সিলেটের বাথরুমে কবি নজরুল

May 25, 2020,

সায়েক আহমদ॥ ১৯২৮ সাল। সিলেটে দ্বিতীয়বারের মত সফরে এসেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এসে উঠলেন সিলেটের সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’ পত্রিকার সম্পাদক মকবুল হোসেন চৌধুরীর দরগামহল্লাস্থ ভাড়াটে বাসা ‘ভাদেশ্বর লজে’। বাসায় প্রবেশ করেই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন বাথরুমটা কোনদিকে। চৌধুরী সাহেব সসম্মানে নিজের বাসার বাথরুমটা দেখিয়ে দিলেন। হাসিখুশি নজরুল ঢুকলেন বাথরুমে। সবাই অপেক্ষা করছেন কখন কবি বাথরুম থেকে বের হবেন। কিন্তু কবি বাথরুমে ঢুকেছেন তো ঢুকেছেন, বেরোবার আর নামগন্ধই নেই। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কোন সমস্যা হল নাকি? ওদিকে প্রায় আধঘন্টা সময় কেটে গেছে। কি হল কবির?

১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুরমা ভ্যালি মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন সিলেটে এক সম্মেলনের আয়োজন করে। এ উপলক্ষে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং শিক্ষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে এতে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁরা সানন্দে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।

সম্মেলনের নির্ধারিত দিনের সকালবেলা এই তিন মনিষী একসাথে কলকাতা থেকে সিলেট এসে পৌঁছান। তারা গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে এসেছিলেন চাঁদপুর। তারপর চাঁদপুর থেকে ট্রেনে রওনা হন। সকালবেলা সুরমা মেইল ট্রেনটি সিলেট রেলস্টেশনে এসে পৌঁছায়। স্টেশনে ছিল ভক্তদের গণজোয়ার। তিন মহামানবকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রেলস্টেশনে গিজগিজ করছিল। এই তিন মনিষী এবং দিকপালের একই সাথে সিলেট সফরে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের পক্ষে আব্দুল মুহিত চৌধুরী আগেই কুলাউড়া চলে গিয়েছিলেন তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য। সিলেটে সুরমা নদীর উপর তখনো কীনব্রিজ হয়নি। মেহমানরা সবাই জুড়িন্দা নৌকায় চড়ে সুরমা নদী পার হয়েছিলেন।

সিলেট পৌঁছার পর শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেবকে নিয়ে যাওয়া হল নওয়াবী মসজিদের কাছে ডাক বাংলোয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উঠলেন তাঁর প্রাক্তন ছাত্র সৈয়দ মোস্তফা আলীর বাড়ীতে। আর কবি নজরুলকে নিয়ে আসা হল মকবুল হোসেন চৌধুরীর বাসায়। কারণ  সাহিত্য সম্মেলনে যে অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়েছিল তার সম্পাদক ছিলেন মকবুল হোসেন চৌধুরী। কবি মকবুল সাহেবের এই বাসাতে এক মাসেরও বেশি সময় অবস্থান করেছিলেন। তখন এই বাসায়ই রাতদিন প্রচণ্ড ভিড় লেগে থাকত। আড্ডা চলত সর্বক্ষণ। কবি কখনো আবৃত্তি করতেন, গান গাইতেন। ভক্তরা বাসায় এলে যখন তখন শুরু হয়ে যেত স্বতস্ফূর্ত আড্ডা। কবিকে ঘিরে সর্বদা তার ভক্তরা এসে ভীড় জমাতো। যখন যেখানে দাওয়াত হত, গান শোনার জন্য দ’ুতিন শত লোক হুট করে চলে আসতো। কবি ঐ সফরে গানে, কথায় আড্ডায় সিলেট শহর মাতিয়ে তুলেছিলেন।

ঐ সময় কলকাতার  ‘হানাফী’ পত্রিকায় কবিকে কাফের ফতোয়া দেয়া হয়। মকবুল হোসেন সাহেবের কাছে ‘হানাফী’ পত্রিকা আসতো। তখন কবি ঐ পত্রিকা দিয়ে জুতা মুছেছিলেন।

এবার চলে আসি, সিলেট এসে পৌঁছার পর কবি যখন বাথরুমে নিরুদ্দেশ হলেন তারপর কী ঘটেছিল সে প্রসঙ্গে। সবাই যখন কবিকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত তখনই হঠাৎ করে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন সদাহাস্যময় নজরুল। হাতে একটি কাগজ। সবার উৎসুক মুখের সামনে তুলে ধরলেন কাগজটি। সবাই অবাক হয়ে দেখলেন কবি বাথরুমে বসেই রচনা করে ফেলেছেন একটি গান। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যাক বাবা, কবির কিছুই হয়নি। বাথরুমে বসেই তিনি কাব্যচর্চায় নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই গানটিই হয়ে যায় কবি নজরুল রচিত অমর একটি গান। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই অনেক বিখ্যাত গান রচনা করেছিলেন।

 [সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com