সহজ সরল সাদা মনের মানুষ নির্লোভী মুজিব সৈনিক সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমদঃ প্রথম মৃত্যোবার্ষিকীর মোনাজাতঃ সৈয়দ ভাই ঃ ভুলিনাই-ভুলি নাইঃ আপনি আছেন আমাদের অন্তরেঃ অনুভবে ॥
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ উনিশে এপ্রিল বুধ বার বিশিষ্ট আইনজীবী সহজ সরল সাদা মনের মানুষ নিখাদ ও নির্লোভ মুজিব সৈনিক এডভোকেট সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমদ এর প্রথম মৃত্যোবার্ষিকী। গেল বছর ষোল সালের এই দিনে ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এই মায়াময় পৃথিবী ও আমাদেরকে ছেড়ে চীর বিদায় নেন চীর সবুজ-চীর চেনা আমাদের সবার প্রিয় সৈয়দ ভাই। ছাফ গুরিয়ানা ফর্সা চেহারায় ছ’ফুটি দীর্ঘ দেহী সুদর্শন মিষ্টভাসি সৈয়দ কামাল ছিলেন একজন আকর্ষনীয় ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। সত্তোরের কোঠায় এসেও কাজে-কর্মে কথায়-বার্তায় প্রাণ প্রাচুর্য্যে ভরপুর। উন্নত নাসিকা গোলবাটা মুখ। সফেদ সাদা এক মুখ ছাফ দাড়ি-অনেকটা পঞ্চম জর্জীয় ষ্টাইলে। মাথায় বাহারি বাবরিচুল। তার উপর আকর্ষনীয় গোল ক্যাপ। অফিসিয়াল পোষাক ড্যুটেড-বুটেড হলে সাহেবী ঢং ও কায়দা কানুনে যেমন মানাত তেমনি তার প্রিয় পোষাক সাদা পাজামা পাঞ্চাবি ও কালো মুজিব কোটে তাকে মানাত দারুন। শুধু নেতা-নেতা ভাব নয় তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত জননেতা-পাঁচ দশকের পরিচিত মুজিব সৈনিক। নির্লোভ নির্মোহ। নিরঅহংকারি। হাইব্রীড কাউয়া কিংবা ফার্মের মুরগী মার্কা আওয়ামীলীগার ছিলেন না পাঁচ দশকের পরিক্ষিত মুজিব সেনা। নিখাদ ও খাঁটি আওয়ামীলীগার ত্যাগী রাজনীতিবিদ আলহাজ্ব সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমদ। সত্তোর এর কোঠায় এসেও সর্দি কাশি ছাড়া খুব একটা রুগবালাই ছিলনা সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমদ এর। এমনকি বার্ধ্যক্য জনিত ব্যাধিও দূর্বলতাও নয়। রুগী নিয়ে ভারত বর্ষে গেলেন তিনি। এলেন যখন তখন এমনিতে রুটিন চেক আপ করালেন। ধরা পড়ল ঘাতক ব্যধি কেন্সার। প্রাথমিক পর্য্যায় বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিলনা। তবুও চিকিৎসা শুরু হল। কিন্তু ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার বলে কথা-শেষ রক্ষা হল না-চীর বিদায় তাকে নিতেই হল। তার মৃত্যো সংবাদে জেলাবার ও তার পরিচিত ভুবনে শোকের ছায়া নেমে আসে। জেলা বারের সাবেক এবং বর্তমান সম্পাদক বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট মিজানুর রহমান সহ ছুটলাম কুলাউড়া শহরে-তাঁর বাসায়। তাকে শেষ দেখা দেখতে। চীর বিদায় জানাতে। তার প্রিয় বিশাল বাসাবাড়িটি লোকে লোকারন্য। সর্বত্র শোকের ছায়া। আকুল কান্না। অশ্রুপাত। তার বাসগৃহের ড্রয়িং রুমে উত্তর ছিরানা-করে শায়িত তিনি। যেনো ঘুমিয়ে আছেন। লন্ডন থেকে আগত প্রিয় পুত্র সদ্য প্রয়াত পিতার লাশ আগলে ধরে বিলাপ করছে। আমাকে দেখেই হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে বল্ল-মুজিব চাচা গত কালকেও আব্বু আপনার কথা বলেছে-দেখতে চেয়েছেন। দীর্ঘদিনের পরিচিত প্রিয় বন্ধুর চোখবুজা মরা মুখ দেখলাম। অশ্রুপাত করলাম দোয়া দূরুদ করলাম। কদিন পূর্বে তাকে দেখে গিয়েছি। তাঁর অবস্থা খারাপ হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেটে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিলেটেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঐ দিন কুলাউড়া ষ্টেডিয়ামে বিশাল জানাজা শেষে তাদের পারিবারিক গোরস্থানে তাকে চীর শয়ানে শায়িত করা হয়। এই এক বছরে তাঁর কবরের মাটি শুকিয়ে গেছে। গজিয়েছে দূর্বা ঘাস। হয়ত ফুটেছে নাম না জানা অনেক ঘাসফুলও। তাঁর ছবি এখন তাঁর প্রিয় বাসগৃহের দেয়ালে। তার প্রিয় জীবন সঙ্গিনী বেগম সৈয়দ কামাল হয়ত শাদা শাড়ি পরিধান করে নীরবে অশ্রুপাত করছেন। বেদনার প্রহর গুনছেন। তেলাওত-দোয়া-দূরুদ করছেন। মহান মালিক বন্ধু সৈয়দ কামালের আমাদের প্রিয় সৈয়দ ভাইর বেহেশত নসীব করুন। ভাবী সাহেবার সকল শোক শক্তিতে পরিনত হউক পুত্র কন্যাগণকে সবর করার তৌফিক এনায়েত করুন। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে মহান মালিকের দরবারে এই মোনাজাত।
পঞ্চাশের দশকের শেষ ও ষাটের দশকের শুরু থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমদ এর সঙ্গে আমার পরিচয় সম্পর্ক ও সখ্যতা। তিনি আমার কিঞ্চিতবয়োঃকনিষ্ট ছাত্র হিসাবে বছর দুয়েক জুনিওর ছিলেন। কিন্তু তার দেশ ও দল প্রীতি এবং সারল্য সকলকেই আকর্ষন করত। তার মিষ্টি চেহারাও মার্জিত বিন¤্র আচরনে আমিও আপ্লুত হলাম। ষাটের দশকে মৌলভীবাজার কলেজ ছাড়া আর কোন কলেজ ছিল না, ফলতঃ কলেজ পড়–য়াগণকে এখানেই আসতে হত। তখন ছাত্র ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ছিল। আমি ঐ সময় প্রথমে কলেজ শাখা ছাত্রলীগ অতঃপর মহমুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই। ফলতঃ সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কারনে অনেকের সঙ্গে, সম্পর্ক হয়ে যায়, সকলের কথা মনে না থাকলেও কুলাউড়ার বন্ধবর গিয়াস উদ্দিন আহমদ এবং সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমদ-দের, কথা মনে থেকে যায়।
৬৮ সালে গ্রেজুয়েশন ডিগ্রীনিয়ে আমি আমার পিতা-মাতার ইচ্ছা ও আদেশে এম এ এবং ল’ পড়ার জন্য ঢাকা চলে যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্স-এ-ভর্তি হই। তখন থেকে কুলাউড়া ও সৈয়দ কামাল এর সঙ্গে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যদিও ঐতিহ্যবাহী কুলাউড়া আমার তিন বোনের বাড়ি ও অসংখ্য বন্ধু বান্ধব আছেন-আসাযাওয়া আছে।
স্বাধীনতা উত্তরকালে আমি অধ্যয়ন শেষে আইনে ডিগ্রী নিয়ে আমাদের বারে যোগদেই, তিনি শিক্ষকতায় যোগ দিলেও পরবর্তী কালে আইনে ডিগ্রী নিয়ে জেলা বারে যোগদেন। আইন পেশায় তিনি আমার দেড় দুই দশকের জুনিওর হলেও আমরা আবার সেই ষাটের দশকের সম্পর্কের সুবাদে চলা ফেরা শুরু করি। গলায় গলায় ভাব ছিল আমাদের। রাজনীতিগত ভাবে আমরা ভিন্নমতালম্বী হলেও সারা আদালত পাড়ায় একমাত্র আমরা দুজন একে অন্যের গলায় জড়িয়ে ধরে হাটতাম। আমি লম্বা পায়ে লম্বা কাইক দিতাম বলে তিনি আমার সঙ্গে হাটতে পারতেন না-তিন তলায় জজ কোর্টে উঠতে হাফিয়ে যেতেন। আমরা বসতাম এক ভবনে। নামাজ পড়তাম এক মসজিদে। এক সাতে আমি জেলা জামে মসজিদের সেক্রেটারি হিসাবে এক কোনায় চার-পাঁচটি চেয়ার বিছিয়ে রাখতাম অসুস্থতার কারনে চেয়ারে বসে নামাজ পড়তে হয়। আমি তিনি, এডভোকেট মির্জা সিরাজ উদ্দীন বেগ, এডভোকেট তজম্মুল হোসেন, এডভোকেট আর আর চৌধুরী প্রমুখ। বন্ধুবর তজম্মুল হোসেন চীরতরে চলেগেছে গত মাসে। সৈয়দ ভাইর একবছর হয়ে গেল। দুটি চেয়ার খালি হয়ে গেছে। একদিন আমার চেয়ারও খালি হয়ে যাবে-চলেযেতে হবে এটাই নিয়ম।
বন্ধু বৎসল, সৎ ও সহজ-সরল সাদা মনের মানুষ সৈয়দ কামালের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে নফল নামাজ আদায় করেছি-দোয়া করেছি-বাদ জোহর আমাদের জেলা জামে মসজিদে তার জন্য দোয়া হয়েছে।একজন সৎ মানুষ সৈয়দ কামাল উদ্দীনের প্রথম মৃত্যোবার্ষিকীতে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন-এই মোনাজত সহ আমীন।
(সেক্রেটারী, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিওর এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট)
মন্তব্য করুন