সুন্দরবনের ভয়ংকর সুন্দর স্মৃতি, যে নির্জনে মানুষের প্রথম পদার্পন ১০ জনের বেঁচে ফিরার এক বাস্তব কাহিনী
বিকুল চক্রবর্ত্তী॥ যেখানে কোন মানুষের পদ চিহ্ন পড়েনি দূর্ভাগ্যক্রমে কিংবা সৌভাগ্যক্রমে আমাদের কয়েকজনকে সেখানেই পদার্পন করতে হয়েছে। যেখানে কেউ কোন দিন যায়নি সেখানে কি এমনি এমনি যাওয়া যায়। নেহাত বিপদে না পড়লে। সোজা কথায় বলাযায়, এক মৃত্যুর কুপ থেকে আরেক মৃত্যুর কুপে পা দেয়া। আর সেখান থেকে ফিরে আসতে পারা মানে দ্বিতীয় জীবন পাওয়া। অনেকের কাল্পনিক গল্প আমরা শুনেছি। আবার অভিনয়ের মাধ্যমে ডিসকভারী টিভিতে বিপদে পড়ার দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া এ ঘটনাটি অন্যরকম এক বাস্তবতা। বড় রকমের একটি বিপদ থেকে ১০ জনের বেঁচে আসার এক বাস্তব গল্প। হতে পারে সেখানে মানুষ হিসেবে আমরাই প্রথম পদ চিহ্ন রেখে এসেছি।
ঘটনার সময় ২০১৫ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। শ্রীমঙ্গলের এক ভ্রমন পিপাসু আশিষ রঞ্জন দে, মাইটিভির সাংবাদিক সঞ্জয় ও আমি। আমরা ৩জন প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাই। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আমরা সিন্ধান্ত নিলাম খুলনা বিভাগ ঘুড়ে আসবো। একই সাথে আমার সম্পাদনায় “আপন আলোয় বিশ্বভূবন” নামে একটি সংকলণ মুদ্রনবিদ থেকে প্রকাশিত হয়, উদ্দেশ্য এই বই এর মোড়ক উন্মোচন ও বিভিন্ন জেলায় স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তা বিনামুল্যে বিতরণ করবো।
ভ্রমন এবং বই বিতরণ এই দুটি উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা যাত্রা করি। অবশ্য এই যাত্রায় আমাদের সাথে যোগদেন শ্রীমঙ্গলের এক ব্যবসায়ী বিষ্ণুপদ ধর, শ্রীমঙ্গল বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব ও হীরা নামে আরো একজন।
আমরা শ্রীমঙ্গল থেকে প্রথমে হবিগঞ্জ জেলা, তার পর ব্রাহ্মনবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নারায়ন গঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর হয়ে গোপাল গঞ্জ জেলায় যাই। সেখানে আমরা এক রাত একদিন অবস্থান করি। গোপাল গঞ্জ জেলা প্রশাসককে খলিলুর রহমানকে নিয়ে গোপালগঞ্জ প্রেসক্লাবে “আপন আলোয় বিশ্বভূবন” সংকলনের মোড়ক উন্মোচন করি। এর পর গোপালগঞ্জ থেকে আমরা পর দিন সকালে বাগেরহাটে যাই সেখানে বাগেরহাট যাদুঘর ও ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদসহ অনেক গুলো প্রাচীন মসজিদ দর্শন করি। বাগেরহাট থেকে আমরা চলে যাই খুলনা শহরে। সেখানে রাত্রী যাপন করে পরের দিন খুব ভোরে রওয়ানা হই মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে। সেখানে আগে থেকেই আমাদের সফর সঙ্গী ও পথ প্রদর্শক হিসেবে অপেক্ষায় থাকেন মংলার এক অতিপরিচিত কর্মঠ ব্যক্তিত্ব একুশে টেলিভিশনের বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি মোখলেছুর রহমান মিঠু ও তার সাথে আরো একজন স্থানীয় সাংবাদিক বাবুল ভাই। আগে থেকেই তিনি আমাদের জন্য একটি ইঞ্জিন চালিত জালি বোট রিজার্ভ করে রাখেন। সাথে রান্না করে খাওয়ার জন্য মাছ মুরগী সহ আনুষাঙ্গিক আরো কিছু সামগ্রীও প্রস্তুত রাখেন। মংলা যাওয়ার পথে আমরা বেশ কিছু চিংড়ি ঘের পরিদর্শন করি। অনেক বড় বড় চিড়িং মাছ হাতে নেই। ৭/৮শত গ্রাম ওজনের চিংড়ি। যা আমরা কোনদিনই হাতে নিয়ে দেখিনি। রাস্তায় একটি নারিকেল বাগানও পরিদর্শন করি। এই দুটি স্থান পরিদর্শনের জন্য মংলা পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়। যাই হোক সকাল ১০টার মধ্যেই আমরা মংলা যাই। সেখানে গিয়ে আমরা আগে থেকে রিজার্ভ করা নৌকায় উঠি। মিঠুভাই নৌকার উপরে ৭/৮টি চেয়ার ও একটি টেবিলের ব্যাবস্থা করেন। আমরা সবাই নৌকার উপরেই উঠি। এই নৌকাগুলো এখানে প্রসিদ্ধ। প্রথমে তিনি আমাদের সুন্দর বনের বনবিভাগ নিয়ন্ত্রীত সুন্দর বনের করমজল অংশ দেখাতে নিয়ে যান। মাটি থেকে দুই হাত উঁচু কাটের ছাউনীর উপর দিয়ে সরু পথে প্রায় ১ কিলোমিটার সুন্দরবনের করমজল ঘুরে দেখি। এই জায়গাটি দেখে আমার কাছে সুন্দরবনের কোন স্বাদই আসেনী। প্রায় ১ কিলো মিটার পথ ঘুড়ে কিছু লাল কাঁকড়া, বনবিভাগের খাঁচায় বন্দী কিছু কুমিরের বাচ্চা, কয়েকটি হরিণ এবং উন্মুক্ত কিছু বানর দেখতে পাই। তবে বাঘের বন সুন্দরবনে বাঘ দেখতে না পেলেও বনবিভাগদ্বারা সজ্জিত বাঘের একটি কংকাল দেখতে পেরেছি। কাটের সরু পথের উপর দিয়ে ঘুরার সময় মিঠু ভাই জানালেন, এটাই সুন্দরবন। লোকজন এটাই দেখে সুন্দরবনের স্বাদ নেয়। নিজের কাছে আবাক লাগে। এর চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বন। যেখানে অনেক প্রজাতির প্রাণী এখনও বিরাজমান। তবে মিঠু ভাই জানালেন, সুন্দর বনের ভিতরে দূর্গম অনেক জায়গা আছে যেখানে অনেক প্রাণী বিচরণ করে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার অনুমতি বা ব্যবস্থা নেই। মিঠু ভাইকে বলে কাঠের ছাউনী থেকে কাঁদা মাটিতে হেঁটে একটু জঙ্গলের ভিতরে হাটতে চাইলাম। তিনি জানালেন, এখান থেকে আরো ৪ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে গিয়ে একটি ইন্দোনেশীয়ান জাহাজে রান্না করে খাবো এবং বিশাল একটি জাহাজ ঘুরে দেখবো। অবশ্য সিভিল কোন লোক এভাবে জাহাজে যাওয়ার অনুমতি নেই। মিঠু ভাই এর নিকট আত্মীয় এক চাচা সিদ্দিকুর রহমান এই জাহাজে চাকুরী করেন তাই তিনি আগে থেকেই সেখানে আলাপ করেন রাখেন। তার কথায় অল্প সময়ের জন্য আমি ও আশিষ বনের ভিতরে প্রবেশ করি। যদিও বাঘ এতো কাছে কাছাকাছি সময়ে আসার কোন খবর নেই, তবুও বনের ভিতরে বেশ ভয় পাই আমরা। ভিতরে কয়েকটি ছবি তুলে দ্রুত ফিরে আসি।
আবারও জালি বোটের উপরে উঠে বসি। ইতিমধ্যে হাল্কা খাবার খেয়ে নেই সবাই। পশুর নদী হয়ে আমরা সাগরের দিকে রওয়ানা হই। আমরা যে জাহাজে যাবো এটি সর্বশেষ চ্যানেলে আছে। ঐ জায়গার নাম হারবাড়িয়া ৫ সুন্দরবন থেকে নদী পথে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টার রাস্তা। পশুর নদী থেকে বেশ কিছু সরু খাল সুন্দর বনের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করেছে। মিঠু ভাইকে অনুরোধ করালাম এরকম যে কোন একটি খাল দিয়ে একটু ভিতর ঘুরে আসা যায়কিনা। তিনি জানালেন, এগুলো দিয়ে প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ, বন দস্যুর ভয় আছে। কিন্তু আমাদের মনের ভাবনায়, এই সরু খালের পথে গেলে হয়তোবা কিছু দেখা যেতে পারে। আমার অনুরোধে মিঠু ভাই একটি খালে ভিতরে কিছুটা প্রবেশ করলেন। কিন্তু কোন কিছুর দেখা নেই। কয়েকটা ছবি তুলে যথারীতি ফিরে আসি। পশুর নদীর প্রায় মধ্য দিয়ে আমাদের হ্যাজ-বোটটি দ্রুত গতিতে চলছে। ইতিমধ্যে আসে জোয়ার। নৌকার গতি কমে যায়। নৌকার মাঝিকে জানালাম একটু বনের পাশ ঘেঁষে যেতে। উদ্দেশ্য জঙ্গলের ভিতরে কিছু দেখা যায় কিনা। নৌকার মাঝি কিছুটা কিনারা ঘেঁষেই চলতে লাগলেন। ইতি মধ্যে আমরা প্রায় আড়াই ঘন্টা অতিক্রম করেছি। কয়েকটি জাহাজের চ্যানেলও অতিক্রম করেছি। হঠাৎ করে চোখে পড়লো আমাদের সামনে প্রায় দুইশত গজ দূরত্বে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ভারী বর্ষন। আশ্চর্য জনক হলেও সত্য বৃষ্টি পশুর নদীর মধ্য ভাগ থেকে আমরা যে পাশ দিয়ে যাচ্ছি সে পাশেই হচ্ছে। কিন্তু আমরা যেখানে আছি এবং নদীর মধ্য থেকে বা পাশে কোন বৃষ্টি নেই। নৌকার মাঝি তাৎক্ষনিক নৌকাটি পুরো বাঁ দিকে ঘুরিয়ে বৃষ্টিকে ডানে রেখে নদীর অপর পাড়ের দিকে যেতে লাগলেন। মধ্যখানে গিয়ে আবার নৌকাটি ডান দিকে ঘুরিয়ে দিলেন তখনও আমাদের ডানে বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা প্রত্যেকেই প্রকৃতির এ লীলা কৌতুহল ভরে উপভোগ করি।
আস্তে আস্তে বৃষ্টি কমে যায় আমরা আবারও পশুর নদীর ডান পাশে সুন্দর বনের কিনারায় চলে আসি। মিঠু ভাই আরো ১ ঘন্টা আগেই জানিয়েছিলেন এখন আর কোন পর্যটকের নৌকা পাবো না কারন পর্যটকরা এতো দুরে আসেন না। যদি কেউ দোবলার চড়ে যান তা হলে হয়তো এদিকে আসেন। ঐ দিন ছোট কাটো কোন মাছ ধরার মাঝিকেও দেখা যায়নি। এ সময় তিনি আরো জানালেন, এ সব এলাকায় প্রায়ই জলদস্যুর কবলে পড়েন সাধারণ জেলেরা। এ সময় আমাদের অনেকের মনের মধ্যে বেশ ভয়ও কাজ করে। বেলা তখন ৩টা। সবাই ক্ষুধার্ত। মিঠু ভাই জানালেন, আরো প্রায় ১ ঘন্টার রাস্তা। মোবাইলেও নেটওর্য়াক নেই। নদীও উত্তাল। কয়েক মিনিটের মধ্যে চোখে পড়লো আমাদের বোটের বাঁ দিকে বিরাট বড় একটি কুমির নিচ থেকে ভেসে উঠেছে। মিঠু ভাই মাঝিকে সাবধান করে বললেন দেখে শুনে যেতে। কুমিরের ছবি তুলার জন্য ক্যামেরা তাক করতে করতেই কুমিরটি আবার পানির নিচে চলে গেলো। আরও কিছু ক্ষন যেতেই শুরু হয় গুরি গুরি বৃষ্টি। ইতি মধ্যেই আমাদের দু’একজন নৌকার ভেতরে চলে গেছেন। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তে থাকে আমরাও নিচে চলে যাই। মাঝি একটি ছাতা টানিয়ে বোট চালাতে থাকেন। এদিকে মিঠু ভাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তার চাচার জাহাজ তো এতো দুরে থাকার কথা নয়। চাচার বর্ণনা অনুযায়ী সেই জাহাজের দেখা পাননি তিনি। একে একে আমরা প্রায় ৮/১০টি জাহাজ অতিক্রম করেছি। একদিকে পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা, অন্য দিকে খুঁজে পাচ্ছিনা আমাদের জাহাজ। আবার ফেরারও ভয় আছে। সকলেই বেশ দুশ্চিন্তায়। এ সময় নৌকার ভেতর থেকে জানালা দিয়ে চোখে পড়ে একটি ছোট কুমির নদী থেকে পাড়ে উঠে বনের ভিতরে প্রবেশ করছে। সবার দৃষ্টি চলে যায় কুমিরের দিকে। দুটি জানালা দিয়ে সবাই কুমিরটিকে দেখি। তবে খুব কম সময়ে কুমিরটি জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর মিনিট পাঁচেক পরেই হঠাৎ করে আমাদের নৌকায় প্রচন্ড একটি শব্দ হলো। আমরা প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেলাম। বোটটির সস্মুখ নদীর মাঝ বরাবর হয়ে যায়। নৌকার পেছন থেকে মিঠু ভাই কি হয়েছে জানতে চাইলেন। আর মিঠু ভাই এর সাথে আসা অপর সাংবাদিক ভাইয়ের পায়ে পানির পরশ অনুভব করে বিষয়টি বুঝতে তিনি সামনের দরজা খোলে দেন। আর দরজা খোলে দিতেই নৌকার সামনা থেকে প্রচন্ড বেগে ভেতরে পানি আসতে থাকে। নৌকা ডুবে যাচ্ছে কিনারা ভিরানোর জন্য মাঝিকে সজোড়ে জানালে মাঝি নৌকার মাথা দ্রুত পাড় অভিমুখে ঘুড়িয়ে দেন। কোন রকমে পাড়ের কাঁছাকাছি বোটটি গেলে একটি গুল গাছের পাতা ভর্তি ডাল নদীতে ভাসছিলো। বোট থেকে হাত বাড়িয়ে সে ডালটিকে ধরে সেটিকে টেনে টেনে গভীর জঙ্গলে আবৃত্ত সুন্দরবনের পাড়ে নৌকার মাথা ভিরাই। নদীতে প্রচন্ড ¯্রােত। একে একে সবাইকে গভীর জঙ্গলাকৃত বনে প্রবেশের জন্য অনুরোধ জানাই। একে একে সবাই উপরে উঠেন। মাঝি খোঁজে বের করেন নৌকার সামনে প্রায় ১হাত অংশ ভেঙ্গে নৌকায় পানি প্রবেশ করছে। তিনি দ্রুত বোটের রসি দিয়ে বোটটিকে একটি গাছের সাথে বেঁধেদেন এবং নৌকায় রাখা কম্বল ,কাঁথা, বালিশ দিয়ে সেখানে চাপ দেন এবং নদীর কিনারা থেকে মাটি তুলে তা বন্ধ করার চেষ্টা করেন। ততক্ষনে নৌকা বেশ পানিতে তলিয়ে যায়। এদিকে বৃষ্টিও হচ্ছে। আমি বৃষ্টির মধ্যেই ক্যামেরা বের করে ছবি ও ভিডিও করতে থাকি। সবাই পাড়ে আমি নৌকায় এদিকে নৌকা ডুবে যাচ্ছে। সবাই আমাকে দ্রুত উপরে উঠতে অনুরোধ করছেন। ছবি তুলা শেষ করে আমিও উপরে উঠি। ঘন লতা পাতা ও গাছের শিকড়ে আবৃত এই স্থানে আমরা ১০ জন দাড়িয়ে আছি। আমরা ৬ জন আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ও মিঠুভাই ও তার সাথের একজন। আর হ্যাজ বোটের ড্রাইভার। নিচ দিকে তাকালে আমাদের গা চম চম করে উঠে। আশে পাশে কোন লোকালয় নেই। চোখের দৃষ্টিতে যতটুকু যায় কোন নৌকাও চোখে পড়ছেনা। এদিকে মাঝি প্রায় ২০ মিনিট চেষ্টা করে নৌকার ছিদ্র বন্দ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রত্যেকেই দুশ্চিন্তায়। আর আমার বার বার মনে হচ্ছে শুরু থেকেই বনের ভিতরে পায়ে হেঁটে ঘুরানোর ইচ্ছা ছিলো হয়তো উপরওয়ালা এভাবেই বিপদে ফেলে বনে ঘুরার ব্যবস্থা করে দেন। অনেকের মনেই এভাবে অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সবাই কিং কর্তব্য বিমুঢ়। এদিকে ভারী বর্ষন অন্যদিকে সন্ধা ঘনিয়ে আসছে। আর গভীর বনে বাঘ সাপসহ অনান্য প্রাণীরতো ভয় আছেই। পায়ে হেঁটে প্রায় ৫০/৬০ কিলোমিটার বিশাল বন ও বেশ কয়েকটি খাল পাড়ি দিয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি পৌছা কিছুতেই সম্বব নয়। এখানেই কোন নৌকার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। মিঠু ভাইয়ের চোখে মুখে বেশ টেনশনের চাপ ফুটে উঠেছে। এদিকে নৌকার চালক বার বার চেষ্টা করে ব্যর্থ। নৌকার ইঞ্জিন পানিতে তলিয়েছে। নৌকাটি হ্যাজ বোর্ডের হওয়ায় এটি হয়তো পানিতে ভাসমান থাকবে কিন্তু আমরা ১০ জন এর উপর দাড়ালে ভাসমান থাকবে না। আর কিছুক্ষনের মধ্যে জোয়ারের ভাটা আসবে আমাদের উপরের দিকে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। আমাদের মধ্যে একজন খুব চটফটে ছিলো। সে একটি গুলগাছের মাঝা ভেঙ্গে তার উপর এক পায়ের ভর দিয়ে দাড়িয়ে থাকে এবং নানান সব ভয়ংকর কথাবার্তা বলতে থাকে। তখন বৃষ্টি কিছুটা কমে যায়। হঠাৎ জঙ্গলের ভিতরে গাছের পাতার প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে। মিঠু ভাই সবাইকে চুপ থাকতে বললেন। শুধুই গাছের পাতা নড়ার শব্দ আসছে কিন্তু চোখে কিছু পড়ছেনা। কেউ বলছেন হয়তো ভেতরে বাঘ আছে মানুষের গন্ধ পেয়েছে। কেউ বলছে গাছ চোর গাছ কাটছে। আবার কেউ বলছে হয়তো ভেতরে বনদস্যু আছে গাছ নেড়ে শব্দ করে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। আমরা মহাবিপদে। যদি বাঘ আসে আর পানিতে নামি তাহলে সেখানে কুমিরের ভয় আছে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ভয় আছে। সকলের প্রকর দৃষ্টি বনের দিকে। কেউ কেউ হাতে ডাল পালা বা অন্য কিছু নেয়ারও চেষ্টা করেন কিন্তু সেখানে জীবন রক্ষার জন্য কিছুই পাওয়া যায়নি। এদিকে বৃষ্টি পুরো পুরি থেমে যায়। আর জঙ্গলের শব্দ আরো বড় হচ্ছে। অথাৎ কিছু একটা আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। সবাই স্তব্দ। আমরা সিন্ধান্ত নেই রসি দিয়ে বেঁধে রাখা পানি ভর্তি হ্যাজ বোটটিতে গিয়ে উঠবো কিনা। এসময় শব্দ খুব জোড়েসোড়ে আসে এবং তা অনুমান হয় আমাদের মাথার উপরের দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোখে পড়ে আমাদের পেছনে গাছের পাতা গুলো প্রচন্ড ঝাঁকুনী দিচ্ছে। আমরা অনেকটা পানিভর্তি হ্যাজ বোটে উঠার জন্য উদ্যত হই। এসময় আমাদের ভ্রমন সংগী সজল দেব এর চোখে ধরা পড়ে কয়েকটি বানর আমাদের কাছাকাছি এসে বসেছে। নিমিষের মধ্যেই যেন আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। এদিকে বানর দেখে আমাদের অপর সংগী হীরা শুরু করেদেয় বানরের সাথে বাদরামী। দু একজন এতে মজা পেলেও মিঠু ভাই জানালেন এই এলাকার বানর মানুষের সাথে পরিচিত নয়। এরা জংলী বানর তাদের বিরক্ত করলে ক্ষতি করতে পারে। হীরা মিঠু ভাইয়ের কথা শুনলো। আবারও বৃষ্টি আসে। আমাদের গাছ নড়ার ভয় কাটলেও আমাদের এখান থেকে উদ্বারের কোন উপায় না দেখে সবারই মন ক্রমশ দূর্বল হতে থাকে। অনেকেই যে যার মতো করে যার যার ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা শুরু করেন। তখনও দুটি বানর আমাদের দেখছে। বিপদের মধ্যেই মনে এলে হয়তো তাদের (বানর) রাজ্যে আমাদের আগমন উপলক্ষ্যে তারা আমাদের স্বাগত জানাতে এসেছে। অথবা এই বনের ভিতরে প্রবেশ করলে আরো বিপদ হতে পারে সেই আবাস দিতে এসেছে। এসময় সফর সংগী হীরা খুব জোড়ে চেঁচাতে শুরু করলো“ কেউ আছো আমাদের উদ্বার করো, আমাদের নৌকা ডুবে গেছে”। বার বার সে তা রিপিট করছে। কোন সাড়া শব্দ নেই। হঠাৎ করে সে আবারও চেঁছিয়ে উঠলো “ ও ভাই কেউ আছো আমাদের সাপে কেটেছে, আমাদের বাঁচাও”। তার এ অলক্ষনে ভাসায় চেঁছামেচির জন্য আমরা সবাই তাকে তিরস্কার করতে থাকি। এর কিছুক্ষন পর হঠাৎ আমাদের কানে আসে একটি ইঞ্জিন বোটের শব্দ। মিঠু ভাই দ্রুত পানি ভর্তি হ্যাজ বোটের পেছন অংশে চলে যান। তার সাথে সাথে আমি নিজেও যাই। কিন্তু শুধু শব্দই কানে ভাসছে। কোথাও কোন নৌকার দেখা নেই। কিছুক্ষন স্থির থেকে কোন দিক দিয়ে এই শব্দ আসছে তা অনুমান করার চেষ্টা করলাম আমরা। এ সময়ই চোখে পড়ে প্রায় এক কিলোমিটার দুরে সাগর অভিমুখে মংলার দিক থেকে একটি ট্রলার আসছে। মিঠু ভাই খুব জোরে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের বিপদের কথা জানানোর চেষ্টা করেন। নৌকাটি আমাদের দিকেই আসছে দেখে সকলের মনের মধ্যে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে। তবে নৌকাটি আমাদের মধ্যে আসার পূর্ব পর্যন্ত আবারও আমরা নতুন এক আতংকে জড়িয়ে পড়ি। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বললেন আমরা কাছাকাছি কোথাও নৌকা দেখলাম না হঠাৎ কোথা থেকে এই নৌকাটি আমাদের দিকে আসছে। ভয় এরা জলদস্যু নয়তো। মিঠুভাই জানালেন ওরা আসলে শুধু তিনি কথা বলবেন আমরা যেন কোন কথা না বলি। ক্রমশ: নৌকাটি কাছে আসতে লাগলো নৌকার উপরে বেশ কয়েকজন লোক প্রায় সমানে সিগারেট টানছেন। প্রত্যেকের চোখে মুখেই পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে। কাছে আসতেই মিঠু ভাই ঐ নৌকায় শামীম সাহেব নামে তার পরিচিত একজনকে দেখতে পান। তাকে জানালেন বিপদের কথা। ঐ নৌকার অপর একজন জানান, তার কানে একটি শব্দ বারি দেয় কেউ একজনকে সাপে কামড়িয়েছে। এটি শুনেই তারা এ দিকে ছুটে আসেন। আমরা তাদের জানালাম অনেকক্ষন ধরে আমরা এখানে আটকা রয়েছি উদ্ধারের জন্য নানা ভাবেই আমরা ডাকাডাকি করি। এ সময় আমাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসায় তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই । এসময় তারা কিভাবে ঘটনাটি ঘটেছে জানতে চাইলে আমাদের বোট চালক সঠিক কোন উত্তর দিতে পারেননি। আমাদের ধারনা জোয়ারের পানিতে কোন গাছ তলিয়ে গিয়েছিল যা বোট চালক দেখতে পাননি। তবে সমস্যা বাধে আরও একটি ।
আমরা যেখানে আটকা পড়ি সেখান থেকে প্রায় ৪ ঘন্টার রাস্তা মংলা বন্দর। দুরত্ব ৫০ কিলো মিটারের মতো হবে। কিন্তু তারা এখন মংলায় যাবেন না। এখানে জাহাজে তাদের কাজ। মিঠু ভাই তাদের কাছে তার চাচা যে জাহাজে আছেন সে জাহাজ কোথায় জানতে চাইলে ঐ নৌকা থেকে মিঠু ভাইএর পরিচিত শামীম সাহেব বলেন এখান থেকে সাগর অভিমুখে আরো আধাঘন্টার রাস্তা। এ সময় মিঠু ভাই ঐ জাহাজে পৌছে দেয়ার অনুরোধ করলে তারা হাসি মুখে তাতে সম্মত হন। আমাদের জিনিশপত্র সহ আমরা ঐ নৌকায় উঠে পড়ি এবং হ্যাজ বোটের চালককে মিঠু ভাই জানান, জাহাজে গিয়ে নৌকার মালিককে ফোন করে তাকে উদ্ধারের জন্য আসতে বলবেন। এসময় উদ্ধারকারী নৌকার একজন আমাদের মাঝিকে বললেন তার নৌকার পানি কমানোর চেষ্টা করতে তারা আমাদের জাহাজে দিয়ে আবার তার কাছে আসছেন। তারা আমাদের জাহাজে তুলে দেন। সেখানে জাহাজের সেফ আগে থেকেই আমাদের জন্য ডাল, ভাত ভাজি রেধে রাখেন। আমরা যাওয়ার পর আমাদের মাছ ও মাংস রান্না করেন। আমরা খাওয়া দাওয়া করি। খাওয়া দাওয়ার পর বিশাল জাহাজটি ঘুরে দেখি। তবে দ:ুশ্চিন্তা তখনও কাটেনি। ফেরার নৌকার কোন ব্যবস্থা হয়নি। তবে মিঠু ভাই বন্দরে ফোন দিয়ে নৌকা পাঠানোর জন্য বেশ কয়েকজনকে অনুরোধ করেন। কেউই দীর্ঘ পথ আসতে রাজী হচ্ছেন না। কারন জলদস্যুর ভয় আছে। মিঠু ভাই জানালেন প্রয়োজনে আজ রাত জাহাজেই কাটাবো পরের দিন সকালে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো। এসময় মিঠু ভাই এর চাচা জানালেন কিছুক্ষন পর তাদের জন্য কিছু জিনিষ পত্র নিয়ে ছোট একটি ইঞ্জিন নৌকা আসবে। তাকে তিনি অনুরোধ করে দেখবেন। যথারীতি ছোট একটি নৌকা আসলো। কিন্তু নৌকায় বেশ কয়েকজন মানুষও আছেন। আমরা বলার আগেই ঐ নৌকার মাঝি সামনের জাহাজ থেকে কয়েকজন লোক নিয়ে মংলা বন্দরে যাবে বলে জানায়। আমাদের নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে জানায় নৌকায় জায়গা হবে না তবে এক দুইজনকে হয়তো নিতে পারবে। এক পর্যায়ে আমাদের সকল ঘটনা বলার পর এবং মিটু ভাই এর চাচার অনুরোধে তিনি আমাদের নিতে রাজী জন। আমরা চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকায় উঠি। মাঝি সতর্ক করে দিলেন আমরা যেন মোবাইলের লাইট না জ্বালাই, কথাবার্তা কম বলি এবং নড়াচড়া কম করি। কারন পথে জলদস্যুর ভয় রয়েছে এবং নৌকা ছোট নড়াচড়া করলে ডুবে যেতে পারে। আমরা মাঝির কথামতোই নিরবে নৌকায় বসে রইলাম। ভরা নৌকা তার উপর সামনের আরো একটি জাহাজ থেকে আরো কয়েকজন লোক নৌকায় উঠে। আমরা প্রায় দুই ঘন্টায় মংলা থানায় নির্মানাধিন সাইলো / খাদ্য গুদামের কাছে চলে আসি। মিঠু ভাই বললেন, এখন আর ভয় নেই। তবে আমরা ইচ্ছে করলে মংলা পোর্ট থেকে মটরসাইকেল আনিয়ে এখান থেকেও যেতে পারি। এতে কমপক্ষে এক ঘন্টা সময় বাঁচবে। আমরা রাজী কিনা। আমরা রাজী হয়ে গেলাম। আমরা নেমে পড়লাম স্যালোর পাশে। ফোন করে মটর সাইকেল আনা হলো। সেখানে ৫টি মটর সাইকেলে আমরা আরো আধা ঘন্টায় রাত ১২টার দিকে মংলা বন্দরে এসে পৌছি। এর পর খেয়া পার হয়ে আমরা রাত দেড়টার দিকে খুলনা সদরে আমাদের হোটেলে যাই। রাতে সবাই ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ি। পর দিন সকালে মনে হয় আগের দিনের পুরো ঘটনা যেন আমরা স্বপ্নে দেখেছি।
পরের দিন খুলনার বিভিন্ন দৃষ্টি নন্দন জায়গা দেখি। খুলনার প্রসিদ্ধ চুইঝাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংস খাই। আমাদের সাথে ভ্রমন সংগী আশিষদে নিরামিষ ভোজি। তিনি খুলনা ইস্কন মন্দীরে আহার সারেন।
ভ্রমনের পাশাপাশি খুলনার বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব বিএম এর সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ বাহারুল আলম, মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াছ আলী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মহেন্দ্র নাথ সেন, সাংবাদিক বাবুল আক্তার ও সাংবাদিক শিশির রঞ্জন মল্লিকসহ আরো কয়েকজন সুধীজন ও সাংবাদিকসহ আমরা এস ও এস হ্যারমান মেইনর স্কুল ও খুলনা সরকারী মডেল স্কুল এন্ড কলেজে “আপন আলয় বিশ্বভুবন” সংকলন বিতরণ করি।
বলা চলে ভ্রমনকালে খুলনার সাংবাদিক, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদদের ভালোবাসায় আমরা সিক্ত হই। আরো এক রাত খুলনায় থেকে আমরা যশোর, নড়াইলের প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী এস এম সুলতানের বাড়ি হয়ে পদ্মার ফেরী পারও হয়ে ঢাকা আসি। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল। ভ্রমনকালে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সহ¯্রাধিক “আপন আলয় বিশ্বভূবন” সংকলন বিতরণ করি।
আনন্দ উপভোগ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্যদিয়ে সাপ্তাহ ব্যাপী খুলনা ভ্রমন শেষ হয়, তবে আমার খুব প্রিয় এক ব্যাক্তির কাছ থেকে উপহার পাওয়া একটি হাই রেজুলেশনের ক্যামেরা মোবাইল মিসিং স্মৃতিবহ এই ভ্রমনকে কালিমা লেপে দেয়। প্রিয় ব্যাক্তির উপহার ছাড়াও ঐ মোবাইলটিতে ছিল পুরো ভ্রমনের অনেক গুলো ছবি। যা পুনরবার উঠানো হয়তো আর সম্ভব নয়। আর শেষ কথায় বলা যায়, এই ঘটনার জন্য আমাদের বাকী জীবনে স্মৃতির পাতায় ভাসমান থাকবে সুন্দরবন ।
মন্তব্য করুন