সুস্থ সবল ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নাই
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ খাদ্য মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান এবং রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। এ অধিকার সংরক্ষনে রাষ্ট্রের সবগুলো অঙ্গ অঙ্গীকারাবদ্ধ। শিল্পায়নের চূড়ান্ত বিকাশের যুগে খাদ্যের আগে আরও একটি বিশেষণ যুক্ত হয়েছে তা হলো নিরাপদ খাদ্য। অতিমাত্রায় অনিরাপদ এবং স্বল্প পুষ্টি সংবলিত খাদ্য গ্রহনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং গুনগত মানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের মানুষ ক্রমশ নি¤œমানের খাদ্যগ্রহনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে। ফলে তারা কাঙ্খিত মাত্রায় উৎপাদনশীলতা প্রদর্শন করতে পারছে না। আমাদের দেশের অনেক মানুষের মাঝেই এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে। যেনতেনভাবে উদরপূর্তি হলেই তাকে খাবার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রকৃত বিষয় হলো, এ ধারনা মোটেও ঠিক নয়। খাদ্য গ্রহনের সময় তাতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান থাকবে না। থাকলেও তা দেহের জন্য সহনীয় মাত্রার হবে। আবার উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরো একটি তাড়না আছে তা হলো সব নাগরিকের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খাদ্য নিরাপত্তা হলো মানুষের সব সময় পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা। নিরাপদ খাদ্যে আইন ২০১৩ অনুযায়ী ভেজাল খাদ্যের অর্থ –
ক. কোনো খাদ্য বা খাদ্য দ্রব্যের অংশ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাতœক ক্ষতিকর বা জীবনহানির কোনো রাসায়নিক ভারী ধাতু বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, বা খ. মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো খাদ্যদ্রব্য অথবা কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন কোনো উপাদান মিশ্রিত খাদ্য দ্রব্য, বা গ. খাদ্য দ্রব্যের সঙ্গে কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ কোনো উপাদান মেশানো, রঞ্জিত করা, আবরণ দেয়া বা আকার পরিবর্তন করা। যার ফলে খাদ্যের গুনাগুন বা পুষ্টিমান কমে যায়, ঘ. খাদ্য দ্রব্য বিকিরণ সহ কোনো দূষক বা বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি, যা খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী, ক্রেতা বা গ্রহনকারীর স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর বাস্তবায়নের পাশাপাশি নাগরিক উদ্যোগে ভেজাল এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী। সুস্থ সবল এবং সমৃদ্ধ জাতি গঠনে নিরাপদ খাদ্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে দেশে প্রায় ২৫ লাখ অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পোদ্যোক্তা রয়েছেন, যাদের উৎপাদিত খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ফলে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহন করছে। এতে তারা উদরাময় সহ বিভিন্ন রোগে ভুগছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় অনিরাপদ খাদ্য গ্রহনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশী উৎপাদনশীলতা নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের মানুষের খাদ্যভ্যাস নিয়ে গবেষণা করেছে। গবেষনায় দেখা গেছে যেসব দেশের মানুষ খাদ্য গ্রহনের বিষয়ে অসচেতন তাদের উৎপাদনশীলতা তুলনা মূলকভাবে কম পরিমান খাদ্য গ্রহন করেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মানুষের চেয়ে তাদের গড় উৎপাদনশীলতা বেশী। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে অনিরাপদ খাদ্য গ্রহনের ফলে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিনিয়তই উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। ২০১৬ সালে ২৮টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাংকের দ্যা সেফ ফুড ইমপারেটিভ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে দেশগুলোর মধ্যে উৎপাদশীলতা হারানোর ক্ষেত্রে বাংলাদশের অবস্থান দশম। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সুস্থ সবল ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে দেশের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। কাংখিত মাত্রায় দেশের উন্নতি সাধন হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপদ খাদ্যের ইস্যুটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। তবে এটাই শেষ কথা নয়। সাধারণ মানুষকেও নিরাপদ খাদ্য গ্রহনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্যমতে প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহনের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহনের কারণে প্রতিবছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন। ভেজাল খাদ্য গ্রহনের ফলে দেশে হেপাটাইটিস, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলছে। ২০১৫ সালে দিনাজপুরে কীটনাশক মিশ্রিত লিচুর বিষক্রিয়ায় ৮ এবং ২০১২ সালে একই কারণে ১৪ জন শিশুর প্রানহানি ঘটে। বিভিন্ন গবেষনায় দেশের অনিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। পোলট্রি ফার্মের ডিমে ট্যানরি বর্জ্যের বিষাক্ত ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। আনারসে হরমোন প্রয়োগ করে দ্রুত বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলে আসছে বহুকাল ধরে। আম গাছে মুকুল ধরা থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত রাসায়নিক ব্যবহারের খবর প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি করা বন্ধ করা যাচ্ছেনা। যে কোন মূল্যে এসব প্রতিরোধ করা সময়ের দাবি। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল মেশানো এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। এ আইনে ১৪ বছরের কারাদন্ডেরও বিধান রয়েছে। দেশের মানুষের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। ভেজাল বিরোধী অভিযান চলমান থাকলেও ভেজাল দানকারী চক্রকে দমন করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইনের যথার্থ প্রয়োগ দরকার পাশাপাশি ভেজাল প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তোলা দরকার।
কৃষিক্ষেত্রে খাদ্যশষ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করবে। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার জন্যও সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ আয়োজন অব্যাহত রয়েছে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত দেশের দিকে। সারা দেশে নিয়মিত ভেজাল বিরোধী অভিযান চলছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্যে কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। অতএব যে কোন মূল্যে অনিরাপদ খাদ্য বন্ধ করতে হবে, সমৃদ্ধ জাতি গঠনে নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। লেখক:- ব্যাংকার, গবেষক ও কলামিস্ট।
মন্তব্য করুন