সিলেটে এসে আইসোলেশনে কবি নজরুল
সায়েক আহমদ॥ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সিলেটে এসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আইসোলেশনে থাকতে হয়েছিল। তাও আবার এক সপ্তাহ, দু সপ্তাহ নয়, পুরো একটি মাস। আজ থেকে ৯৫ বছর আগে, সেই ১৯২৫ সালে। বর্তমান সময়ে আমরা কোয়ারান্টাইন এবং আইসোলেশন শব্দ দুটির সাথে খুব বেশি পরিচিত হয়ে গেছি। সেটা অবশ্য হতচ্ছাড়া করোনা ভাইরাসের কারণে। কিন্তু ১৯২৫ সালে তো করোনা ভাইরাসের কোন অস্তিত্বই ছিল না। তাহলে কোন কারণে তাকে আইসোলেশনে যেতে হয়েছিল?
আমরা জানি, কবি নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হাবিলদার নজরুলের একটি ছবির সাথেও আমরা পরিচিত। সে সময় সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাসের মত স্পেনিশ ফ্লু মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। প্রায় ৫ কোটি মানুষকে চিরবিদায়ের দেশে পাঠিয়ে অবশেষে বিদায় নিয়েছিল সে ভাইরাসটি। তবে কবি নজরুলকে স্পর্শও করতে পারেনি সে ভাইরাসটি। তাহলে কোন কারণে আইসোলেশনে গেলেন নজরুল তা জানতে হলে আমাদেরকে চলে যেতে হবে সেই ১৯২৫ সালে, যখন কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবারের জন্য এসেছিলেন সিলেট সফরে। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন সেটা ১৯২৬ সাল। তবে কবি একলিমুর রেজা এবং অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের লেখা হতে জানা যায় সেটা ছিল ১৯২৫ সাল। হয়তো সেটা ১৯২৫ সালের শেষভাগও হতে পারে অথবা ১৯২৬ সালের প্রথমভাগও হতে পারে। এটা নিয়ে বিতর্ক না বাড়িয়ে আমরা বরং চলে যাই নজরুলের সেই সিলেট সফরের সময়ে।
সারা ভারতবর্ষ জুড়ে তখন কংগ্রেস বিরাট জনসংযোগ করছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সিলেটের কংগ্রেস দলের সদস্যরা কবি নজরুলকে সিলেটে আসার জন্য দাওয়াত দেন। তাদের আমন্ত্রণেই তিনি প্রথমবারের মত সিলেটে আসেন।
কবি নজরুল তখন টগবগে জোয়ান। বয়স কতইবা হবে। পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ। তরতাজা যুবক। সিলেটে এসে তিনি কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদানও করেছিলেন। কিন্তু সিলেটে আসার পর থেকেই কবির শরীরে জ্বর জ্বর ভাব দেখা দিল। এই জ্বর থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারাত্মক অসুস্থই হয়ে পড়েন তিনি।
কংগ্রেস দলের সদস্যদের আহ্বানে কবি নজরুল সিলেট আসায় চরদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই নজরুলকে তাদের বাসায় নিয়ে যাবার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। কিন্তু কংগ্রেস দলের সদস্যরা আগেই নজরুলের থাকার জায়গা নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। কাজেই তিনি সরাসরি সিলেটের নয়াসড়কস্থ রায় বাহাদুর রমনী মোহন দাসের বাড়িতে উঠেন। তখন থেকেই তার গায়ে জ্বর দেখা দিল।
সিলেট তথা সারাদেশের বিখ্যাত মরমী কবি হাসন রাজার পুত্র একলিমুর রেজা ছিলেন একজন উদার মনোবৃত্তির মানুষ। পিতার মত তিনিও কবি ছিলেন। কবি নজরুলকে তার বাসায় নিয়ে যাবার জন্য তিনি সরাসরি উপস্থিত হলেন রায় বাহাদুর রমনীমোহনের বাড়িতে। সাথে তরুণ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। এই আজরফ সাহেবই পরবর্তীতে বিখ্যাত দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ নামে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
কবি নজরুল ছিলেন প্রচণ্ড আড্ডাবাজ এবং দিলখোলা তরুণ। কাজেই রায় বাহাদুর রমনীমোহনের বাড়িতে ছিল উপচেপড়া ভীড়। সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। সবাই কবির দর্শনার্থী। এর মধ্যেই একলিমুর রেজা কবি নজরুলকে নিজের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু কবি তো এসেছেন কংগ্রেস দলের সদস্যদের নিমন্ত্রণে। আর তাকে ঘিরেই একটি সরগরম আড্ডা সবেমাত্র জমে উঠেছে। আড্ডাবাজ নজরুলও জমজমাট আসর ছেড়ে যেতে দ্বিধাবোধ করছিলেন। এরকম পরিবেশে একলিমুর রেজার প্রস্তাবে একটি অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হল। কারণ হাসন রাজার পুত্র হিসেবে এবং নিজেও একজন কবি হিসেবে তখনকার সময়ে একলিমুর রেজার যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। তাই তার জেদের কাছে হার মানতে হল কংগ্রেস সদস্যদেরকে।
শেষ পর্যন্ত জেদ ধরেই কবি একলিমুর রেজা বিদ্রোহী কবিকে তার জিন্দাবাজারের বাসায় নিয়ে গেলেন। তবে কবির সাথে তিন চারজন স্বেচ্ছাসেবকও গেলেন।
জিন্দাবাজারের বাসাটি সরগরম হয়ে উঠল আড্ডায় আড্ডায়। চায়ের আয়োজন হলো। কবি একলিমুর রেজা তার লেখা কবিতা পড়ে শোনাতে চাইলেন বিদ্রোহী কবিকে। প্রাণখোলা নজরুল মুহূর্তেই অনুমতি দিয়ে দিলেন। নজরুলের অনুমতি পেয়ে একলিমুর রেজা স্বরচিত ‘দেবতার পরিণাম’ কবিতাটি তাকে আবৃত্তি করে শোনালেন। এরপর কবিতাটি কেমন হয়েছে জানতে চাইলেন নজরুলের কাছে। হঠাৎ করে একটি জমজমাট আড্ডা ছেড়ে আসায় কবি নজরুল কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই কবিতাটি শুনে হুট করেই তিনি মন্তব্য করে বসলেন, ‘ভাই আপনি ফার্স্টক্লাস বাপের ছেলে, তাই ফার্স্টক্লাস হয়েছেন। আমরা থার্ডক্লাস বাপের ছেলে আর কতদূর অগ্রসর হতে পারি।’
একলিমুর রেজা অবশ্য নজরুলের ক্ষুব্ধ হবার কারণটি বুঝতে পারলেন। তবে তিনিও তো হাসন রাজার পুত্র। তিনিই বা কম যাবেন কেন? তিনি কবির সুরে সুর মিলিয়ে সাথে সাথে পাল্টা উত্তর দিলেন, ‘আমি ফার্স্টক্লাস বাপের ছেলে বলেই হয়েছি থার্ডক্লাস, আর তুমি থার্ডক্লাস বাপের ছেলে বলেই হয়েছো ফার্স্টক্লাস।’ একলিমুর রেজার এরকম উত্তরে নজরুলের মন থেকে মুহূর্তে ক্ষুব্ধ ভাবটা চলে গেল। আবারো তিনি প্রাণখোলা হাসিতে পুরো ঘর গরম করে ফেললেন। নজরুলের স্বভাবসুলভ হাসিতে পরিবেশটা আবারো হয়ে উঠলো জমজমাট।
কিন্তু কবি আর সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। কারণ কবির জর তখন বেড়েই যাচ্ছিল। তাই জ্বর নিয়েই তিনি একলিমুর রেজার বাসা থেকে বিদায় নিলেন।
স্বেচ্ছাসেবকরা আবারো নজরুলকে নিয়ে রায় বাহাদুরের বাসায় চলে এলেন। বাসায় আসার পর জ্বর আরো বেড়ে গেল। সেবা সুশ্রুষার কোন ত্রুটি হচ্ছিল না। তারপরও জ্বর কমছিল না। অবশেষে তিনদিনের মাথায় কবির শরীরে গুটিবসন্ত বের হতে থাকে। তখনকার সময়ে গুটিবসন্ত ছিল ভয়ংকর অসুখ। এ অবস্থায় তাকে আলাদা কক্ষে রাখা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। কারণ এ সংক্রামক রোগটি অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই কবি নজরুলকে আইসোলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে নতুন করে দুটি শব্দ আমাদের সামনে এসেছে। এর মধ্যে একটি শব্দ হচ্ছে ‘কোয়ারান্টাইন’ আর অন্য শব্দটি হচ্ছে ‘আইসোলেশন’। ‘কোয়ারান্টাইন’ শব্দটির উৎপত্তি চতুর্দশ শতকে। তখন ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথ মহামারি আকার নিলে, ভেনিস কর্তৃপক্ষ একটি নিয়ম জারি করে। আর তা হলো, বন্দরে কোন জাহাজ ভিড়িয়ে যাত্রীদের নামানোর আগে সেটাকে সমুদ্রে ৪০ দিন নোঙর করে রাখতে হবে। এই ৪০ সংখ্যাটিকে ইতালিয়ান ভাষায় বলা হয় কোয়ারানতা। আর ৪০ দিনের এই অপেক্ষার সময়টিকে তারা বলতো কোয়ারানতিনো। সেই কোয়ারানতিনো শব্দটি থেকেই এসেছে বর্তমান সময়ের ‘কোয়ারান্টাইন’ শব্দটি। বর্তমান সময়ে আমরা দেখছি আপাতভাবে সুস্থ মনে হওয়া মানুষদের জন্য ‘কোয়ারান্টাইন’। অর্থাৎ যেসব ব্যক্তিকে আপাত দৃষ্টিতে সুস্থ মনে হয়, কিন্তু সে সুস্থ হতে পারে আবার নাও হতে পারে, তার মধ্যে হয়তো জীবাণু আছে কিন্তু কোন ধরণের উপসর্গ দেখা দেয়নি- এমন ব্যক্তিদের ‘কোয়ারান্টাইন’ এ রাখা হয়। আবার কারো মধ্যে যখন জীবাণুর উপস্থিতি ধরা পড়ে বা ধরা না পড়লেও তার মধ্যে উপসর্গ থাকে তখন তাকে আলাদা করে যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তা হচ্ছে আইসোলেশন। অর্থাৎ আইসোলেশন হচ্ছে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য আর ‘কোয়ারান্টাইন’ হচ্ছে সুস্থ বা আপাত সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য।
কাজেই কবি নজরুলকে আইসোলেশনে রাখার সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কবিকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় এক মাস কাটাতে হয়েছিল সিলেটে। এই একটি মাস আড্ডাবাজ এবং দিলখোলা নজরুল কীভাবে কাটিয়েছেন কেই বা তা বলতে পারে। তবে প্রথমবার সিলেট সফরে এসে কবি নজরুল মাসাধিককাল থাকলেও সফরটা তেমন জমজমাট হয়ে উঠেনি। এসেই যদি আইসোলেশনে চলে যেতে হয় তাহলে তো আর কিছুই করার নেই।
অবশ্য একমাস পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই কবি নজরুল ফিরে যান কলকাতায়। এটাই হল কবি নজরুলের আইসোলেশনে থাকার কাহিনী। অবশ্য এর আরো দুবছর পর ১৯২৮ সালে নজরুল আবারো সিলেটে এসে তার আইসোলেশনে থাকার ক্ষতিটা সুদে-আসলেই আদায় করে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, শিখে ফেলেছিলেন খাঁটি সিলেটি ভাষায় কথা বলার কৌশলটুকুও। সিলেটবাসী হিসেবে সে ঘটনাটি অবশ্যই আমাদের জন্য রোমাঞ্চকর!
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন