ্যকীয় (ফরজ) করা হয়েছে। অন্যান্য প্রতিটি ধর্মেও বিদ্যা অর্জনকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ধর্মীয় গ্রন্থই যার উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ। তাই পৃথিবী জুড়ে প্রতিটি দেশে নাগরীক অধিকারে অন্যতম ভাবে অগ্রাধিকার বা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শিক্ষাকে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও নাগরীক মৌলিক অধিকারের অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেই সময়োপযোগী আমূল পরিবর্তন এনেছেন শিক্ষা ব্যবস্থায়। তাই দূর হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার জরাজির্ণতা। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে সরকার নানা মূখি পদক্ষেপ গ্রহন ও তা বাস্তবায়নে সচেষ্ঠ রয়েছেন। এখন এমনটিই দৃশ্যমান। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। যার সুফল ইতিমধ্যেই বইতে শুরু হয়েছে। প্রাথমিকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাজ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন প্রশংসিত হচ্ছে সর্বমহলে। কারন প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা অর্জনের বীজ বপন হয়। তাই প্রথমেই ওখানেই দৃষ্টি পড়ে সবার। কেননা ওখান থেকেই শিক্ষা অর্জনকারীরা যত বেশি দক্ষ ও যোগ্য হয়ে উঠবে সে ততই পরিপক্ষতায় সামনে আগাবে। সরকার এমন সচেতনতা বোধ এখন সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বেশ সফলতার সাথে এগিয়ে চলছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। একথা সর্বজন বিধিত শিক্ষা জাতীর মেরুদন্ড। যতি তাই হয়, তবে একথা দৃঢ় কন্ঠে বলা যায়, প্রাথমিক শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাই হল জাতিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার অন্যতম মাধ্যম। কারন এ কথা স্বীকার যোগ্য যে প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষার অর্জনের প্রথম সোপান। আর শিশুরাই হচ্ছে দেশ ও জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতীক। জাতির কাঙ্খিত ভবিষ্যত। শিশুদেরকে আগামীদিনের যোগ্য সুনাগরিক ও দক্ষ কান্ডারী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাথমিক স্থরের শিক্ষকদের ভূমিকাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে শিশুর শিক্ষা তার বর্তমান চাহিদা মেটানোর বা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যই নয়। বরং তাকে ভবিষ্যত জীবনে একজন স্বার্থক মানুষ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের একজন সক্ষম ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে ভূমিকা পালনের জন্যই তাকে যথাযথ ভাবে প্রস্তুব করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো যেন এক একটি ফুলের বাগান। আর এ বাগানের মালিরা (শিক্ষকরা) শিশুদেরকে বর্তমান শিক্ষা বান্ধব সরকারের সার্বিক সহায়তায় দেশ বিদেশের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির কারনে তাদের সময়োপযোগী,যুগোপযোগী এবং মনোবিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষাদানের কারনে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এক একটি দক্ষ নাগরিক গড়ার শিশু কাননে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারনে উচ্চ শিক্ষিত প্রতিভাবান শিক্ষকরা এখন শিক্ষকতা পেশাকেই তাদের পছন্দের তালিকায় স্থান দিচ্ছেন। আমরা জানি প্রতিটি শিশুর ভেতরে রয়েছে সুপ্ত প্রতিভা। রয়েছে অপার সম্ভাবনা। আর দক্ষ চৌকস শিক্ষকরা তাদের মেধা মনন দিয়ে শিশুদের ওই সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করতে নিরলস শ্রম দিয়ে যাবার কারনেই দেশে এখন সোনার ছেলেরা তৈরী হচ্ছে। আর সে কারনেই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি অভিভাবকদেরও আস্থা বাড়ছে। যাদের মাধ্যমেই জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুগে যুগে যে সকল মনীষীগণ এ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন তারা শিক্ষক বা পথ প্রদর্শক হিসেবেই এসেছিলেন। তাই নিঃসন্দেহে শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। মা-বাবার পরেই প্রথমে যিনি বা যারা আমাদেরকে আনুষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষার মাধ্যমে সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছিলেন তারা হলেন আমাদের প্রাথমিক শিক্ষক। ছোট্ট সোনামনিদেরকে হাতেখড়ি দিতে গিয়ে তাঁরা যে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন তা সংশ্লিষ্ট সকলেই তা অনুধাবন করেন। আর সে জন্যেই হয়ত কবি লিখেছিলেন-‘ঊষর মরুর ধূসর বুকে ছোট্ট যদি শহর গড়ো,একটি শিশু মানুষ করা তার চেয়েও অনেক বড়। এই কাঙ্খিত বাস্তব সত্যকে হ্রদয়ে ধারন করেই মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা তাদের স্বার্থক পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাই সবদিক বিবেচনায় নিয়ে বলা চলে শিক্ষায় অগ্রগতিতে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। এটা কোনো ব্যক্তির মৌখিক অনুমোদন নয় বরং বিশ্বব্যাংক, ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা ও গবেষণা সংস্থারই অভিন্ন মত। এমন বক্তব্য তাদের করা অনুসন্ধানী জরিপেই উঠে এসেছে। বলতে গেলে প্রায় একদশকে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা আর শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে চমকপ্রদ পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দেশের এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বের বহু দেশের কাছে অনুকরণীয় হচ্ছে। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ,ছাত্র-ছাত্রীর সমতা,নারী শিক্ষায় অগ্রগতি,ঝরে পড়ার হার দ্রুত কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক,ইউনেস্কো,বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামসহ আন্তর্জাতিক দাতা ও গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতিকে অন্যদের জন্য উদাহরণ উল্লেখ করে বলছে, শিক্ষায় প্রতিটি পর্যায়ে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এক দশকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও টেকসই। শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে বাংলাদেশ ছুঁয়েছে নতুন মাইলফলক। বিশ্বব্যাংক বলছে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তুমুল গতিতে দুর্গম পথ অতিক্রম করেছে এবং শিক্ষায় অভিগম্যতা ও সমতা অর্জনে অনেকদূর এগিয়েছে। মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ হওয়ায় বাংলাদেশ টেকসই ফল বয়ে নিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে লাখ লাখ শিশুর বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা, নারী সাক্ষরতা বৃদ্ধি, মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনাতে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শিশুদের পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষায় ভাল করার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিশ্বব্যাংক মনে করছে স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে বস্তিবাসী ও গ্রামীণ হতদরিদ্র শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এদিকে মাধ্যমিক স্থরের শিক্ষা গ্রহণে বাংলাদেশের নারীরা এখন অন্যদের জন্য উদাহরণ। মাধ্যমিক স্থরের ছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সবার ওপরে। এমন তথ্যও বিশ্বব্যাংকের। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) শিক্ষা পরিসংখ্যান রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ক্রমেই কমছে। সকল সংস্থার তথ্য উপাথ্যের ভিত্তিতে এটাই প্রতিয়মান হয় যে আলোকিত জনগোষ্ঠী গড়তে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান এখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক দশকে শিক্ষার সর্বস্থরেই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষার এই ব্যাপক অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন অর্থনীতির ভিত্তিকেও করেছে মজবুত ও টেকসই। আর দেশকে বিশ্বের বুকে দিচ্ছে পৃথক পরিচিতি। একসময় বিপুলসংখ্যক কোমলমতি শিশু স্কুলে যাওয়ারই সুযোগ পেতো না। অনেকে আবার স্কুলে গেলেও প্রাথমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়তো। পাবলিক পরীক্ষায় ছিল নকলের ছড়াছড়ি। ফল প্রকাশে যেমন দেরি হতো তেমনি প্রকাশের পর দেখা যেতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরীক্ষার্থীই অকৃতকার্য। স্কুলে যথাসময়ে পাঠ্যবই পেতো না শিশু-কিশোররা। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে অসংখ্য কিশোরী বা তরুণীকে বাল্য বিয়ের শিকার হয়ে নির্মম জীবন বেছে নিতে হতো। গত কয়েক বছরে বদলে গেছে শিক্ষাক্ষেত্র। বলা চলে শিক্ষার আলোয় এখন আলোকিত পুরো বাংলাদেশ। নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়, প্রাথমিক শিক্ষায় সাফল্য তাৎপর্যপূণ,প্রাকক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ,মাধ্যমিক স্থরে কমছে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার,শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনয়নে শিক্ষানীতি প্রণয়ন,শিক্ষাখাতে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি,বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ,কারিকুলাম সংস্কার,আধুনিক ও যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন,পাঠ্যবইয়ে সঠিক ইতিহাস সংযোজন,সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণয়ন,পরীক্ষা কার্যক্রম সংস্কার,অর্জন হয়েছে জেন্ডার সমতা,বাড়ছে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও পাশের হার, ছাত্র-ছাত্রীকে উপবৃত্তি প্রদান,শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন, শিক্ষাক্ষেত্রে ই-বুক ও ডায়নামিক ওয়েবসাইট,অনলাইনে ভর্তি ও পরীক্ষার ফলাফল,শিক্ষাব্যবস্থায় আইসিটির ব্যবহার,কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন,এমপিওভুক্তকরণ এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান,বেতন ভাতা বৃদ্ধি,নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি প্রদান,শিক্ষক প্রশিক্ষণ,কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন,কারিগরি শিক্ষার প্রসার,স্কুল ফিডিং কর্মসূচি,সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ,প্রাথমিক শিক্ষায় সাফল্য তাৎপর্যপূর্ণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিডডে হট মিল চালু। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে “রঙ্গিণ স্কুল”, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ,শিশু কর্ণার, ছড়া গানে পাঠদান ইত্যাদি আর্কষণীয় পদ্ধতিগুলো শিশু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকৃষ্ঠ করছে সহজেই। (চলবে)
লেখক: সহকারী শিক্ষক মির্জাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষক ইংরেজী,কুলাউড়া,মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন