সম্ভাবনার বাংলাদেশ ও বিডি ক্লিন
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ আমাদের জ্ঞানী-গুণী পূর্ব পুরুষেরা শত শত বছর পূর্বে বলে গেছেন “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গদপি গরিয়সি” মা ও মাতৃভূমি গৌরবের বা মর্যাদাপূর্ণ। পৃথিবীর যেখানেই যত সুন্দর জায়গা থাকুক তার তুলনা স্বদেশের সঙ্গে হয়না। তাই কবি বলেছেন “ বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ আমি আর দেখিতে যাইনা”।
প্রকৃতির অকৃত্রিম, অফুরন্ত অনাবিল বহুমাত্রিক সৌন্দর্যের লীলাভূমী বাংলাদেশ। এর প্রত পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাহাড় নদী ও হাওরের নির্মল উজ্জ¦লতা।
ভারতীয় অর্থনীতিবীদ কৌশিক বসুর মতে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে চমকপ্রদ ও অপ্রত্যাশিত সাফল্যের কাহিনীগুলোর একটি। ‘হোয়াই বাংলাদেশ ইজ বোমিং’ নামে তার একটি লেখা বেশ কিছুদিন আগে প্রকাশ করেছে প্রজেক্ট সিন্ডিকেট নামক একটি ওয়েব সাইট, এই লেখায় তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন , অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একসময়ের দারিদ্র আর দুর্ভিক্ষপীড়িত এই দেশটি শুধু পাকিস্তানকেই নয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। বিশ^ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবীদ ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসুর বিবিসি বাংলা থেকে প্রকাশিত এই লেখায় তিনি বলেছেন ২০০৯ সাল হতে পরবর্তী প্রতিটি বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল পাকিস্তানের চেয়ে আড়াই শতাংশ বেশি। তিনি বলেছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনেক উজ্জল।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলেছে সামনের বছরগুলোতে পুরো পৃথিবীতে যে তিনটি দেশ খুব দ্রুত গতিতে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখবে তার একটির নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে বলা হয় বিশে^র সম্ভাবনাময় দেশগুলোর একটি। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই তরুণ । তরুণরা যেকোন সমাজের মেরুদন্ড। উন্নত সমাজ বিনির্মাণে তারাই জাতির শক্তি। এই জনগোষ্ঠির উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের উজ্জল ভবিষ্যৎ রচনায় ভূমিকা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তারুণ্যকে জাগিয়েই আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুথ্থান,৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ তারুণ্যেরই অবদান। তরুণরা একটি সুন্দর আগামী দেখতে চায়। কিছু দিন আগেও বাংলাদেশের তরুণ ছাত্রসমাজ আকাশে বাতাসে আওয়াজ তুলেছে “যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ”। তরুণরা নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করেছে। তরুণরা আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায় বলতে চেয়েছে “আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে”। বাংলাদেশের তরুণদেরই একটি অংশ পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের ন্বপ্ন দেখেছে। তারা গঠন করেছে ‘বিডি ক্লিন’ নামক অরাজনৈতিক সমাজিক সংগঠন। যা সারা বাংলাদেশের জন্য যুগোপযোগী এক কর্মসূচি, অসাধারণ উদ্যোগ। বিডি ক্লিন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র শিক্ষকের অংশ গ্রহণে “ ক্লিন ক্যাম্পাস এন্ড গ্রীণ ক্যাম্পাস” শ্লোগান-কে ধারণ করে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ শিক্ষাঙ্গন গড়ে তুলতে চায়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন প্রত্যেক মানুষের তিনটি করে মা থাকে একটি জন্মদাত্রী মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা। তরুণরা মাতৃভূমিকে ভালোবেসেই এই উদ্দোগ গ্রহণ করেছে। এখন বাংলাদেশের উন্ন্য়ন অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য। এই উন্নয়ন অগ্রগতিকে আরও বেগবান করতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হবে। সকলকে মনে রাখতে হবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পরিবেশ রক্ষার বিকল্প নাই। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় বলেছেন বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৯তম। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে বাংলাদেশের অনেকাংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আজকাল বিশে^ এমন কিছু ঘটছে যা মেনে নেওয়া যায় না, যা অনাকাংখিত। বৈশি^ক উষ্ণায়নের ফলে ক্রমশ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এর ফলে বাংলাদেশ বড় সমস্যায় পড়তে পারে। এ ব্যাপারে তরুণদেরই ভূমিকা রাখতে হবে বেশি, যেন বড় বড় রাজনীতিবিদরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ক্ষতিকর পরিণতি বিশে^র সামনে তুলে ধরেন । বিশ^ যেন এটি মোকাবেলা করার জন্য সক্রিয় হয়। এ ব্যাপারে তরুণদেরই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। আগামী বিশ^ শুধুই নতুন প্রজন্মের হাতে। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের জন্য সুইডেনের ষোল বছরের স্কুল ছাত্রী গ্রেটা থানবার্গ শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনিত হয়েছেন। ২০২০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারের জন্য তাকে মনোনিত করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় গত বছরের আগষ্ট মাস থেকে গ্রেটা এর শুরু করা ‘ইয়থ স্টাইক’ আন্দোলন এরই মধ্যে সুইডেন থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশে^। বিশে^র ১০৫টি দেশের ১৬৫৯টি শহরের জনগণ ও কয়েক লাখ কিশোর কিশোরী গ্রেটা’র শুরু করা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। বিডি ক্লিন এর পরিচ্ছন্নতা আন্দোলন তথা পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের মানুষের সচেতনতা বাড়বে এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল ছাত্র শিক্ষকরা পরিবেশ রক্ষায় মানুষের সচেতনতা তৈরিতে অসাধারণ ভূমিকা রাখবেন বলে আমি দূঢ়ভাবে বিশ^াস করি। ময়লা আবর্জনায় দেশ আমরা রেখে যেতে চাইনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠুক অপরূপ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন এক বাংলাদেশে । ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ আমাদের সকলের অঙ্গিকার হবে আমরা যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে সঠিক স্থানে ময়লা ফেলব।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকারও বদ্ধপরিকর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স¦াস্থ্যসম্মত পরিবেশ বান্ধব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ ১১দফা নির্দেশনা প্রদান করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং এর জন্য ১ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিচ্ছন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়নে গত ২৭ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, শিক্ষার্থীদের পরিষ্কার পোষাক পড়তে উৎসাহিত করা ,পরিচ্ছন্ন ব্যাগ, টিফিন বাক্স ও পানির পাত্র ব্যবহারে উদ্বুদ্ব করা। শ্রেণি কক্ষের সামনে ঢাকনা যুক্ত ময়লা ফেলার ডাস্টবিন রাখা, নির্ধারিত স্থানে ময়লা ফেলতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা, ছুটির পর আবশ্যিক ভাবে ময়লা ফেলার পাত্র গুলো পরিষ্কার করা, শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে প্রবেশের পূর্বেই চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ ও বোর্ড পরিষ্কার করা ইত্যাদি। পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে সরকারের নির্দেশনা গুলো বাস্তবায়ন করতে বিডি ক্লিন সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি।
বাংলাদেশ আগের অবস্থানে নেই। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুই। মানুষের গড় আয়ু, গড় আয়, রিজার্ভ, রেমিটেন্স, দেশের অর্থনীতির আকার সব কিছুতেই পরিবর্তন হয়েছে। উন্নতি হয়েছে কয়েকগুণ, দেশের অনেক উন্নয়ন বিশে^র রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এমন বাংলাদেশের অপার সম্ভাবণাময় এক জনপদের নাম মৌলভীবাজার।
বাংলাদেশের জেলা সমূহের মধ্যে আমাদের প্রিয় মৌলভীবাজারের নয়নাভিরাম, নৈসর্গিক লীলাভূমি হিসেবে অনেক খ্যাতি রয়েছে। দেশকে ভালোবাসা যেমন ঈমানের দাবী, পরিষ্কার পরিচ্চন্নতাও ঈমানের অংশ।
দেশের অন্যান্য জেলার মত মৌলভীবাজারেও তরুণ সমাজকর্মী তাকবির হোসাইনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিডি ক্লিন মৌলভীবাজার। এই প্লাটফর্ম থেকে পরিচ্ছন্ন মৌলভীবাজার গড়ার লক্ষ্যে অবদান রেখে পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়ার মহান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে মৌলভীবাজারের তরুণ ছাত্র সমাজ অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।
লেখক:- ব্যাংকার, গবেষক ও কলামিস্ট এবং প্রধান উপদেষ্টা বিডি ক্লিন, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন