সর্ব্ব ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম- সিপাহী বিদ্রোহের সিপাহ সালার-চেঙ্গিঁস-তৈমুরের অধস্থন বংশধর দিল্লীর শেষ মুঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর দিল্লী থেকে পালিয়ে যান নিঃ ঐতিহাসিক আগ্রাদূর্র্গ প্রসঙ্গেঁ-প্রসঙ্গঁ কথা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ ভ্রমন কাহিনী ও ভ্রমন সাহিত্য সকল সাহিত্যের নির্ভরযোগ্য তথ্য ও উপাদান। প্রাচীন ও মধ্যযুগে যখন আধুনিক লিখন পদ্ধতি লিখিত ইতিহাস ছিলনা তখন বিশ^ পর্যটকদের ভ্রমন কাহিনী ও ভ্রমন বৃত্তান্তই পরবর্ত্তী পর্য্যায়ে মানবজাতিকে ইতিহাস প্রনয়নের সুযোগ করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশ^ পর্য্যটকদের মধ্যে মুর দেশীয় ইবনে বতুতা, চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাং নাবিক কলম্বাস-ভাস্কো- ডা- গামার কাছে আধুনিক ইতিহাসবিদ-গবেষক গন অনেকাংশেই ঋনী।
পর্য্যটন-হালআমলে বিশ^ব্যাপী শিল্প হিসাবে স্বীকৃত। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার এতদাঞ্চল বাংলাদেশ-পাক-ভারত উপমহাদেশ প্রাচীন ও মধ্য যুগীয় সভতার লীলাভূমি। উপমহাদেশে- ইতিহাসের অনেক উপাদান -ঐতিহাসিক নিদর্শনাদি বিদ্যমান।
আধুনিক কালে বাংলাদেশের দুইজন বিশ^ পর্য্যটক- প্রায় বিশ^ নাগরিক মঈনুস সুলতান এবং শাকুর মজিদ বিশ^ভ্রমন করতঃ ভ্রমন কাহিনী লিখে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সম্বৃদ্ধ করছেন। প্রকাশনা সংস্থা সমূহ ভ্রমন কাহিনী বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ এবং জাতীয় দৈনিক সমূহ সাহিত্যের পাতায় পর্য্যটন ও ভ্রমন বিষয়ক সাহিত্যের পাতা বরাদ্দ এবং এই জাতীয় রচনা প্রকাশ করে বিদগ্ধ পাঠক/পাঠিকার হৃদয়-মন জয় করেছেন- কৃতজ্ঞতা ভাজন হয়েছেন।
জাতীয় দৈনিক – বাংলাদেশ প্রতিদিন একটি বহুল প্রচারিত ও পাঠক নন্দিত জাতীয় দৈনিক। দৈনিকটি ইতিমধ্যে ইতিহাস-ঐতিহ্য সংক্রান্ত রচনা প্রকাশ করে প্রশংসিত হয়েছে। পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। দৈনিকটির সম্পাদক ও দেশের একজন বিশিষ্ট বিদগ্ধ সাংবাদিক। লোক প্রিয় কলামিষ্ট সাংবাদিক নাঈম নিজামের বাংলাদেশ প্রতিদিন এর আমি একজন গ্রাহক। পাঠক। দৈনিকটি বস্তুুনিষ্ট সংবাদ দৃষ্টিনন্দন অঙ্গঁ সজ্জা, ঐতিহাসিক তথ্য সম্বলিত আকর্ষনীয় ঐতিহাসিক রচনা ও ফিচার এবং উপ সম্পাদকীয়তে বঙ্গঁবীর কাদের সিদ্দিকী, গোলাম মওলা রনী প্রমুখের সুখপাঠ্য ও সরেস রচনা সমূহ আমার ও পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে- পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে।
একটি আধুনিক কল্যানকামী রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ- আইন, বিচার ও প্রশাসন এরপর হাল আমলে মিডিয়া রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে খ্যাত ও স্বীকৃত। সেই ষাটের দশকের শুরু থেকে সংবাদপত্র শিল্পের সেবায় সম্পৃক্ত আছি- সাংবাদিকতায়, সম্পাদনায়-প্রকাশনায়-গ্রন্থনায়। জীবন সায়াহ্নে এই পড়ন্ত বেলায় এখনও সেই মায়া ত্যাগ করতে পারিনি। মোহাচ্ছন্ন আছি এখনও। সাম্প্রতিক কালে বার্ধক্য জনিক ব্যাধি-অসুস্থতা-দূর্বলতার মাঝে -বাসার সিড়ি জনিত দূর্ঘটনায় পা ভেঙ্গেঁ গেলেও মন ভাঙ্গেঁনি। দয়াময় মহান মালিকের সীমাহীন দয়া-ওলামায়ে কেরাম ও শুভানুধ্যায়ীগনের দোয়ায় এ যাত্রায় ও রক্ষা পেয়ে শয্যা শায়ী-সোফাশায়ী হয়ে কালাতিপাত করছি। এমতাবস্থায় তসবিহ, পত্র পত্রিকা, টিভি বই ও আল্লাহই ভরসা। ইতিহাস আমার প্রিয় বিষয়। ষাটের দশকে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র ছিলাম। সত্তোর দশকে ইতিহাসের অধ্যাপনা করেছি এখনও ইতিহাসের মিত্র আছি।
মধ্যযুগে মধ্য এশিয়ার মুঘলরা ভারত বর্ষে মুঘল স¤্রাজ্য প্রতিষ্টা করে তিনশতাধিক বৎসর ভারত শাসন করেন। সর্ব ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি স্থাপত্য ও চিত্রকলার ইতিহাসে ঐতিহাসিক অবদান রাখেন। ভারতীয় সভ্যতা ও সংষ্কৃতিকে সম্বৃদ্ধ করেন। স্থাপত্য শিল্পে মুঘল শাহীর অবদান সর্বাগ্রে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১৫২৬ খৃষ্টাব্দে পানি পথের প্রথম যুদ্ধে মধ্য এশিয়ার ক্ষুদ্র রাজ্য ফারগানার-অধিপতি জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবুর দিল্লীর লোদী বংশীয় শেষ শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত ও নিহত করে ভারত বর্ষে মুঘল স¤্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। ইতিপূর্বে দশম শতাব্দীতে দিল্লীর শেষ রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানকে তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে গজনীর শাসক শাহাবুদ্দিন মোঃ ঘোরী মাত্র লক্ষাধিক সেনাবাহিনী নিয়ে তিন লক্ষাধিক রাজপুত বাহিনীকে পরাজিত করে ঐতিহাসিক দিল্লীতে মুসলমানদের বিজয় নিশান উড়িয়ে তাঁর প্রধান সেনাপতি মামলুক বংশীয় ক্রীত দাস কুতুব উদ্দীন আইবেক কে দিল্লীর শাসনভার অর্পন করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সেই থেকে দিল্লী সালতানাতের শুরু। দাস বংশ, খিলজি, তুঘলক, সৈয়দ বংশ হয়ে দিল্লী সালতানাতের শেষ স্বাধীন শাসক ছিলেন লোদী বংশীয় ইব্রাহিম লোদী। এই আমলেও আগ্রার গুরুত্ব ছিল। মুঘল আমলেও আগ্রার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। মুঘলগন শাসকগন তাঁদের প্রশাসনিক প্রয়োজনে দিল্লী, ফতেপুর সিক্রী, আওরঙ্গঁবাদ, লাহোর কে রাজধানী হিসাবে ব্যবহার করলেও আগ্রার গুরুত্ব হ্রাস পায়নি। যমুনার তীরে আগ্রার তাজমহল- যা বিশে^র সপ্তমাশ্চর্য্যরে একটি। মধ্যযুগীয় শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীঁত ও সংস্কৃতির ইতিহাসে আরেক এতিহাসিক ব্যাক্তি ও ব্যাক্তিত্ব মির্জা গালিব হিসাবে পরিচিত আসাদুল্লাহ- বেগ খাঁ। দিল্লীর শেষ মুঘল স¤্রাট আবু জাফর সিরাজুদ্দীন মোহাম্মদ বাহাদুর শাহ্ জাফরের শাসনামলে আগ্রার এই ভূবন বিজয়ী কবি ও গীতিকার দিল্লীতে বসবাস শুরু করলেও আগ্রায়ই তার জন্ম ও বেড়ে উঠা। মুঘল স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন শাহজাহানের স্বপ্ন শত দল তাজমহল প্রাকতিক কারনে ঔজ্জল্য হারাচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্য্যয় ভুমিকম্প কিংবা সময়ের প্রয়োজনে তাজমহলের স্থাপনা বিদ্ধংস, বিনষ্ট কিংবা নিশ্চিহ্ন হতে পারে কিন্তু ফার্সি উর্দ্দূ হিন্দি ভাষার খ্যাতিমান পন্ডিত মির্জা গালিবের গালিবী ঘরানার ছন্দ ও সুরের মুর্ছনা কোনদিন ম্লান হবেনা থেকে যাবে টিকে থাকবে অনাদি-অনন্ত কাল। আগ্রার ইতিহাস লিখলে বল্লে মির্জা গালিবের কথা বলতেই হবে। লিখতেই হবে। কারন মির্জা গালিব ও আগ্রাকে আগ্রা ও মির্জা গালিব কে ভাগ করার বাদ দেয়ার উপায় নাই। মির্জা গালিবের স্মৃতিবিজড়িত আগ্রার কথা লিখলে মির্জা গালিবের কথা বলতে হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্য জনক ভাবে ভ্রমন কাহিনীর লিখক ঐতিহাসিক আগ্রা দূর্গ শিরোনামে পূর্ন পৃষ্টার মধ্যেও ডা. শামীমা রীমা মির্জা গালিবের নাম একবার ও উল্লেখ করেননি। কারন ভ্রমন কাহিনী শুধুমাত্র একটি দেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক নিসর্গ এবং পূরাতন ইট পাথরের কথাও কাহিনী নয় ভ্রমনকাহিনী একটি দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য শিল্প সংস্কৃতি কৃষ্টি ও সভ্যতার সমন্বিত ইতিহাসের কথা ও কাহিনী। বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিগত তেইশে ডিসেম্বর সতেরো সাল শনিবারের সংখ্যায় শনিবারের সকাল পাতায় ছয় পৃষ্টায় ঐতিহাসিক আগ্রা দূর্গ শিরোনামে ডা. শামীমা রিমা লিখেন- “ ১৮০৩ সালে বৃটিশরা আগ্রা দূর্গ দখল করে নেয়। মুঘল শেষ স¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফর পালিয়ে রেঙ্গুঁনে চলে যান। কিন্তু তার তিন ছেলেকে এখানেই হত্যা করা হয়। এ নিয়ে কিছু ভৌতিক কাহিনী লোক মুখে প্রচলিত। প্রতি বৃহস্পতিবার বাহাদুর শাহের অতৃপ্ত আত্বা ফিরে আসে এই দূর্গে তার ছেলে ও প্রজাদের দেখতে। সঙ্গেঁ থাকেন তার স্ত্রী এবং বিশ^স্থ দেহরক্ষি অনুচররাও। দূর থেকে অনেকেই নাকি তাদের এই যাত্রা দেখেছেন। তবে যারা সাহস করে তাদের কাছে গেছেন তারা নাকি আর ফিরে আসতে পারেন -নি। ”
ডা. শামীমা রিমা পরিবেশিত এই তথ্য ও অভিমত ইতিহাসের আলোকে শতকরা একশত ভাগ অসত্য বটে। স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রামীগন এবং সিপাহী বিদ্রোহের সিপাহ শালার চেঙ্গীঁস-তৈমুরের অধঃস্থন বংশধর দিল্লীর শেষ মুঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরকে অপমান অসম্মান করা হয়েছে, ইতিহাস বিকৃতি সহ স্বাধীনতা সংগ্রামী বাহাদুর শাহের চরিত্রে কলংকের কালিমা লেপন করা হয়েছে। ইতিহাসের সাধারন ছাত্র-পাঠক মাত্রই জানেন যে মধ্য এশিয়ার মুগল-গন বীরের জাতি, যোদ্ধার জাতি। পৃথিবীর দুই মহাবীর, চেঙ্গীঁস খাঁ এবং তৈমুর লং এর রক্ত মুঘলদের ধমনীতে প্রবাহিত। বাহুবল মেধা ও মনন, প্রজ্ঞাও পান্ডিত্য দিয়ে মুঘলরা দেশের পর দেশ জয় করে গড়ে তুলেছেন সভ্যতা ও সংস্কৃতি। মুঘলরা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে তুর্ক-পার্সিয়ান সংস্কৃতির সংমিশ্রন, সমাহার করে ভারতীয় সভ্যতাও সংস্কৃতিকে সম্বৃদ্ধ করেছেন। মুঘলরা বীরের জাতি, যোদ্ধার জাতি-পলায়নের কোন ইতিহাস মুঘলদের নেই। স¤্রাট বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান এবং আলমগীর আওরঙ্গঁজেব প্রমুখ মুঘল স¤্রাটগন বুদ্ধি ও বাহুবলে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতঃ ভারতীয় পাঠান-আফগান-মারাঠা, রাজপুত শক্তির মোকাবিলা-প্রতিহত ও জয়লাভ করে সর্ব ভারত ব্যাপী মুঘল স¤্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করতঃ সারা ভারতকে এক প্রশাসনিক কাঠামোগত আওতায় আনয়ন করেছেন। ভারত ব্যাপী শান্তি-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছেন। শিল্প সংস্কৃিতর চিত্রকলা-নৃত শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বিশে^র দরবারে ভারতীয় মুঘল সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতবর্ষের ধনসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বৃটিশ ওলন্দাজ বিদেশী কোম্পানী সমূহ এদেশে ব্যাবসা বানিজ্যের জন্য বিভিন্ন সময় এসে সুবিধা করতে না পেরে সর্ব শেষে মুঘল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে স্যার টমাস রোঁ- নামক বিখ্যাত বৃটিশ কুটনীতিবিদ কলাকৌশল এবং বিভিন্ন তদবিরের মাধ্যমে ভারত স¤্রাটের সাথে সাক্ষাত করতঃ অনুনয় বিনয় ও কৌশলের মাধ্যমে ভারতে বৃটিশ কোম্পানীর ব্যবসা- বানিজ্য করার অনুমতি লাভ করলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নামক একটি বৃটিশ ব্যাবসায়ী প্রতিষ্টান ভারত বর্ষে ব্যবসা বানিজ্যের সুযোগ লাভ করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন বিনাযুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধে সুবেবাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়, পতন ও শাহাদাত বরনে ইংরেজ বনিকের মানদন্ড দেখাদেয় রাজদন্ড রূপে পোহালে শর্বরী। কোম্পানীর কেরানী রবার্ট ক্লাইভ হন, কর্নেল, লর্ড, ভারত শাসক। কালক্রমে ইংরেজরা ১৭৬১ সালে ফরাসী বাহিনী ১৭৯৯ সালে মহিশুরের বীর টিপু সুলতান এবং ১৮১৯ সালে মারাঠাদেরকে পরাজিত করে ভারতব্যাপী বৃটিশ শাসন মজবুত করার পরিকল্পনা করতে থাকে।
১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে কোম্পানী শাসন একশত বৎসর পূর্ন হল। এ সময় বৃটিশ দেশীয় সিপাহীগন কোম্পানীর এনফিল্ড রাইফেল নামক এক প্রকার বৃটিশ রাইফেল ব্যাবহারে অসম্মতি জানায় কারন এই রাইফেলের গুলির খোসায় যে চর্বি ব্যাবহৃত হত তা শুকরের। গুলির খোসায় মুখব্যাবহার করে গুলি খুলতে হত বলে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান সিপাহীগন এই গুলি ব্যবহারে অসম্মতি জানায় কারন শুকরের চর্বি ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জন্য নিষিদ্ধ দ্রব্য। কোম্পানীর দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ বপন হতে থাকে। ভারত বর্ষে বৃটিশ শাসন ভারতবাসী কখনও মনে প্রাণে মেনে নেননি। কোম্পানীর কতেক মোসাহেব চামচা চাটুকার-উপকার ভোগীহন ছাড়া ভারতবাসি কোম্পানী শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ১৮৫৭ সালে কোম্পানীর শাসন শতবর্ষ পূর্ন হলে লোক মুখে বলাবলি হতে থাকে শতবর্ষ পূর্ন হলে কোম্পানীর শাসন অবসান হবে।
১৮৫৭ সালের ১১ই মে একদল স্বদেশী সিপাহী কোম্পানী শাসনের বিরোধিতা করতঃ বাদসা সালামত জিন্দাবাদ, মুঘল বংশ দির্ঘজীবি হউক বলে দিল্লীর লাল কেল্লায় প্রবেশ করেন। দিল্লীর সিংহাসনে তখন আসীন শেষ মুঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ্। ১৭৫৭ সালে দিল্লীতে বাহাদুর শাহের জন্ম। তার পিতা মুঘল স¤্রাট দ্বিতীয় আকবর। ১৮৩৭ সালে পরিনত বয়সে বাহাদুর শাহ্ আবু জাফর সিরাজুদ্দীন মোহাম্মদ নাম ধারন করে নাম সর্বস্ব মুঘল সিংহাসনে আরোহন করেন। বাহাদুর শাহ্ রাজ্য জয়-রাজ্য শাসনের চাইতে শিল্প-সংস্কৃতি-কাব্য-কলার চর্চায় কালাতিপাত করতেন। মুঘল স¤্রাজ্য ও দিল্লী বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট স্কটিশ সাংবাদিক-গবেষক উইলিয়াম ডালরিস্প্যাল তার ৪৫৫ পৃষ্টার বিশাল গবেষনা গ্রন্থ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু অনুদিত “দি লাষ্ট মুঘলস” গ্রন্থে বাহাদুর শাহ প্রসঙ্গেঁ যথার্থই বলেন- “তিনি তার বংশের সবচেয়ে মেধা সম্পন্ন সহনশীল প্রকৃতির শাসকদের অন্যতম ছিলেন। তার মাঝে ছিল দক্ষ লিপিকার, সুফিবাদের অন্তঃ দৃষ্টি সম্পন্ন লেখক মুঘল সিনিয়েচার চিত্রকলার পৃষ্টপোষক উদ্যান তৈরীতে অনুপ্রেরনা দানকারী সৌখিন স্থপতি। একজন সুফি কবি যিনি, উর্দ্দূ, ফরসি ভাষাই নয় ব্রেজ ভাষাও পাঞ্জাবীতেও কবিতা রচনা করেছেন। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সাহিত্য ক্ষেত্রে রেঁনেসায় তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি চমৎকার গজল লিখেছেন। তার সময়ের বিখ্যাত কবিদেরকে পৃষ্টপোষকতা করেছেন যাদের মধ্যে গালিব ও জওক এর নাম উল্লেখযোগ্য। মাত্র পয়ত্রিশ বৎসর বয়সে বাহাদুর শাহ্ এর ব্যাতিক্রমি কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়- যা ছিল শেখ সাদির -গুলিস্থাঁ- কাব্য গ্রন্থের উপর সরেস কাব্যিক আলোচনা। মোহাম্মদ হোসেন আজাদের মতে“ কবিতার সাথে পাগলের মত প্রেম ছিল জাফরের-”। দুই হাজার বারো সালে বাহাদুর শাহের মৃত্যোর দেড়শত বৎসর পূর্ন হলে ঢাকাস্থ কাজি পাবলিসার্স এর স্বত্বাধিকারী একাত্তোরের বীর কবি ও প্রকাশক কাজি আব্দুল লতিফ সাজু গঠন করেন বাহাদুর শাহ্ স্মৃতি সংসদ। লেখক-গবেষক মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান মুজিব-কে আহ্বায়কের দায়িত্ব দিয়ে মুজিব বাহিনীর আকুতভয় বীর যোদ্ধা কমান্ডার সাজু নিজেই সদস্য সচিবের গুরু দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন। বাহাদুর শাহের দেড়শত-তম মৃত্যো বার্ষিকীতে স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্টিত হয়। মুজিবুর রহমান মুজিব রচনা করেন গবেষনা গ্রন্থ “স¤্রাট বাহাদুর শাহ: কর্ম্ম ও জীবন দর্শন”। গবেষনা গ্রন্থখানি উৎসর্গ করা হয় একাত্তোরের স্বাধীনতা সংগ্রামী তাত্বিক সিরাজুল আলম খানকে। দুই হাজার বারো সালের একুশের বইমেলায় গ্রন্থখানি প্রকাশিত পঠিত ও বহুল প্রসংসিত হয়।
আঠারোশ সাতান্ন সালের ভারতীয় আজাদী সংগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহীগন দিল্লীর ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় স¤্রাট বাহাদুর শাহকে যুদ্ধের নেতৃত্বভার গ্রহন করার আহ্বান জানালে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ্ হায়দরী হাঁক হাঁকেন। সকল ইতিহাস স্বাক্ষী স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে বৃদ্ধ বয়সেও যুদ্ধের নেতৃত্বভার গ্রহন করেন। তখন সর্বরত ব্যাপী তিনিই ছিলেন একমাত্র গ্রহনযোগ্য সর্ব্বজন শ্রদ্ধেয় যোগ্য শাসক। বিরাশি বৎসরের বৃদ্ধ স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ দিল্লীর ময়ূর সিংহাসনে বসলেন। দিল্লীর জুমা মসজিদে স¤্রাটের নামে খুতবা পাঠ হল। দেওয়ানী খাস-এ- আসর বসে দরবারি পরামর্শ ও স্বিদ্ধান্ত মোতাবেক স¤্রাটের পুত্র মির্জা মুঘলকে প্রধান সেনাপতি এবং শাহজাদা আবু বকরকে একটি দলের অধিনায়কত্ব দেয়া হল। দরবারে মহান মুঘল স¤্রাট কতেক শাহী ফরমান জারী করলেন। বিদেশীদেরকে ভারত থেকে বহিস্কারের ঘোষনা দিয়ে ইংরেজ শিশু ও নারীর প্রতি যুদ্ধের মাঝেও নির্দয়, নিষ্টুর না হতে নির্দেশ দিলেন- কারন পবিত্র ইসলাম ধর্ম কখনও শিশু ও নারী নির্য্যাতন সমর্থন করেনা। তাছাড়া স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ সিপাহীযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হলেও মানবিক গুন সম্পন্ন কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম ভাগে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিপুল বিজয় হলেও বহুবিধ কারনে শেষ রক্ষা হয়নি। স¤্রাটের শুভাকাঙ্খী ও পরামর্শকগন যুদ্ধের কৌশলগত কারনে দিল্লী পতনের আগে স্বসৈন্যে অযোধ্যায় আশ্রয় নিয়ে অধিকতর সৈন্য সংগ্রহ করতঃ পুনরায় যুদ্ধারম্ভের প্রস্তাব দিলে দিল্লী ও ভারত প্রেমিক বাহাদুর শাহ্ দিল্লী থেকে পালিয়ে যান নি। কোম্পানীর কাছে আত্বসমর্পন করে ত্রুটি স্বীকার করতঃ প্রাণ ভিক্ষাও চাননি। ইংরেজ মেজর হডসন বাহাদুর শাহ্ কে গ্রেপ্তার করে লাল কেল্লায় অসম্মান জনক ভাবে বন্দী করে রাখে। কাগজ কলম চেয়ে তা না পেয়ে কাটকড়ি দিয়ে লাল কেল্লার দেয়ালে হৃদয়ের রক্তক্ষরন ঘটান কবি বাহাদুর শাহ্। লিখেন মুঘল ট্রেজেডির মহাকাব্য “কিতনা বাদ নাসিব হ্যায় তু জাফর দাফন কে লিয়ে, দু-গজ জমিন ভি মিল নাসাকে সারি হিন্দুন্থানমে। লাল কেল্লায় প্রহসনের বিচারে বাহাদুর শাহ্ কে নির্বাসনের রায় হলে কোলকাতা বন্দর থেকে তাকে সমুদ্র গামী ষ্টিমারে উঠিয়ে বার্মায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৮৫৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর স¤্রাজ্ঞি জিনাত মহল সহ বাহাদুর শাহ্ রেঙ্গুঁনে পৌছেন। বিনা চিকিৎসায় অর্ধাহারে অনাহারে ১৮৬২ সালের ৭ই নবেম্ভর নির্বাসিত-হতভাগ্য স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ শেষ নিস্বাস ত্যাগ করতঃ মহান মৃত্যোকে আলিঙ্গঁন করে তাঁর ও আমাদের মহান মালিকের দরবারে হাজিরা দেন। স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ ও তার পরিবার বর্গের সমাধি এলাকা ছয় নম্বর থিয়েটার রোড নামে পরিচিত। তার কবর গাহে – কিতনা বাদনাসিব হ্যায তু জাফর- বিয়োগান্তক কবিতাটি খোদাই করে রাখা হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিঃ রাজিব গান্ধী রাষ্ট্রীয় সফরে বার্মা গেলে ভারত স¤্রাট বাহাদুর শাহের মাজার এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে রের্ঙ্গুঁন গমন করেন। ভারতের কাব্যানুরাগি প্রধান মন্ত্রী রাজিব গান্ধী (বর্ত্তমানে প্রয়াত) দর্শক বইতে যথার্থভাবেই মন্তব্য লিখেন-“ দু’গজ জামিন নাহি মিলে হিন্দুস্থান মে, ফির তেরী কোরবানীসে উঠি আজাদিকী আওয়াজ, বদনসিব তুন্যেহি জাফর জোড়া হ্যা তেরা নাম ভারতকি শান আওর শওকত মে আজাদীকি পয়গাম সে”-
ভারতের পন্ডিত প্রধানমন্ত্রী জ্ঞানী ও গুনী রাজিব গান্ধী ভারত স¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন- স্মরন করেছেন। আর এ কালের একজন পর্য্যটক না জেনে না বুঝে একজন আজীবন বীর লড়াকু সৈনিককে -পালিয়ে গেছেন বলে তার রুহের প্রতি অসম্মান করলেন যা নিতান্তই দূঃখ ও বেদনা দায়ক। রচনার একাংশ বাহাদুর শাহের অতৃপ্ত আত্বার অলৌকিক বা ভৌতিক ভাবে ফিরে আসার কাল্পনিক কাহিনীটিও অলীক-অবাস্থব-অগ্রহনযোগ্য বটে। ইসলাম ধর্মের বিধান মতে পূনর্জন্ম বা এই জাতীয় অলৌকিকতার বিধান নেই। স¤্রাট বাহাদুর শাহের সন্তানগন বার্মাও ভারতে সমাহিত। তিনি নিজে একজন সুফীবাদী সুন্নী মুসলমান। তাঁর রুহ প্রেতাত্বার মত পূনর্জন্ম গ্রহন করে মানবজাতিকে ভয় ভীতি প্রদর্শনের কোন কারন নেই।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভারতের সর্ব ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের আপোষহীন বীর যোদ্ধা আবু জাফর সিরাজ উদ্দীন মোহাম্মদ বাহাদুর শাহ্ এর উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি-রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
[ষাটের দশকের সাংবাদিক। একাত্তোরের মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব। কলামিষ্ট।]
মন্তব্য করুন