“সহজ সরল বন্ধু বৎসল সাদা মনের মানুষ বন্ধুরব মোস্তফা নূরুজ্জামান- মিনার ঃ ভালোবাসাও বন্ধুত্বের সুউচ্চ কুতুব মিনার: স্মরণ ও মাগফিরাত কামনা”
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ আমাদের মহান স্রষ্টাও প্রতিপালক দো-জাহানের খালিক-মালিক-সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালা মহাপবিত্র আসমানী কিতাব আল কোরআনে সুষ্পষ্টভাবে ঘোষনা করেন- “কুল্লিন নাফসিন যাইক্বাতুল মাউত” জগতের সকল প্রাণীকেই একদিন মৃত্যোর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে- মৃত্যোর সঙ্গেঁ আলিঙ্গঁন করতে হবে- মায়াময় এই মাটির পৃথিবী ছেড়ে একদিন চীরতরে চলে যেতে হবে না ফেরার দেশে। ক্ষনস্থায়ী এই মাটির পৃথিবী প্রসঙ্গেঁ সর্বকালের সেরা কবি ও দার্শনিক ইসলামি চিন্তাবিদ শেখ সাদি (র:) তাই যথার্যই বলেন-
“দুনিয়া
এহিত হ্যায়
এক মোসাফির খানা,
যানেহগা জরুর
কোয়ি আগে
কোয়ি পিছে।”
রুহের জগৎ আলমে আরওয়া থেকে হাসরের ময়দান পর্যন্ত মানবাত্বার ক্রমবিকাশের ধারার মধ্যে পৃথিবীর সময়টুকুই ক্ষনস্থায়ী। অনির্ধারিত। এই অনির্ধারিত সময়কে দেওয়ানী আইনের পরিভাষায় “এডিনটারিম পিরিওড” বলা যেতে পারে।
মহান মৃত্যো প্রসঙ্গেঁ আরো সহজ ও সরল করে বলা চলে যাওয়ার জন্যই মানুষের এই আসা। মাঝারি উচ্চতার, না হালকা পাতলা না মোটা ফিগারের গোলবাটা মুখ সমেত উজ্জল শ্যাম বর্নের মোস্তফা নূরুজ্জামান সতেরো সালের সতেরোই নভেম্বর শুক্রবার রাতে মাত্র আটষট্টি বৎসর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতঃ চীর তরে চলে যান না ফেরার দেশে। মৃত্যোকালে ভাই-ভাতিঝা-আত্মীয় স্বজন-বন্ধু-বান্ধব অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন মোস্তফা নূরুজ্জামান। তাঁর প্রিয় জীবন সঙ্গিঁনী লুৎফা জামান ইতিপূর্বেই মৃত্যোবরন করেছেন। মুস্তফা লুৎফা দম্পতি ছিলেন অপুত্রক। দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে
জামান দম্পতির কোন সন্তান জন্ম গ্রহণ করেনি। এই নিয়ে তাঁর কোন ক্ষোভ কিংবা আফসোস ছিল না। সে তাঁর স্ত্রীকে কিংবা লুৎফা ভাবি তাঁর স্বামীকে দোষারূপ করেন নি।
সর্বশক্ষিমান মহান আল্লাহ তায়ালার উপর নিজেদের ভাগ্যকে সমর্পন করে ছবর করেছে জামান দম্পতি। বংশ রক্ষার নাম করে দ্বিতীয় বিবাহের নামই নেন নি সুঠাম শরীরের অধিকারী সুদর্শন মোস্তফা নূরুজ্জামান। মুখে এক চিলতে মুচকি মিষ্টি হাসি। সাফারি স্যুটে দারুন মানাত ঝাকড়া বাবরি চুলের অধিকারী পদস্থ চাকুরে মোস্তফা নূরুজ্জামানকে। বানিজ্য বিভাগের মেধাবী ছাত্র জামান বানিজ্যে ¯œাতক ডিগ্রী নিয়ে নিজ এলাকা এন.জি.এফ.এফ (নেছারেল গ্যাস এন্ড ফার্টিলাইজার ফেক্টরি), ফেঞ্চুগঞ্জে একাউন্টস বিভাগে এ্যাসি: একাউন্টেন্ট হিসাবে যোগ দিয়ে কর্মজীবনের শুভ সূচনা ঘটিয়ে ছিলেন কাজের মানুষ সৎ ও মহৎ মানুষ মোস্তফা নূরুজ্জামান। সেটা স্বাধীনতা পূর্বকালের ষাটের দশকের শেষ ভাগের কথা।
স্বাধীনতা উত্তরকালে চন্দ্রঘোনাস্থ কর্ণফুলি পেপার মিলে বদলি হন মোস্তফা নূরুজ্জামান। চাকরি জীবনের সিংহভাগ সময় এখানেই কাটান এন.জামান। কোম্পানীর বিশালফ্ল্যাট, সম্মানজনক পদ-পদবী আর আকর্ষণীয় বেতনে হাসি আর গানে কাট ছিল সুখময় দিনগুলি। জামান দম্পতি তখনও নিঃসন্তান। নিজের দুঃখও বেদনাকে গোপন করে চাকরি সহকর্মী- বন্ধু বান্ধব-সংসার সমাজ সকলের সঙ্গেঁই সু-সম্পর্ক রাখতেন ভালো মানুষ মোস্তফা নূরুজ্জামান। পাহাড়, নদী সবুজের সমারোহে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অপরূপ লীলাভূমি চট্রলার চন্দ্রঘোনায় জীবন যৌবনের মূল্যবান উনিশ বসন্ত শেষে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসেন। চন্দ্রঘোনা অবস্থান কালে মোস্তফা নূরুজ্জামন নিজেকে বিলিয়ে দেন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ কর্মে। পিতা সরকারি কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান মরহুম ছিলেন একজন প্রতিভাবান কবি ও বিদগ্ধজন। গানবাজনা কবিতা ছিল তাঁর রক্তে। চন্দ্রঘোনার সাংস্কৃতিক অঙ্গঁনকে মাতিয়ে রেখেছিলেন কবি গীতিকার ও সাংস্কৃতিক সংঘটক মোস্তফা নুরুজ্জামান। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেও নিজেকে উজাড় করে দেন। এনজি.এফ.এফ ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে অতিঃ চীফ একাউটেন্ট হিসাবে কর্মজীবনের অবসান ঘটান কাজের মানুষ এম.এন জামান। অপুত্রক জামান দম্পতির টুনাটুনীর সুখময় দাম্পত্য জীবন ছিল- অবসরে এস কিঞ্চিত বিষন্নতায় পেয়ে বসে। বয়ো: বৃদ্ধির সাথে সাথে বার্ধক্য জনিত ব্যাধিও দূর্বলতায় পায় তাকে। ধর্ম কর্ম, গানবাজনা, কবিতার সাথে সাথে ছীপ দিয়ে মাছ ধরা তাঁর একটি বড় শখ ছিল, একজন সৌখিন মৎস্য শিকারি ছিল নূরুজ্জামান। যেখানেই যাবে ব্যাগ-ব্যেগেজ লাগেজের সঙ্গেঁ থাকাবে বৃহদাকৃতির একটি ব্রিফ কেস। এই ব্রিফ কেসে থাকত হুইল বর্শি এবং মাছ ধরার সরঞ্জামাদি, রাঙ্গাঁমাটি লেকে এই হুইল বর্শি দিয়ে বড় সাইজের মাছ ধরার জন্য ছুটির দিন কাটিয়ে দিত সৌখিন মৎস শিকারি জামান। এসব সুখময় স্মৃতির মিষ্টি মধুর গল্প কাহিনী থাকত তাঁর মুখে মুখে।
গেল বছর মৃদু হার্টএ্যাটাকে আক্রান্ত হল হৃদয়বান মোস্তফা নূরুজ্জামান। তাঁর সঙ্গেঁ প্রায়ই ফোনালাপ হত। এখানে এলে অবস্থান করতঃ তাঁরও আমার প্রিয় বন্ধু ষাটের দশকের প্রিয় সতীর্থ, আধুনিক কালে বেঙ্গঁল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব সৈয়দ ফারুক আহমদ এর বাস গৃহে। আন্তরিকতা ও আথিতেয়তায় ধর্মও সমাজ সেবক আলহাজ্ব সৈয়দ ফারুক আহমদ এর জুড়ি নেই। তাঁর ও আমার প্রিয় বন্ধু ঐ দশকে ঐতিহ্যবাহী এম.সি কলেজে আমার সেকেন্ড ব্লকে প্রিয় রুমমেট অবসর প্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর সৈয়দ ফজলুল্লাহ এবং সৈয়দ ফারুক আহমদের বাসা মুখোমুখি-কাছাকাছি। ফলত বাসা কিংবা বেঙ্গঁল চায়নিজে আমাদের প্রিয় বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার কফিল উদ্দিন এবং বন্ধুবর শহীদুর রাজা সমেত আড্ডা ও ধর্মালোচনা জমত দারুন। এম.এন.জামানের অসুখের সংবাদ শুনে ফোনে তাকে পরামর্শ দিলাম হার্টএ্যাটাক-ব্লক-এখন কোন ব্যাপারই নয়। মহান আল্লাহর মেহের বানীতে চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেকদূর এগিয়েছে। এই সত্তরোর্ধ আমি নিজেও এখন বহুবিধ ব্যাধিতে আক্রান্ত। এখন “গাড়ি চলে না চলে না রে” এর মত অবস্থা। নিয়মিত দোয়া-দূরুদ, জমজমের পানি ও চিকিৎসা সেবার উপর আছি।
আমাদের মৌলভী-র বন্ধু মহল তাকে গিয়ে দেখে এলেন। বক্ষ ব্যাধি ব্লাড প্রেসার জনিত অসুস্থতার কারনে সড়ক পথে ভ্রমন আমার জন্য খুবই কষ্টদায়ক। আমি পরমর্শ দিলাম হার্ট ফাউন্ডেশনের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর ডাঃ খালেদ মহসিনকে দেখাতে। তিনি আমার ও চিকিৎসক। রুগীর প্রতি খুবই আন্তরিক ও দায়িত্ববান ডক্টর খালেদ মহসিন। বাইপাশ সার্জারি কিংবা রিং ফিটিং এখন খুবই সহজতর চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু মহান মালিক যার যে সময় মৃত্যো নির্ধারিত করে রেখেছেন তাঁর ব্যতিক্রম করা কিংবা ব্যত্বয় ঘটানোর ক্ষমতা কারো নেই। অবশেষে সতেরোই নভেম্বর সতেরো সালে মুত্যোর কাছে আত্বসমর্পন করেন ভালো মানুষ মোস্তফা নূরুজ্জামান-আমাদের প্রিয় বন্ধু মিনার। মিনারের একজন চাচাতো ভ্রাতা আমার একমাত্র কন্যা জেনিফার রহমানের কলিগ। উভয়েই সাউথ ইষ্ট ব্যাংক মৌলভীবাজার প্রধান শাখার কর্মরত। আমার কন্যার কাছ থেকেই বন্ধুবর মিনার এর মৃত্যো সংবাদ পাই। অসুস্থতাও দূর্বলতার মাঝেও ফেঞ্চুগঞ্জে তাঁর নামাজে জানাজায় যোগদানের সিদ্ধান্ত নেই। বন্ধুরব আলহাজ্ব সৈয়দ ফারুক আহমদ এর সঙ্গেঁ যোগাযোগ করি। তিনিও তাঁরাও জানাজায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জানা গেল মৃত্যো কালে বন্ধুবর মোস্তফা নূরুজ্জামান ওছিওত করে গেছেন তাঁর জানাজায় যেন ইমামতি করেন তাঁরও আমাদের প্রিয় বন্ধু সরকারি কলেজের অবসর প্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও মননশীল লেখক প্রফেসর আলহাজ্ব সৈয়দ ফজলুল্লাহ। মানুষ মৃত্যো কালে তাঁর জানাজার নামাজে ইমামতি, মোনাজাত ও দোয়ার জন্য কোন বরন্যে আলেম-ওলামা-ইমাম-মোয়াজ্জিন-ক্বারী-হাফেজ কিংবা কোন স্বজন যেনো নামাজ পড়ান, কিন্তু বন্ধু বৎসল জামান কউল- করে গেলেন উল্লেখিত গনকেহই নহেন তাঁর প্রিয় বন্ধু সৈয়দ ফজলুল্লাহই যেন জানাজার নাজাম পড়ান-দোয়া করেন। মরহুম বন্ধুবর মিনারের বন্ধু প্রীতিতে আমরা বন্ধু মহল প্রীত-আবেগ আপ্লুত হলাম। গৌরবান্বিত বোধ করলাম। শারীরিক দূর্বলতার কারনে আমার যাওয়া হলনা বন্ধুবর সৈয়দ ফারুক আহমদ এর গাড়ী যোগে আমাদের বন্ধু মহল মৌলভীবাজার জেলা সদর ¬
থেকে ফকির পাড়া ফেঞ্চুগঞ্জে রওয়ানা হলে পথেই বন্ধুবর সৈয়দ ফারুক অসুস্থ হয়ে পড়েন, ফলত: তাঁর আর যাওয়া হয়নি। আমাদের বন্ধু মহল গেলেন। মূর্দার ইচ্ছা মোতাবেক সৈয়দ ফজলুল্লাহ জানাজার নামাজে ইমামতি করলেন, তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করলেন। নামাজে জানাজা শেষে মোস্তফা নূরুজ্জামানকে ফকির পাড়ায় তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে পিতা মরহুম আখতারুজ্জামান এবং মাতা মরহুমা একলিমুন্নেছা খাঁনমের কবরের পাশে শ্যামল মাটির কোমল বিছানায় চীর শয়ানে শায়িত করা হয়। নামাজে জানাজায় যেতে না পারার কারনে আমি বন্ধুবর সৈয়দ ফারুক আহমদ এর কাছে প্রস্তাব করি একদিন তাঁর কবর যিয়ারতে যাব। তাঁর পরিবার বর্গের সঙ্গেঁ সাক্ষাত করব। হৃদয়বান সৈয়দ ফারুক আহমদ আমার প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি জানালেও তাৎক্ষনিক ভাবে যাওয়া হল না। ইদানিং তিনি শারীরিক অসুস্থতা ও দূর্বলতায় ভূগছেন, ডাক্তারি চিকিৎসায় আছেন, বিশ্রাম নিচ্ছেন, আমি তাঁর সাথে সাক্ষাত সঙ্গঁ দেয়া, নামাজ আদায় ও হাদীস পর্যালোচনার জন্য তাঁর বাসার সম্মুখস্থ দর্জির মহল জামে মসজিদে জামাতে এশার নামাজ আদায় করি। হাদীস শুনি। মোনাজাতে শরীক হই। সর্বশেষে আমরা বন্ধু মহল বেঙ্গঁল চায়নীজ-এ-নৈশকালীন আসর বসাই। হৈ হোল্লুড়-ছাদ ফাটা হাসি না হাসলেও মুখোমুখি চুখাচুখি হই। ফেলে আসা মধুময় স্মৃতিময় দিন গুলির কথা স্মরণ করি। কখনও বা কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেল হায় সোনালী দিনগুলি সেই-বিখ্যাত গান শুনে আবেগ আপ্লুত হই।
মরহুম বন্ধুবর মোস্তফা নূরুজ্জামানের চীর তরে চলে যাওয়ার বর্ষপূর্তিও হয়ে গেল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মরহুমের কবর যিয়ারতে যাব ইনশাল্লাহ। সেই মর্মে আমি বন্ধুরব সৈয়দ ফারুক আহমদ, সৈয়দ ফজলুল্লাহ এবং শহীদুর রাজা সহ সম্প্রতি একদা বাদ জোহর ফেঞ্চুগঞ্জ রওয়ানা হই। বন্ধুবর মিনারের কনিষ্ট ভ্রাতা আব্দুল্লা সামসুজ্জামানকে ফোনে সেই সংবাদই জানিয়ে দেয়া হল। সৈয়দ ফারুক আহমদ এর আকর্ষনীয় ফ্রেশ ফিন্ডার গাড়িতে ফেঞ্চুগঞ্জ যেতে খুব একটা কষ্ট হল না শুধুমাত্র সৈয়দ ফারুক অস্বস্থি বোধ করছিলেন। মিনারের কনিষ্ট ভ্রাতা দিনার তাঁর স্ত্রী এবং দুই সন্তান আমাদেরকে সাদর সম্ভাসন জানিয়ে সাদরে গ্রহণ করলেন। বৈকালিক নাস্তাসহ আদর আপ্যায়ন করলেন। দিনার দম্পতি ও সন্তানদের জন্য উপহার হিসাবে সৈয়দ ফারুক আহমদ বেঙ্গলের তৈরী প্রচুর খাদ্য সামগ্রী নিলেন। তাজা, হালাল ও মুখরোচক খাবার দাবারে বেঙ্গঁল ফুড একটি বিশ্বস্থ নাম। বেঙ্গঁলের প্যেকেট পেয়ে দিনার দম্পতির দুই ফুটফুটে সন্তান খুবই খুশী হল। সামাজিকতাও আপ্যায়নে আমাদের প্রিয় বন্ধু সৈয়দ ফারুক আহমদ বাদশাহী হৃদয় ও দরাজ দিল আছে তাই তাঁকে বাদশা ফারুক বলে ডাকি। মিশরের বাদশা ফারুক আর নেই। বাদশাহীও নেই কিন্তু আমাদের বন্ধু সৈয়দ ফারুক আহমদ তাঁর ধর্মানুরাগ, আল্লাহ রসূল ও মানব প্রেম, নিঃস্বার্থ সমাজ কর্ম ও সমাজ উন্নয়ন, কর্ম সংস্থান, দারিদ্রের বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে ইতিবাচক অবদান রেখেছেন-রাখছেন, সমাজ বিকাশের স্থানীয় ইতিহাসে তা অমর অম্লান হয়ে থাকবে-অনাদি-অনন্তকাল। এই প্রিয় বন্ধুর সুস্বাস্থ্য দীর্ঘয়ূ ও কল্যান কামনা করছি।
জানলাম ও শুনলাম অপুত্রক ও বিপতিœক বন্ধুবর মোস্তফা নূরুজ্জামান মিনার জীবনের শেষ দিন গুলিতে তাঁর ভাই, ভ্রাতৃবধু ভ্রাতস্পুত্র গণের সেবা শুশ্রসাও মায়া মমতা পেয়েছে। তাঁর স্বজনগণ তাকে বুঝতে দেননি যে, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা কেউ নেই। আমরা বন্ধু মহল মিলে বন্ধুবর মোস্তফা নূরুজ্জামান মিনার এর কবর যিয়ারত করলাম। আমি ইতিপূর্বে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করে তাঁকে উৎসর্গ করেছি। উপহার দিয়েছি। যিয়ারত শেষে প্রফেসর সৈয়দ ফজলুল্লাহই মোনাজাত করলেন। মিনারের ভাই দিনার ও তাঁর স্ত্রী জানালেন তাঁদের মরহুম ভ্রাতার ইচ্ছাও দাবী আমাদেরকে মৌলভীবাজারি বন্ধু মহলকে যেনো দাওয়াত খাওয়ানো হয়। আমরা আবার আবেগ আপ্লুত হলাম। তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করলাম। বন্ধুবর সৈয়দ ফারুক আহমদ এর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে নিজ শহর অভিমুখে রওয়ানা হলাম।
রাস্তায় সৈয়দ ফারুক আহমদ অসুস্থবোধ করলেন। রাস্তায় তারই মালিকানাধীন রাঙ্গাঁউটি রিসোর্টে উঠলাম। বিশ্রাম নিলেন। নিলাম। মাগরিবের নামাজ এখানেই আদায় করলাম। সৈয়দ ফজলুল্লাহ নামাজ পড়ালেন। দোয়া করলেন।
মোস্তফা নূরুজ্জামান ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তর সিলেটের প্রাচীন জনপদ ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলাধীন ফকিরপারা গ্রামের এক সম্ভান্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের কৃতি সন্তান। চৌষট্টি সালে মৌলভীবাজার সরকারি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এস.এস.সি পাশ করে। ফেঞ্চুগঞ্জে জন্ম, সিলেটে আত্মীয় স্বজন থাকলেও মৌলভীবাজার তাঁর খুব প্রিয় স্থান ছিল। সময় ও সুযোগ পেলেই সে এখানে ছুটে আসত। বৈবাহিক জীবনে সে এ জেলার জামাই হয়। তাঁর শ্বশুড় বাড়ি শ্রীমঙ্গঁল উপজেলায়। ইতিপূর্বে তাঁর সঙ্গেঁ আমার পরিচয় ও সম্পর্ক থাকলে ও তাঁর সঙ্গেঁ সখ্যতা ও আন্তরিকতা গড়ে উঠে এম.সি কলেজের ছাত্রাবস্থায়। আমাদের জেলা বাসির মধ্যে ঐ সময় কলেজ এর ছাত্র ছিলাম আমি নিজে, অগ্রজ প্রতিম ফয়জুর রহমান, আব্দুল ওয়াহিদ, রসময় মোহান্ত, সৈয়দ ফজলুল্লাহ, আতাউর রহমান তরফদার, আহমেদুর রহমান ফজলুল্লাহ হক তরফদার প্রমুখ। আমরা অনেকেই এম.সি ইন্টার মিডিয়েট কলেজের নব প্রতিষ্টিত হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। আমাদের হাউস টিউটার ছিলেন বিজ্ঞানে শিক্ষক আব্দুল মজিদ। তিনিও আমাদের জেলাবাসী ছিলেন। তখন দেশে আয়ূবী স্বৈর শাসন। শক্তি শালী রাজনৈতিক সংগঠন না থাকলেও ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্র শক্তি ইত্যাদি ছাত্র সংগঠনসমূহ-ছাত্র- গণআন্দোলন পরিচালনা করতেন। মোস্তফা নূরুজ্জামানের ডাক নাম ছিল মিনার। আমরা বন্ধু মহল তাকে মিনার নামেই ডাকতাম। আমি, মিনার, তরফদার, রা ছাত্রলীগ কর্মি ছিলাম। প্রতিবাদী ছিলাম। মিটিং-এ-মিছিলে যেতাম। আমাদের হোস্টেলের ছাত্র সমাজের দাবী দাওয়া নিয়ে হাউস টিউটার আব্দুল মজিদ সাহেব সঙ্গেঁ আমাদের মত পার্থক্য হল। সুদর্শন মজিদ সাহেব খুবই ভদ্র ও বিনয়ী ছিলেন। আমাদের ন্যায্য দাবী দাওয়া না মানায় আমাদের স্বদেশী স্যারের সঙ্গেঁ ঝগড়া বিবাদও বেআদবী না করে আমরা সদলবলে হোস্টেল ত্যাগ করে চলে যাই। মেজর টিলার পাশে বাসা ভাড়া নেই। হোস্টেল ত্যাগের সময় আমরা প্রতিবাদ সভা করি। সুস্থ ও শ্লীল ভাষায় স্যারের কঠোর সমালোচনা করি। প্রতিবাদ সভায় মোস্তফা নূরুজ্জামান মিনার রচিত-মিনার গীতি-গাওয়া হয়। মিনার গীতি গেতে গেতে আমরা মিছিল সহকারে হোস্টেল ত্যাগ করি। সেই বিদায়ী দৃশ্য ছিল খুবই করুন। আমি ও মিনার তখন কবিতা ও ছড়া লিখতাম। আমাদের হোস্টেলে সজিব নামে কালা ভীম ও ভের কাটা মার্কা বয় ছিল। আমার নামের সঙ্গেঁ মিল থাকায় মিনার বেয়ারার সজিব ও আমাকে নিয়ে কবিতা লিখল।
-মুজিব মুজিব
তোর ভাই সজিব-
হোস্টেলের খাবার খেয়ে আমাদেরও অসুখ বিসুখ লেগে থাকে। আমি জিন্দাবাজারি ডাক্তার খালেদ সিরাজকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম। এত বছর পর এই জীবন সায়াহ্নেও আমাদের ষাটের দশকী বন্ধু মহলের আসর বসলে বন্ধুবর প্রফেসার সৈয়দ ফজলুল্লাহ আমার সেই কবিতাটি আওড়ান। মেজর টিলা সংলগ্ন বাসায় আমাদের বেশিদিন থাকা হয় নি। আমরা এম.সি কলেজ হোস্টেলে চলে আসি। আমি সিট পাই ঐতিহ্যবাহী সেকেন্ট ব্লকে। রুমমেট হিসাবে পাই বন্ধুবর সৈয়দ ফজলুল্লাহকে। একজন আদর্শ মানুষ। ভালো ছাত্র। গ্রন্থ কীট বলতে যাবুজায় তাই, তখন আমি যা ছিলাম না, এখন অবশ্য আমি বই পুস্তক নিয়েই দিন কাটাই। লিখি। প্রকাশ করি। লেখাপড়াও হোস্টেল জীবনে রুমমেট সৈয়দ ফজলুল্লাহ আমাকে বহুবিধ সহযোগিতা করেছেন- সহায়তা দিয়েছেন। কলেজ জীবন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি ল’কলেজে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে আমরা যার যার মত ছিটকে পড়ি, ছড়িয়ে যাই, তখন মোবাইলের যুগনা হলেও বন্ধু মিনার এর সঙ্গেঁ আমার যোগাযোগ অটুট ছিল। ষাটের দশকের ভালোবাসাও বন্ধুত্বে বন্ধন দিনদিন মজবুত-অটুট হয়েছে। কোন দিন ঝগড়া বিবাদ-মনকসাকসি হয় নি। বহুমাত্রীক প্রতিভার অধিকারী ছিল মোস্তফা নূরুজ্জামান। তাঁর দেশও মানব প্রেম, ধর্মানুরাগ, ধর্মকর্ম, সমাজ সেবা, বন্ধু বৎসল্য স্মরণ রাখার মত। সে সম্ভান্ত শিক্ষিত স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও তাঁর মধ্যে কোন অহংকার, অহংবোধ ছিল না। বরং মিনার ছিল সহজ সরল সাদা মনের মানুষ, সৎ মানুষ। ভ্রষ্টাচার,বানিজ্যায়ন, দূবৃত্তায়ন এর জোয়ারের মাঝে সে ছিল অসম্ভব কর্মের সৎ ও কর্মঠ কর্মকর্তা। আজীবন টাকা আনা পাই এর হিসাব কসে জীবনে সরকারি একটি পয়সা আত্বসাত অপচয় করে নি। টাকার চেয়ারে বসে ঘুষ খায়নি। কমিশন বানিজ্য করেনি। আমার জেলার জামাই বলে মাঝে মধ্যে আমি তাকে দুলাভাই বলে ডাকতাম সে আমাকে শালা ডাকত যদিও এই ভূবনে আমাকে শালা ডাকার কারো সুযোগ নেই। কারণ আমার কোন বড় বোন নেই। খালাত পাড়াত দুলাভাই থাকলেও আমার এই বার্ধক্যে তারা ও কবর বাসি।
সৎ মানুষ, ভালো মানুষ বন্ধুবর মোস্তফা নূরুজ্জামানের একমাত্র কাব্য গ্রন্থ- আবার তোরা মানুষই”। ছয় সালে বিশিষ্ট কবি সমুদ্র গুপ্তের ভূমিকা সম্বলিত বনসাই প্রকাশনের প্রকাশনা-আবার তোপ মানুষই-তারই হৃদয়ের রক্তক্ষরন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাবনানুভূতিরই বহিঃ প্রকাশ। বন্ধুবর মিনার আর নেই, বেঁচে থাকবে তাঁর এই কাব্য গ্রন্থ। অনেক দিন বহু দিন। সহজ সরল বন্ধু বৎসল বন্ধুবর মোস্তফা নূরুজ্জামান মিনার তাঁর মানবিক গুনাবলি-ধর্মাচারও ধর্মানুরাগ, সহজ সরল বিনয়াচরন, বন্ধু বৎসল্য সততা ও ন্যায় পরন্যবতার জন্য আমাদের হৃদয়ে, স্মৃতির মনিকোঠায়, বেঁচে থাকবেন অনাদি অনন্ত কাল। আমার মত তিনি বেঢপ ছ’ুফুটি লম্বা ছিলেন না, ছিলেন বেটে খাটো, হালকাপাতলা কিন্তু তাঁর ধর্মও কর্মের কারনে তিনি ছিলেন ভালোবাসাও বন্ধুত্বের সু-উচ্চ কুতুব মিনার যা দেখা যায়, ছোয়া যায় নি।
তাঁর প্রথম মৃত্যো বার্ষিকীতে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি, মহান মালিকতার বেহেশ্ত নসীব করুন-এই মোনাজাত করছি।
[মরহুমের সহপাঠিও বিশিষ্ট বন্ধু। মুক্তিযোদ্ধা। সিনিওর আইনজীবী। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।]
মন্তব্য করুন