সালাম নিয়ে প্রচলিত কিছু ‘ভুল’
এক মুসলমান আর এক মুসলমানের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হলে সালাম দেবে এবং অপরজন তার উত্তর দেবে। এ নিয়ম যে কত সুন্দর নিয়ম তা ব্যাখ্যা করে শেষ করা যাবে না। সালামের মধ্যে শান্তির দু’আ করা হয়। আস্সালামু আলাইকুম এর অর্থ হল “আপনার উপর শান্তি হোক, আল্লাহ আপনাকে শান্তি দান করুন”
সাহাবায়ে কেরাম পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলেই সালাম দিতেন। তাঁরা সদাইপাতির জন্য নয়, শুধু সালাম বিনিময়ের জন্যও বাজারে যেতেন। তাই একজন মুসলমানের সঙ্গে অন্য মুসলমানের সাক্ষাৎ হওয়া মাত্রই সালাম বিনিময় করা। রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, ‘কথাবার্তার আগেই সালাম করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যখন তোমাদের কারো কোনো মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তখন সে যেন তাকে সালাম করে। এরপর যদি তাদের উভয়ের মাঝে কোনো বৃক্ষ, প্রাচীর বা পাথরের আড়াল পড়ে। এরপর সাক্ষাৎ হলেও যেন তারা সালাম করে।’ সালামের সবচেয়ে ছোট বাক্য হচ্ছে, ‘আসসালামু আলাইকুম’। বর্ধিত করে, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।’
এবার জেনে নেয়া যাক সালামের কয়েকটি ‘ভুল’
১. সালামের জবাব দিয়ে আবার সালাম দেওয়া :
এ রীতিটা ভুল। উত্তম হলো সালাম পাওয়ার অপেক্ষা না করে আগে সালাম দেওয়া। কিন্তু কেউ সালাম দিয়ে দিলে তখন দায়িত্ব হলো শুধু সালামের উত্তর দেওয়া।
২. সালামের জবাব না দিয়ে আবার সালাম দেওয়া :
এ রীতিটাও ভুল। বড় কেউ যদি আগে সালাম দিয়ে ফেলে, তখন আমাদের অনেকেই জবাব দিতে লজ্জাবোধ করে।তাই জবাব না দিয়ে নতুন করে সালাম দেয়। এ রীতি পরিহারযোগ্য। কেউ সালাম দিলে তার জবাব দেওয়া ওয়াজিব। তাই জবাবই দিতে হবে।
৩. কাউকে সালাম দেওয়ার পর “সালাম দিয়েছি” বলা :
সালাম দেওয়ার পর উত্তর না পেলে আমরা সাধারণত বলে থাকি “সালাম দিয়েছি”। এভাবে বলা ঠিক নয়। নিয়ম হলো আবার সালাম দেওয়া।শ্রোতাকে যথাযথভাবে শুনিয়ে সালাম দিতে হবে।সালামের উত্তর যেমন সালামদাতাকে শুনিয়ে দিতে হয়,তেমনি সালামও শ্রোতাকে শুনিয়ে দিতে হয়।
৪. মনে মনে বা নিম্নস্বরে সালামের জবাব দেওয়া :
এ অভ্যাস পরিহারযোগ্য। সালামদাতাকে শুনিয়েই সালামের জবাব দেবে।
৫. অসময়ে সালাম দেওয়া :
কুরআন হাদীসের আলোকে একথা স্পষ্ট যে, সালাম হচ্ছে সাক্ষাতের বিভিন্ন আদবসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব।সালাম, মুসাফাহা, মুআনাকা, ইত্যাদি এক মুসলমান আরেক মুসলমানের সঙ্গে দেখা হলে করার মতো কিছু আমল,যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন।কিন্তু দেখা যায় দোয়া বা মোনাজাত শেষ হলে অনেকে সালাম দিয়ে বসেন। এটা একটি ভিত্তিহীন রেওয়াজ। দোয়া বা মোনাজাত শেষ হওয়ার সঙ্গে সালামের কোনো সম্পর্ক নেই।তেমনি মুসাফাহা,মুনাকারারও কোনো সম্পর্ক নেই।
৬. সালামের উচ্চারণে ভুল :
সালাম একটি দোয়া। ইসলামের শিআর ও প্রতীক পর্যায়ের একটি আমল। এর সহীহ উচ্চারণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কম পক্ষে এতটুকু বিশুদ্ধ উচ্চারণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কমপক্ষে এতটুকু বিশুদ্ধ উচ্চারণ অবশ্যই জরুরি,যার অর্থ ঠিক থাকে। “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লহ” আরবী দেখে এর উচ্চারণ শিখে নেওয়া উচিত।অন্যথায় ‘আইন’ ও ‘হা’ ইত্যাদি হরফের যথাযথ মাখরাজ আদায় হয়না। অনেকে অসাবধানতা বা তাড়াহুড়োর কারণে ভুল উচ্চারণে সালাম দিয়ে থাকে। এমনটা অনুচিত।
সালামের ভুল উচ্চারণের কয়েকটি রূপ :
১. স্লামালাইকুম
২. সালামালাইকুম
৩. আস্লামালাইকুম
৪. আস্লামুআলাইকুম
৫. সেলামালাইকুম
৬. ইস্লামালাইকুম
৭. আচ্ছালামু আলাইকুম ইত্যাদি।
সালামের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন রকম ভুল করে থাকি। আমাদের সমাজে যা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অথচ এই কাজগুলো পরিহার করা উচিত। আসুন জেনে নেই বিষয়গুলো এবং দাওয়াতের উদ্দেশ্যে শেয়ার করে সবাইকে জানাই।
১. অশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দেওয়া:
এটি মারাত্মক ভুল কাজ। আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ হচ্ছে পূর্ণ সালাম। শুধু আসসালামু আলাইকুম বললেও চলবে। তবে উচ্চারণে ভুল করা যাবে না। যেমন অনেকে স্লামালেকুম বলে। এ ধরনের ভুল উচ্চারণ হতে বিরত থাকা আবশ্যক।
২. বড় বা বয়স্ক মানুষের সালাম না দেওয়া:
এটিও ভুল প্রচলন। বড় বা বয়স্ক মানুষ ছোটদের সালাম দিতে কোনো বাধা নেই। তদ্রুপ শিক্ষক ছাত্রদেরকে এবং পিতা-মাতা সন্তানদের সালাম দিবে। আগে সালামকারী বেশি সওয়াব ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে।
৩. অপরিচিত কাউকে সালাম না দেওয়া:
পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়ার নির্দেশ এসেছে। তাই পরিচিত ও মুখ চিনে সালাম দেওয়া গর্হিত ও নিন্দিত কাজ। হাদিসের লঙ্ঘন হবে।
৪. সালাম দেওয়ার সময় মাথা ও বুক ঝুঁকানো:
সালাম দেওয়ার সময় মাথা ও বুক ঝুঁকানো নিষেধ। অনেকে পদস্থ বা বড় কোনো ব্যক্তিকে সালাম দেওয়ার সময় এমন করে থাকে। হাদিসে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়।
৫. সালামের উত্তর দিয়ে আবার সালাম:
আপনাকে কেউ সালাম দিল। আপনি উত্তর দেওয়ার পর ওই সালামকারীকে আবার সালাম দিলেন। অনেকে এ কাজটি অজ্ঞতাবশত করে থাকে। উত্তম হল, কারো সালামের অপেক্ষা না করে নিজে আগে সালাম দেওয়া। কিন্তু কেউ আগে সালাম দিয়ে ফেললে তার সালামের উত্তর দেওয়াই নিয়ম। তাকে আবার সালাম দিতে হবে না।
৬. সালামের উত্তর না দিয়ে আবার সালাম :
সালাম পাওয়ার পর উত্তর দেওয়াই বিধান। কিন্তু অনেক মানুষকে সালাম দেওয়ার পর উত্তর না দিয়ে সালামদাতাকে আবার সালাম দেয়। এমনটি ঠিক নয়। কারণ, বিধান হল দুজনের একজন সালাম দিবে; আর অপরজন সালামের উত্তর দিবে।
৭. সালাম দেওয়ার পর সালাম দিয়েছি বলা :
কাউকে সালাম দেওয়ার পর সালাম না শুনলে বা উত্তর না-দিলে আমরা বলি, ‘আপনাকে সালাম দিয়েছি’। এভাবে বলা ঠিক নয়। তাকে আবার পূর্ণ সালাম দেওয়াই বিধেয়।
৮. সালাম পাঠানোর পদ্ধতি :
কারো কাছে সালাম পাঠানোর দরকার হলে আমরা বলি, অমুককে গিয়ে আমার সালাম দিবেন/বলবেন। এভাবে বলা ঠিক নয়। নিয়ম হল এভাবে বলা, অমুককে আমার পক্ষ থেকে আসসালামু আলাইকুমৃ বলবেন। তদ্রূ প সালাম পৌঁছানোর পরও ‘অমুকে আপনাকে সালাম দিয়েছে’ এ রকম না বলে এভাবে বলা উচিত, অমুক আপনাকে আসসালামু আলাইকুমৃ বলেছে।
এক্ষেত্রে সালামের উত্তরদাতাও কেবল প্রেরককে উত্তর দিবে না। বরং প্রেরক ও বাহক উভয়কে দুআয় শরিক করবে। এভাবে উত্তর দিবে, ওয়া আলাইকা ওয়া আলাইহিস সালাম।
৯. ফোনে বা সাক্ষাতে সালামের আগে হ্যালো বা অন্যকিছু বলা :
ফোন বা মোবাইলে সালাম দেওয়ার আগে হ্যালো বা অন্য কোনো কথা বলা ঠিক নয়। আগে সালাম দিবে তারপর অন্য কথা বলবে। হ্যালো বলার দরকার হলে সালাম দেওয়ার পর বলবে। ফোন ছাড়া সাক্ষাতের বেলায়ও কথাবার্তার আগে সালাম দেওয়াই সুন্নত।
কেননা রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : السَّلَامُ قَبْلَ الْكَلَامِ অর্থ : কথাবার্তা বলার আগে সালাম দিতে হয়। (তিরমিযি, হাদিস নং- ২৬৯৯)
১০. মুসাফাহার পর বুকে হাত রাখা :
মুসাফাহা করার পর বুকে হাত রাখতে দেখা যায়– এর কোনো ভিত্তি নেই। হাত মেলানোর পর হাত ছেড়ে দিবে। বুকে হাত রাখা সুন্নত মনে করলে বিদআত হবে। অথবা হাত মেলানোর পর নিজের হাতে চুমু খায় অনেকে– এটাও বিদআত।
১১. অনুষ্ঠানশেষে বা বিয়ের আকদ হওয়ার পর সালাম :
অনেক জায়গায় দেখা গেছে, কোনো অনুষ্ঠান– বিশেষত দোয়া বা এ ধরনের কোনো মজলিস শেষ হওয়ার পর সালাম দেয়। তদ্রƒপ বিয়ের আকদ হওয়ার পর বর উপস্থিত সবাইকে সালাম দেয়। বর সালাম না দিতে চাইলে বা ভুলে গেলে অন্যরা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সালাম দেও। না দিলে খারাপ এবং বেয়াদব মনে করা হয়। এসবই কুসংস্কার ও ভুল প্রচলন। সালাম হবে সাক্ষাতের সময়। সুতরাং কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর কারো সাথে দেখা হলে তাকে সালাম করবে। কিন্তু অনুষ্ঠানশেষে সালামের এ নিয়ম কোত্থেকে এল? এসব বর্জন করা উচিত।
(২০১৭ সালে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একজন বিশিষ্ট আলেমের লেখা, রুহুল আমিন রুসদি নামের এক সিনিয়র সাংবাদিকের ফেসবুকে পৌষ্ট করেন। উক্ত লিখাটি ওই ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হলো)।
মন্তব্য করুন