সরপঞ্চের বিচার  

June 22, 2020,

মোঃ আবু তাহের॥ তৎকালিন পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে,ষাটের দশকে আমাদের দেশে ইউনিয়ন পরিষদ চালু করা হয়। বৃটিশ আমলের শেষের দিক হইতে ইউনিয়ন পরিষদ প্রথা চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত  প্রতি গ্রাম বা এলাকায় জ্ঞানী-গুণী ও প্রভাবশালী লোক দেখে সরকার একজন সরপঞ্চ নিয়োগ করিতেন। সরপঞ্চগণ যার তার এলাকার সমুহ বিচার বৈঠক ,মানুষের সুবিধা অসুবিধা এবংসরকারের উন্নয়ন কাজে যেমন রাস্তাঘাট নির্মান করিতে সহযোগিতা করিতেন। কোর্ট কাচারিতে বিচার কার্যে জটিলতা দেখাদিলে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য জুরি বসিত। ১১জন সদস্য নিয়ে জুরি ঘটিত হইত। বিজোড় সংখ্যক সদস্য নিয়া জুরি ঘটিত হওয়ার কারণ অর্ধেকের বেশী সদস্যগণ যেদিকে যুক্তি ও মত পোষন করিতেন,সে দিকে বিচারক রায় দিতেন। এই সমস্ত সরপঞ্চগণের অনেকই জুরির সদস্য ছিলেন। আজও আমাদের দেশে অনেক বাড়ীর “সরপঞ্চ বাড়ী” বলে নাম ডাক আছে।

সে সময় সাধারন মানুষ মামলা মোকদ্দমার প্রতি উৎসাহিত ছিল না। অতি মারাত্বক কিছু ঘটিলে বা খুন খারাপি হইলে মামলা মোকদ্দমায় যাইত। সে দিকে উৎসাহিত না হওয়ার দুটি কারণ ছিল। প্রথমত: শিক্ষিতের হার কম ছিল,মানুষ সহজ সরল এবং একে অন্যের প্রতি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল। ছোট খাটো ঘটনা ঘটিলে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে সমাধান হইত। আর এই সমস্ত বিচার বৈঠকে সরপঞ্চগণ নেতৃত্ব দিতেন। দ্বিতীয়ত: কোর্ট কাচারী সহজে মানুষের নাগালের মধ্যে ছিল না। প্রতি মহকুমায় একটি ফৌজদারী ও একটি মুন্সেফ কোর্ট ছিল। পূর্বের মহকুমা এখন জেলা হয়েছে। তখন প্রত্যেক জেলায় জজকোর্ট ছিল। অনেক জেলায় এখন বিভাগ হইতেছে। গাড়ী চলাচল খুব কম ছিল, সবদিকে গাড়ী চলাচলের রাস্তাও ছিল না। কোন জরুরী কাজে বা মামলা মোকদ্দমা পরিচালনার জন্য জেলা শহরে অনুমানিক ৩০, ৪০,বা ৫০ মাইল পায়ে হাঁটিয়া যাইতেন। সঙ্গে শুকনা খাবার অথবা মিটা চাউলের ভাত,সাথে মাছ ভাজি করে,সুপারী গাছের খোলে কলাপতা দিয়ে বাঁধিয়া নিতেন। পথি মধ্যে কোন জলাশয়ের পাশে, গাছের নীচে বসে খেয়ে নিতেন।

মানুষ সামাজিক জীব। সব সমাজ বা জাতিতে কিছু দলিত সম্প্রদায়ের লোক ছিল। বিশেষ করে সনাতন ধর্মীয়দের মধ্যে বেশী দলিত সম্প্রদায় ছিল। এখনো কিছু দলিত সম্প্রদায়ের লোক আছে। দুনিয়া সৃষ্টি হইতে এক আদমের বংশ সকল মানুষ,তবে কেন ভিন্ন ভিন্ন জাতি ,গোত্র ও শ্রেণীভেদ? ইহা অবশ্য ভিন্ন ইতিহাস।

অনেক ধনী এবং ভদ্রলোকেরা নিজে নিজের কাজ করাকে অপমানবোধ করিতেন। এমনও দেখা গেছে অনেক ভদ্রলোক পথ চলার সময় ছাতা ধরার জন্য অন্য লোক সঙ্গে রাখতেন। এই সমস্ত দলিত সম্প্রদায়ের লোকদেরকে হাকে ডাকে সব সময় ও চলার পথে যেনতেন ভাবে ব্যবহার করিতেন। তাহারা ছিল খুব অবহেলিত এবং নিগৃত। শিক্ষার আলো ছিল না,ধারে কাছে কোন স্কুল থাকলেও তাহাদের ছ্লে মেয়েকে স্কুলে যাইতে দেওয়া হইত না। এই ভদ্রলোকেরা ইচ্ছা করে এদেরকে অবহেলিত রাখিতেন। নিজেদের কাজ তাদেরকে দিয়ে করিয়ে,নিজেকে সম্মানি মনে করিতেন।

যুগের আবর্তনে সবই পরিবর্তন হইতেছে। এদেরকে এখন আর নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে ধরে রাখা যাইতেছেনা। ধীরে ধীরে শিক্ষার আলো যাইতেছে। পক্ষান্তরে ভদ্রলোকেরাও নিজের কাজ নিজে করিতে অপমানবোধ করিতেছেন না। তাই সমাজ ও উন্নত হইতেছে।

সুখ কত প্রকার আমি জানিনা। ধনী ও গরীবের সুখর মধ্যে কতটুকু পার্থক্য, তাহা বলা কঠিন। পক্ষান্তরে এই দলিত   সম্প্রদায়ের লোকগুলা সুখী ছিল,কারণ তাদের কোন উচ্চবিলাস ছিল না। এদের জীবন প্রবাহ ছিল অতিসাধারণ। সব সময় ধনী ও ভদ্রলোকদের তাবেদার ছিল। দুই বেলা অথবা এক বেলা পেট পুরে খেয়েছে কিনা সেটা বড় কথা নয়। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে,রাতে পরিবার পরিজন নিয়ে দিব্বি আরামে ঘুমাইত। তাদের কোন টানতেষ্টা ছিল না। বিকাল বেলা দেখা গেছে মহিলারা ৩/৪ জন এক সারিতে বসে একে অন্যের মাথার উঁকুন মারিতেছে অথবা কয়কজন মিলে বাড়ির উঠানে ধামালি খেলিতেছে আর পুরুষেরা রাত্রে ঘরে বসে গান বাজনা করিতেছে।  মন প্রফুল্ল না থকিলে কি এই সমস্ত কাজ করা যায়,এ গুলা কি সুখে থাকার লক্ষণ নয়? তাদের বেশীর ভাগই ধর্মভীরু ছিল। একটি মজার ঘটনা বলি। আমি এক পরিবারকে ছিনতাম,বয়স্ক পুরুষ বাজার টিকি বিক্রি করিত,তাহার স্ত্রী ভিক্ষা করিত এবং তাদের এক ছেলে রিক্সা চালাইত শেষ বয়সে ,বয়স্ক লোকটি প্যারালাইসিস হয়ে ঘরবয়টী ছিল। একদিন এই ভিক্ষুক মহিলাকে পরিচিত একজন মশকরা করে বলেছিল, “এ বেটি  তোর জামাই মরে না কেন”?

ভিখারিনি:–আমার স্বোয়ামী মরবে কেন ?ভিক দিতায়নী দেও,বাজে কথা কইও না।

পরিচিত লোক:–ঘরে পেশাব পায়খানা করে,মরি গেলে আপদ গেল।

ভিখারিনি:–আপদ কেমনে ,আমার স্বোয়ামী আমার দেবতা। আমার দেবতা যতদিন আমার সামনে থাকবে ততদিন আমি তার সেবা করিব,তাহার সেবা করা কি ভগবানের আরাধনা নয়। ভগবানের আরাধনা করে স্বর্গবাস করিতে হইলে,আমার দেবতা যতদিন আমার সামনে থাকবে ততদিন বাঘ সামনে আছে মনে করিব।

এই দলিত লোকেরা বেশী করে হাঁস ,মোরগ,ছাগল ও গরু পালন করিত। তাহাদের মহিলারাই এসকল পশু পক্ষী লালন পালন করে থাকে। অন্যের যাহাতে ক্ষতি না করে, সেদিকে বেশী লক্ষ্য রাখে কারণ কাহারো কোন ফসল নষ্ট করিলে উপায় থাকিবে না। এক মহিলা বেশী করে হাঁস পালন করিত কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন তাহার হাঁস প্রথম ডিম পাড়ার জন্য মত্ত হয় তখন প্রয়ই এক দুইটা ঘরে ফিরে আসেনা। খোঁজ করিতে গেলে আরো বিপদ। প্রতিবেশী ভদ্র লোকদের মিষ্টি গালি,আজেবাজে কথা এমন কি হুমকি ধমকি ও শুনতে হয়েছে। তাই ভয়ে চুপ হয়ে থাকত কিন্তু সহ্য করতে পারত না,যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটকে হাঁসের পালক দেখা যাইত। এবার একে একে মহিলার সাতটি হাঁস নিখোঁজ হয়েছে। মহিলা কাহারো হুমকি ধনকি না শুনে সরাসরি সরপঞ্চ সাহেবের কাছে বিচার প্রার্থী।

সরপঞ্চ সাহেব সমগ্র এলাকা নিয়ে পঞ্চায়েত ডাকিলেন,আর ঘোষনা করিলেন হাঁস নিঁখোজ  এলাকার সকল আবাল বৃদ্ধ উপস্থিত থাকিতে। বিনা কারণে কেহ অনুপস্থিত থাকিলে হাঁসের দ্বায়ভার তাহাকে বহন করিতে হইবে।

বিচার কার্য আরম্ভ হইলে জিজ্ঞাসাবাদে দুই একজন বলিলেন মহিলার কোন হাঁস হারায় নাই, মহিলা মিথ্যুক। কেহ বলিলেন এত হাঁস হারায় নাই,হয়ত দুই একটি শিয়াল ভক্ষণ করেছে। মহিলাকে সত্য মিথ্যা জিজ্ঞাসা করিলে সে যাহা বলিল, “হুজুর , শিয়াল হাঁস খেতে পারে অবিশ্বাস্য নয়। তবে আমার হাঁস শিয়ালে খায় নাই,মানুষ ভক্ষণ করেছে। তাহার প্রমান,গতকাল বা পুর্বে আমার যে হাঁস হারিয়েছে, আমি ইহাদের পালক সংগ্রহ করে এনেছি। এই দেখেন ইহাদের মধ্যে কোন চামড়া বা মাংসযুক্ত নয়,শুধু ছোট বড় পালক। শিয়াল ভক্ষণ করিলে গুচ্ছ গুচ্ছ পালক পাওয়া যাইত। উপস্থিত পঞ্চায়েতের দু’তিন জনকে সাক্ষী করে আমি পালক সংগ্রহ করেছি। তাহাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন। আমি মিথ্যা বলি নাই,আমার সাতটি হাঁস হারিয়েছে। মিথ্যা বলিলে পরজনমে নরকে বাস হইবে”।

সরপঞ্চ সাহেব বিজ্ঞ দেখে ৫জনকে দিয়ে কমিটি গঠন করে আধা ঘন্টা সময় দিলেন,মহিলার কথা সত্য মিথ্যা যাচাই বাচাই করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার জন্য। কমিটির দু’একজন উল্টো পাল্টা মত পোষণ করিলেও শেষপর্যন্ত ৫জনই একমত প্রকাশ করিলেন। মহিলার কথা সত্য এবং তাহার সাতটি হাঁস কে বা তাহারা জবাই করে খেয়েছে। কিন্তু কে খেয়েছে বাহির করিতে পারেন নাই।

সরপঞ্চ সাহেব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলিলেন, “নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে কেহ মহিলার হাঁস চুরি করে খেয়েছে ,কে খেয়েছ স্বীকার করে নাও,শাস্তি কম হবে। নতুবা কঠিন শাস্তি হবে”। কিন্তু কেহ স্বীকার করিলনা।তিনি এবং কমিটির ৫জন এক সারিতে বসিলেন। বাকী সবাইকে অর্ধগোলাকৃতি হয়ে তাহাদের সামনে কথা না বলে নিশ্চুপ,সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে বলিলেন। কমপক্ষে ৫মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর,সরপঞ্চ সাহেব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলিলেন, “আপনারা কোন কিছু দেখিতে পাইতেছ্ন কি? এই চেয়ে দেখেন যে লোক মহিলার হাঁস  খেয়েছে,তাহার মাথায় এখনো হাঁসের পালক লেগে আছে”। এমনি লাইনের মধ্যে একজন হাত দিয়ে মাথা ঝারিয়ে পালক সরাইতে লাগিল। আপনারা কি দেখেছেন? সবাই একবাক্যে হ্যাঁ দেখছি। এখন আপনি শাস্তি দেন।

উপস্থিত জনতা হাঁস চোরকে কিছু উত্তম মধ্যম দিলেন। তারপর সরপঞ্চ সাহেব রায় দিলেন, “সাতটি হাঁস জীবিত থাকলে বছরে অনেক ডিম দিত,ডিম থেকে বাচ্ছা। এভাবে ডিম এবং বাচ্ছা বিক্রি করে অনেক টাকা পাইতেন। মহিলা তাহা থেকে বঞ্চিত। তাই হাঁস চোর একটি হাঁসের বদলে দশটি করে সত্তরটি হাঁসের দাম এখনই পঞ্চায়েতের সম্মুখে,মহিলাকে পরিশোধ করিতে হইবে”।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com