সানজব হত্যাকারীর ফাঁসি চায় হাজীপুরবাসী
সৈয়দ ছায়েদ আহমদ॥ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের সানজব আলী হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার দাবী করেছে গ্রামবাসী ও তার পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে এ হত্যাকান্ডের মূল হোতা মেম্বার ফজর আলী, তার ছেলে খোকন ও ভাতিজা নজমুলকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন তারা। এদিকে সানজব হত্যাকান্ডের পর থেকে পুলিশের ভয়ে এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে সানজব হত্যাকারীরা। পুলিশ এখনও পর্যন্ত তাদের ধরতে পারে নি। গ্রামবাসীর দাবীর চাপে এখন উত্তাল কালাপুর ইউনিয়নের চারপাশ। আসামীদের ফাঁসি চেয়ে পুরো এলাকা জুড়ে আসামীদের ছবি সম্বলিত পোষ্টারে ছেয়ে গেছে। সানজবের মৃত্যুতে একদিকে যেমন এলাকাবাসী মধ্যে শোকের ছায়া বিরাজ করছে অন্যদিকে তার বৃদ্ধ পিতা, স্ত্রী আর ৪ কন্যা সন্তানের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকরের ছায়া। পরিবারের একমাত্র উপার্জানশীল ব্যক্তি সানজবকে হারিয়ে তাদের আর্ত-চিৎকারে মলিন হয়ে উঠেছে চারপাশ। সকলের দাবী এখন একটাই খুনী মেম্বার ফজর আলীকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে ফাঁসি চাই।
যেভাবে নিহত হলেন সানজব :
সরেজমনি হাজীপুর গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি হাজী মনির মিয়া, হাজী আরেফিন আলী, শিক্ষক শামসুদ্দিন, হাজী মস্তাব উদ্দিন, হাজী বুরহান উদ্দিন সহ আরো অনেকের সাথে আলাপ করে জানা যায়, হাজীপুর গ্রামের ৩০/৪০টি পরিবারের যৌথ মালিকানাধীন একটি ফিসারীর ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত হয়। ফিসাররী টি হাইল হাওরের হাজীপুর এলাকার প্রায় একশ কেয়ার আয়তনের হবে। এই ফিসারীর জমির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গত ২৯ মার্চ সকাল ১১টায় হাজীপুর গ্রামের হাজী মছদ্দর আলীর বাড়ীর উঠানে এক সালিশ বৈঠক বসে। বৈঠকে কালাপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মজুল সহ এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন। বিচারের এক পর্যায়ে জমির মালিকানা কাগজপত্র নিয়ে কথাকাটাটির এক পর্যায়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হলে বিচার মূলতবী করা হয়। ঐদিন বিকেল আড়াইটায় নিহত সানজব আলী হাজীপুর বাজারে বাজার করতে যান। বাজারের কাছা কাছি যাওয়ার প্রাক্কালে মেম্বার ফজর আলী তার দলবল নিয়ে সানজবের পিছু নেয়। তখন সানজব প্রাণ রক্ষার্থে দৌঁড় দিয়ে ডুবাই প্রবাসী আব্দুল জলিলের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। তখন মেম্বার ফজর তার দলবলকে হুকুম দেয় “কুত্তার বাচ্চা কে ধর, খুন কর তারে”। এর পরেই মেম্বারের ছেলে খোকন ও চাচাতো ভাই আছান দুজনে সানজব আলীকে ধরে রাখে আর মেম্বার ফজর আলী তার মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। নাজমুল নামে তাঁর ভাতিজা লোহার সাবল দিয়ে সানজবের ডান চোখে আঘাত করে চোখ উঠিয়ে ফেলে। তখন সানজব মাটিতে লুটে পড়ে মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকেন। তাকে বাঁচাতে আসলে ফজর বাহিনীর অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন আরো ৬ জন। আশ পাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নেন। সেখানে অবস্থার বেগতিক দেখে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঐদিনই সন্ধ্যায় ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রচুর রক্তবমির পর ৩০ মার্চ ভোর ৫টায় তিনি মারা যান। এবং অন্য আহতরা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শেষে ৩/৪ দিন আগে বাড়িতে ফিরেন।
হাজীপুর গ্রামের মুরব্বী আব্দুল জলিল বলেন, ‘হত্যাকান্ডের ঘটনার দিন দুপুর দুইটারদিকে হাজীপুর বাজারে খুব উত্তেজনা চলছিল। তখন মেম্বার ফজর আলীকে আমি অনেক বুঝানোর চেষ্টা করি। সে আমাদের বাঁধা না মেনে তার বাহিনীকে বলে “শালার বেটাইন, আইজ তারারে পাইলে দুই চাইরটা মার্ডার করিলাও।” এর কিছুক্ষণ পরেই মার্ডারের ঘটনাটি ঘটে।
শ্রীমঙ্গল থানায় সানজব হত্যা মামলা :
সানজব হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের ভাই মিন্নত আলী গত ২ এপ্রিল শ্রীমঙ্গল থানায় ১৫ জনের নাম উলে¬খ সহ অজ্ঞাতনামা আরো ৭-৮ জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরা হলেন- হাজীপুর গ্রামের মেম্বার মো. ফজর আলী, তার ছেলে খোকন মিয়া, তার চাচাতো ভাই আছান মিয়া, জলিল মিয়া, ভাতিজা নজমুল মিয়া, চাচাতো ভাই রুয়েল মিয়া, তোফায়েল মিয়া, বিলাল মিয়া, ফয়ছল মিয়া, সিফিল মিয়া, রশিদ মিয়া, আরবেশ আলী, ডোকল মিয়া, নজব আলী ও মো.আব্দুল¬া। এর মধ্যে মেম্বার ফজর আলী, তার ছেলে খোকন ও ভাতিজা নজমুল ছাড়া অন্যরা সবাই গত ১০ এপ্রিল সোমবার মৌলভীবাজারের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বেচ্ছায় হাজির হলে আদালত তাদেরকে জেলহাজতে পাঠায়। কিন্তু মূল আসামীরা এখনও পর্যন্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে বলে আতঙ্কে আছেন হাজীপুর গ্রামের বাসিন্দারা।
ঘাতক ফজর আলীর বিবরণ :
মেম্বার ফজর আলী সম্পর্কে গ্রামবাসীরা বলেন, হাইল হাওরের হাজীপুর মৌজার প্রায় হাজার কেয়ার জমি সরকারিভাবে ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেয়া হয়। এসব ভূমি ব্রাম্মণবাড়িয়ার জসিম, শফিকুর রহমান, আশুগঞ্জের শাহজান আলম সাজু, মহিউদ্দিন, ডা. হাবিবুর রহমান, শ্রীমঙ্গলের শামীম গাজী ও কমলগঞ্জের হাজী শামীম আহমেদ চৌধুরীর কাছে তারা দলিলমূলে বিক্রি করেন। আবার কৌশলে তাদের কাছ থেকে ওইসব জমি ফিরিয়ে আনে। বর্তমানে হাওরের সবগুলো ফিশারীই নিয়ন্ত্রণ করছে মেম্বার ফজর আলী।
সূত্র জানায়, হাজীপুর এলাকার প্রভাবশালী ফজর আলী মেম্বার দীর্ঘদিন যাবৎ হাইল হাওর এলাকায় নিজের একক আদিপত্য বিস্তার করতে নিজ পুত্র, ভাই, ভাতিজা সহ এলাকার বেশ কিছু লোকজন নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন। যার নেতৃত্ব ফজর আলী নিজেই দেন। ফিসারী ব্যবসা, কৃষিকাজ সহ যে কোন প্রয়োজনে হাইল হাওরে যে কেই প্রবেশ করতে হলে তাকে চাঁদা দিয়ে হাওরে যেতে হয়।
২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গল থানায় দায়েরকৃত মামলা সূত্রে জানা যায়, মোঃ জমিস উদ্দিন হাইল হাওরের ফিসারী নির্মাণ করে মাছ চাষ করে আসছিলেন। ফিসারী নির্মাণকালীন সময়ে হাজীপুর এলাকার ফজর বাহিনীর প্রধান ইউপি সদস্য ফজর আলীর নেতৃত্বে পরিবহনকারী ট্রাক থেকে ২০/৩০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন। এভাবে কিছু দিন যেতে না যেতেই ফজর বাহিনী ফিসারীর মালিকের কাছে ৫ লাখ চাঁদা দাবী করে। দাবীকৃত চাঁদা প্রদান না করায় ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ফজর বাহিনীর শতাধিক লোকজন নিয়ে চাষকৃত ফিসারীতে হামলা চালিয়ে ফিসার ঘরবাড়ী ভাংচুর ও ফিসার পার কেটে ৭ লক্ষ ৮০ হাজার ফিসারীর মাছ লুটপাট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মোঃ জমিস উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করলে তৎকালিন শ্রীমঙ্গল থানার উপ-পরিদর্শক রমা প্রসাদ চক্রবর্তী মামলাটি সরজমিনে তদন্ত করে সাক্ষী প্রমাণমতে ঘটনার পারিপার্শি¦কতায় ২৪জন আসামীর বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪৪৭/৪৮৫/৩২৩/৩৭৯/৫০৬/৩৪ দন্ডবিধি ধারা মতে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বর্তমানে মামলটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইল হাওরের হাজীপুর গ্রামের মনির মিয়ার মৎস্য খামার ফজর বাহিনী দখল করতে গিয়ে ফিসারীর পাড়ের কয়েকটি ঘড়ে অগ্নি সংযোগ করে ও এলোপাথারি মারধর করে নারী পুরুষ সহ অন্তত ৪০ জনকে আহত করে। আহতদের মৌলভীবাজার ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া হয়। এ ঘটনায় মনির মিয়া শ্রীমঙ্গল থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ হাইল হাওরের এ ঘটনাটি তদন্তে এলাকায় গেলে ফজর বাহিনী পুলিমকে তাড়িয়ে দেয়। মামলা না দিতে পেরে মনির মিয়া এলাকার গন্যমান্য ব্যাক্তি ও তৎকালিন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে বিচার প্রার্থী হলে এলাকায় বিরোধ মিমাংসার জন্য এক বৈঠক বসে। বৈঠকে তৎকালিন সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আশরাফুল ইসলাম, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জলিল উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী সভা শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে অনুষ্ঠিত হবে। প্রশাসনের কর্মকর্তা বৈঠকের অদুরে আসলে ফজর বাহিনীর লোকজন দেশী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে নারীসহ প্রায় ৩০জন আহত হন। এ সময় মনির মিয়া, ছানু মিয়া, বাদশা মিয়া ও আনসার মিয়ার বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ফজর বাহিনী।
২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল বাইক্কা বিল সরকারি অভয়াশ্রমের মাছ ফজর বাহিনীর প্রধান ফজর আলীর নেতৃত্বে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের মাছ লুট হয়। এলাকার প্রায় ৫-৭শ লোককে নিয়ে বিলের বড় বড় রুই, কাতল, মৃগেল, বোয়াল, গনিয়া, গ্রাসকার্প, চিতল প্রজাতির মাছ ধরে বিক্রি করে। তার মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি ওজনের মাছও রয়েছে। ঐ সময়ের শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী বাইক্কা বিল ও তার আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ পহারা শুরু করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিলে মাছ ধরা অব্যাহত রাখে ফজর বাহিনীর লোকজন। মাছ লুটে জড়িত থাকায় সুনির্দিষ্টি নাম না পাওয়া এখোনও কোন মামলা হয়নি।
২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ফজর আলী পুত্র খোকন মিয়া সহ আরো কয়েকজন শ্রীমঙ্গল শহরের কণিকা এন্টার প্রাইজে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে। এ সময় শ্রীমঙ্গল উপজেলার মতিগঞ্জ এলাকার প্রমোদ সরকারের পুত্র রিপন সরকারকে মারাত্মক ভাবে আহত করে। এ ঘটনায় শ্রীমঙ্গল থানায় মামলা করেন রিপন সরকার। পরে ফজর আলী বৈঠকে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মামলার সমোঝতা হয়। সমোঝতা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা চেয়ারম্যান রনধীর দে, শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভানুলাল রায়, শ্রীমঙ্গল পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়না মিয়া সহ গন্যমান্য ব্যাক্তি বর্গ।
২০১৩ সালের ২০ মার্চ ফজর বাহিনীর প্রদান ফজর আলী পুত্র খোকন মিয়া শ্রীমঙ্গল শহরের বেঙ্গল মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনের রাস্তায় বরুনা এলাকার লন্ডন প্রবাসি মোঃ নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী জোসনা বেগমকে মারধর করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় প্রবাসি মোঃ নুরুল ইসলামের বাগ্নে জমসেদ আহমেদ শ্রীমঙ্গল থানায় মামলা দায়ের করেন। খোকন মহামান্য হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে নি¤œ আদালতে হাজির না হয়ে পলাতক রয়েছে। ঘাতক মেম্বার ফজর আলীর নামে হত্যা, মারামারি, লুটপাট, ছিনতাই, লুণ্ঠন, নির্যাতন সহ নানা অপকর্মের বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে বলে শ্রীমঙ্গল থানা সূত্রে জানা যায়।
মামলার তদন্তকারী ওসি’র বক্তব্য:
সানজব আলী হত্যা মামলার তদন্তকারী অফিসার শ্রীমঙ্গল থানার ওসি (তদন্ত) মো. জসিম বলেন, এ মামলার ১২জন আসামী কোর্টে স্বেচ্ছায় সারেন্ডার করেছেন। বাকী আসামী ফজর আলী মেম্বারসহ তিনজনকে গ্রেফতার করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, আসামী যেই হোক না কেন আইনের কাছে সে অপরাধী। আইন কখনোই কোন অপরাধীকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, শীঘ্রই সানজব হত্যা মামলার মূল আসামী মেম্বার ফজর আলী সহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হবে।
মন্তব্য করুন