সিলেটের কথকথা
সাদেক আহমেদ॥ বাংলাদেশের আধ্যাতিক রাজধানী বলে খ্যাত সিলেট। এতদ অঞ্চলে ৭০০ বছর পূর্বে ১৩০৩ সালে মাত্র একটি মুসলিম পরিবার ছিল। যার নাম ছিল শেখ বোরহান উদ্দিন (রঃ)। তার ছেলের আকিকা দেওয়ার জন্য একটা গরু জবাই করলে তখনকার শাসক গৌরগবিন্ধ গরু জবাই করার শাস্তি স্বরূপ তার ছোট শিশুকে নিয়ে বলি দিয়ে দেয়। তখন শেখ বোরহান উদ্দিন (রঃ) মনের দুঃখে এর প্রতিকারের জন্য দিল্লির বাদশাহ এর দরবারে উপনীত হন। তখন পবিত্র সিলেটের মাটি সংস্পর্শে আসতে হযরত শাহ জালাল (রঃ) দিল্লিতে এসে উপনীত হন এবং এই হৃদয় বিদারক ঘটনার অবহিত হন। তিনি তার ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়া সিলেট এসে ইসলামের শান্তির পতাকা স্থাপনের মাধ্যমে গৌরগবিন্ধের স¤্রাজ্যের পতন হয়। সিলেট বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সারা বাংলাদেশের ইসলামের শান্তির বার্তা নিয়ে আউলিয়াগণ ছড়িয়ে পড়ে। এই সিলেট বিজয় হয়েছিল সেনাপতি নাছির উদ্দিন সিপাহশালাহ এর মাধ্যমে। যার মাজার শায়েস্তাগঞ্জের কাছে মুরারবন্ধে অবস্থিত। এই সিলেটে অনেক ঐতিহাসিকগণ ধর্মীয়ভাবেও বা যুদ্ধের ধামামা বেজেছে। সিলেটের মুগলা বাজার, পাঠানটোলা নিশ্চয়ই মুগল বা পাঠানদের স্মৃতি বহন করছে। যদিও আমি এত গভীরে ইতিহাস নিয়ে এখনো পড়া শোনা করিনি বা করার সুযোগ পাই নি। এই সিলেটে জন্মেছিলেন গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণে শ্রী চৌতন্য দেব। যাকে নিমাই সন্নাসী বলে সবাই জানে। এখানে সুনামগঞ্জে বহু কবি ও লেখক গণের পদচারণায় স্মৃতি বহন করে। যেমন লোকজ কবি হাসন রাজা। শাহ আবদুল করিম, আরকুম শাহা, রাধার রোমন, দুর্বিন শাহা এদের গান ও কবিতা সিলেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাই শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে ব্রিটিশ সময় থেকে পাকিস্তান সময়ে সিলেটিরা কখনো পিছিয়ে ছিল না। ১৯৩৬ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকারের স্যার সাদুল্লাহ মন্ত্রী সভায় আসামের শিলংয়ে ১৫ জন সাংসদদের মধ্যে ১৩ জনই ছিল বৃহত্তর সিলেটের। যেমন লেংড়া দাউদপুরের খান বাহাদুর গৌস আহমদ চৌধুরী, বা মৌলভী বাজারে আমার শ্রদ্ধেয় চাচা নজির উদ্দিন আহমদ ছিলেন এম এল এ। ব্রিটিশ সময়ে এই সিলেট ছিল আসামের অংশ এবং তখনকার সময়ে এই সিলেটের সরকারী কর্মকর্তারাও আসামকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমার নানার ভাই ছিলেন খান বাহার আজিজুর রহমান চৌধুরী, আইসিএস অফিসার, শিলংয়ের দীর্ঘকালীন সময়ের ডিসি। কতজনের নাম বলবো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ঢাকা দক্ষিণ ভাদেশ্বর অঞ্চলের সিএসএস পরীক্ষায় সিএসপিতে বা ফরেন সার্ভিসে এক চেটিয়া প্রাধান্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন এমএজি ওসমানী, প্রথম কর্নেল, পরবর্তীতে জেনারেল। যার বাড়ীও এই সিলেটে। সাবেক নৌ বাহিনী প্রধান পরবর্তীতে উপদেষ্টা মরহুম এমএ খান এর পিতা খান বাহাদুর গজনফর আলী খান এর নামডাক ছিল। মরহুম এমএ খানের নামে সিলেট সুনামগঞ্জ সেতুর উপর বড় ব্রীজ এখনো স্বাক্ষী বহন করে। ছাতকের চুনা পাথরের খুব সুনাম ছিল। যার প্রেক্ষিতে সেখানে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর আনা নেওয়ার জন্য রুপউয়ে যা বিদ্যুতের তারের সাথে রুপউয়ে দিয়ে পাথর আনা হতো। যদিও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন ছিল এখন সেই সুরমা নদীর স্বাভাবিক গতি পথ যেমন বন্ধ ঐ রুপউয়েও বন্ধ, কি করা? সিলেটে এত উচ্চ শিক্ষিত রাজনীতিবিদ ছিল বাংলাদেশ হওয়ার পর পর ৩ জন বিডিআর এর প্রধান মেজর জেনারেল ছিল সিলেট অঞ্চলের। সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল হাসান মাসুদ চৌধুরী ছিলেন ভাদেশ্বর বাসিন্ধা। তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সুন্দর বাগান করে দিয়েছিলেন। ফরেন সার্ভিসেও সিলেটিদের একক কতৃত্ব ছিল। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সিলেটে গিয়ে হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর মাজার জেয়ারত করে সুরমা নদী খাল লামাখাজিতে খাল কাটা কর্মসূচী উদ্ভোধন করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের সর্বোত্ত খাল, ছড়া, হাওর, বিল প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আজ দেশী মাছ নদীতে নেই, কারণ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ আজ বাধাগ্রস্থ। নদীর পানিও বিশাক্ত। আজ পাহাড় কেটে কেটে প্রাকৃতিকে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে। আমি দুই মাস পূর্বে লামাকাজিতে দেখলাম পুলিশের একটা সোর্স দিনের শুরুতেই সাঙ্গবাঙ্গ নিয়ে ইয়ারগান গিয়ে দিব্বি পাখি মেরে চলেছে। আজ সিলেটিরা পড়াশুনা বাদ দিয়ে লন্ডন আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হয়তো কামাচ্ছে এবং তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রায় প্রচুর লন্ডনী বাড়ীঘর হয়েছে। দেখতে হয়তো সুন্দর। তবে কেয়ারটেকার পার্শ্ব জেলা কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে নিয়ে বাড়ী রক্ষণাবেক্ষন করা হচ্ছে। শেরপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত অনেকগুলো কয়েকতলা কমিউনিটি সেন্টার হয়েছে তবে এখন আর লন্ডনী কন্যারা এসে এখানে কোন বিয়ে সাদি হয় না। বিয়ে সাদি কিভাবে হবে বিয়ে করার শেষে এক বা দুই বৎসরের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যাচ্ছে। আজ বই পড়ার দিকেও নতুন প্রজন্ম নেই। তবে আমার ভালো লাগলো সিলেটের মুসলিম কেন্দ্রীয় সাহিত্য সংসদের বই মেলায় লেখিকা সংঘের সভা নেত্রী শিক্ষাবিদ হোসনেয়ারা চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতে আমার মন ভরে গেল। তারা আমাকে অনেক সম্মান দিয়ে তাদের ষ্ট্রলে আমাকে বসায় এবং আমাকে সাথে নিয়ে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় গান গেয়ে আমার মন জুড়িয়ে যায়। এ হোসনেয়ারা চৌধুরীর দুইটি বই আমার ভালো লেগেছে। সিলেটের কথা বলতে যেয়ে প্রাক্তন অর্থ মন্ত্রী সাইফুর রহমানের কথা বলতে হয়। আখাউড়া বাইপাস রেলওয়ে করে দিয়ে তিনি সিলেটবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। এছাড়া প্রাক্তন অর্থ মন্ত্রী শাহ এমএস কিবরিয়া প্রাক্তন পরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদগাজী কিংবা আরো যারা সিলেটকে ধন্য করে দিয়েছিলেন তাদের প্রতি রইল আমার শ্রদ্ধা। আজ সিলেটে কেন জঙ্গী বাসা বাধবে। এদের মৌলভী বাজারে মাত্র কয়েকদিন পূর্বে শেখ বোরহান উদ্দিন (রঃ) এর বৃত্তি (মেধা যাচাইয়ের) অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম এই যে দেখছো সিলেটের স্থান, এই পল্লী মোর জন্মস্থান, এই পল্লীতে বাস করে ভাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। রবীন্দ্রনাথের একান্ত সহচর সৈয়দ মুজতবা আলীর বাড়ী মৌলভী বাজার। এছাড়া আবদুল মজিদ সিআইই (কাপ্তান মিয়া) মৌলভী বাজারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। সৈয়দ কুদরত উল্যাহ উদ্যোগে বাজার তৈরী করায় দক্ষিন সিলেটকে পরবর্তীতে মৌলভী বাজার নামকরণ করা হয়। যেখানে আমার বাড়ী। যেখানে একটা সুন্দর লেইক ছিল। আমার বাড়ীর পাশ দিয়ে অন্ধ মনুনদী বয়ে গিয়েছিল। ছোট বেলায় দেখতাম পাল তোলা নৌকা যেত এখন আজ সেই দৃশ্য নেই। নদী আজ বন্ধ। সিলেটের অনেক হাওর মৌলভী বাজারের হাইল হাওর, সিলেটের হাকালুকি হাওর সুনামগঞ্জে টেঙ্গর হাওর এর সুদৃশ্য কোলাহল আজো পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র জাফলংয়ে একবার যারা যায় দ্বিতীয়বার আর না যাওয়ার জন্য শপথ করে নিজে নিজে গালে থাবা দেয়। কারণ পাথর বোঝাই ট্রাকের কারণে রাস্তা আজ ভেঙ্গে চুড়ে চুরমার। শ্রীমঙ্গলে লাওয়াছড়া উদ্যানে এখনও পর্যটকরা গিয়ে আনন্দ পায়। সিলেটে বাড়তি আকর্ষণ ছিল ব্রিটিশের রেখে যাওয়া চা বাগান। আমাকে ৩১ মার্চ চাতকে একটা মেধা যাচাই কুইজ প্রতিযোগীতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার দিতে প্রধান অতিথি করা হয়। সেখানে আমি বই পড়া নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানো এবং জঙ্গী নির্মুলে কি কি করণীয় তার ব্যপারে বক্তব্য দিব। যদিও সবাই জানে মাত্র কয়েকদিন পূর্বে দুই মোল্লা গ্রুপের মধ্যে ছাতকে মারামারিতে দুইজন লোক মারা যায়। আবার এর পূর্বে জকিগঞ্জে শিন্নি খাইতে গিয়ে প্রদবিষ্ট হয়ে লোক মারা যায়। হয়তো তারা বড় মাদ্রাসা করছে এবং অনেক টাকা বিদেশ থেকে আসছে। এতে করে সঠিক আধুনিক শিক্ষায় তারা দিক্ষিত হতে পারছে না। যে যার মতো করে ইসলামকে ব্যবহার করছে। তাই পড়াশুনা করে কি করবে বেকার থাকবে এই ভেবে হয়তো তারা জঙ্গী হচ্ছে। তবে জঙ্গী কোথা থেকে উৎপত্তী হয় এদের মাষ্টার মাইন্ড কারা তাও সরকারকে খুজে বের করতে হবে। সে যেই হোক আর যতো শক্তিশালী হোক। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সিলেটের প্রকৃত ইতিহাস ও সম্ভাবনাকে বইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে দিতে হবে সঠিক জ্ঞান। শুধু বাচ্চাদের নিজেদের ওজনের বাহিরে বেশি ওজনের বই দিয়ে বা গিলিয়ে সঠিক শিক্ষা বলা যায় না। বেড়াতে হবে দিতে হবে খেলার মাঠ। আজ পড়ালেখা হয়ে গেছে বাণিজ্যিক পন্যের মতো। আজ মার্চপাষ্ট স্কুলে হয়ই না। আর পড়ার জন্য প্রচুর চাপ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক ভাবে সরকারও একপেশি রাজনীতিতে শুধু নয়। বহিঃবিশ্বে সম্পর্কে একপেশি দেশের পাল্লায় পড়া দেশের জন্য কতযে বিপদজনক তা সহজে বুঝা যায়। আসুন আমরা সবাই মিলে দলমত নির্বিশেষ সবাইকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য মতের দিকে তথা গণতন্ত্রের দিকে দেশকে ধাবিত করি। কারণ এদেশ হলো অলি আউলিয়ার দেশ। যারা এই পবিত্র মাটিতে শুয়ে আছেন। তাদের কিছুই ছিল না সম্পদ। অথচ ইসলামের সঠিক শিক্ষা সম্পদ রুপে ইতিহাসে তারা রেখে গেছেন। তাই তারা স্মরণীয়। শিল্প কারখানার দিকে সিলেটে একবারে পিছিয়ে পড়েছে। যদিও হবিগঞ্জের শাহাজি বাজার হয়ে সিলেটে আসার পথে দেখা যায় বৃহৎ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক। যদিও প্রবাসীরা এখানে নেই। তবু মন্দের ভালো ওখানে সায়হাম টেক্সটাইলের পাশে আরো কারখানা হচ্ছে। প্রবাসীরা এসে ব্যাংক যদিও খুলেছে এরআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এ সরকারের সময়। তবে কাওরানা বাজারে অবস্থিত জালালাবাদ এসোসিয়েশন, সিলেট থেকে বেড়াতে আসে যারা তাদের জন্য থাকার মাথা গুজার জন্য ঢাকায় হোস্টেল করে দিলে ভালো হতো। এখান থেকে যতো টাকা আয় হয় কর্তা ব্যক্তিদের একদিনে মহান আল্লার কাছে ফিরে গেলে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ সিলেট তথা বাংলাদেশের মঙ্গল করুন। আমিন।
মন্তব্য করুন