সৈয়দ মহসীন আলী একজন মৃত্যুঞ্জয়ী বীর
মাটি ও মানুষের সাথে যিনি মিশে আছেন-তিনি সৈয়দ মহসীন আলী। একজন মৃত্যুঞ্জয়ী বীর। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রিয় চেয়ারম্যান গনমানুষের নেতা, সংস্কৃতিপ্রেমী, এমপি, মন্ত্রী পরোপকারী বিশেষনের যার শেষ নেই। তিনি আমার গর্বিত পিতা। আমি সাংবাদিকতায় অনার্স মাস্টার্স করেছি। পড়াশুনা শেষ করার পর বেশিদিন লেখালেখি করতে পারিনি। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি ছাত্রলীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে। তবুও যা লিখেছি আব্বাকে নিয়ে বেশি লিখেছি। আব্বাকে নিয়ে লিখতে গেলে চোখের সামনে অনেক ইতিহাস চলে আসে। চোখের কোনে জমে অশ্রু। সৈয়দ মহসীন আলীর মতো বহুমাত্রিক গুনাবলীর মানুষকে নিয়ে লিখতে গেলে তো শুধু লিখতেই হবে।
বিচক্ষন রাজনীতিবীদ অসাধারণ দেশপ্রেম, উদার মন মানসিকতা,স্পষ্টভাদিতা আর সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্থ সৈয়দ মহসীন আলী ছিলেন বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। সততা আর নিষ্টার জন্য তিনি গনমানুষের প্রিয়জন হয়ে উঠেছিলেন।
আমরা তিন বোন। যখন ছোট ছিলাম, আব্বা তখন পৌরসভার জননন্দিত চেয়রম্যান। আমরা সকালে স্কুলে চলে যেতাম, আর আব্বা পৌরসভার কাজ শেষ করে গভীর রাতে বাসায় ফিরে সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘুমাতেন। মনে পড়ছে সেই সময় সপ্তাহ চলে যেত আব্বার সাথে দেখা হতো না। কারণ আব্বা যখন ফিরতেন তখন আমরা গভীর ঘুমে থাকতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম বাসায় বহু মানুষের ভিড়। সবাই আব্বার জন্য অপেক্ষা করতেন। বিচিত্র মানুষ বিচিত্র সমস্যা নিয়ে আসতেন। তাদের কাছে সৈয়দ মহসীন আলীই সমস্যা সমাধানের শেষ ভরসাস্থল। সৈয়দ মহসীন আলী মানেই সমস্যার সমাধান হবেই এরকম একটা ধারনা ছিল সবার মধ্যে।
ছোটবেলা থেকেই দেখছি আব্বা কম কথা বলতেন, শুনতেন বেশী। মাঝে মাঝে অবাক লাগত কীভাবে একটা মানুষ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত থাকতেন। এখন বুঝি সৈয়দ মহসীন আলী কেন মানুষের অন্তরে ঠাঁই নিয়েছেন। তিনি মানুষের কাজ করতে করতে মানুষের প্রতি আস্থাভাজন আর আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিজগুনে সাধারণ মানুষের কাছে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করছিলেন সমান তালে। মৌলভীবাজর-রাজনগরের মানুষের জন্য।
২০০৮ সালে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জনপ্রিয়তায় সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানকে হারিয়ে প্রথম এমপি হলেন। ৫ বছর এলাকার মানুষের উন্নয়নের জন্য দিবা রাত্রি কাজ করলেন। ২০১৪ তে এসে হয়ে গেলেন সমাজ কল্যাণমন্ত্রী। আমরা তো খুশিতে আত্মহারা। আব্বার সারাজীবনের কাজের স্বীকৃতি সমাজকল্যাণমন্ত্রী। যে কাজ তিনি সারাজীবন করেছেন। জীবনের শেষ দিকে এসে এতোবড় রাষ্ট্রীয় সম্মান। মৃত্যুর কয়েক মাস পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধে অসাধারন অবদানের জন্য দিলেন রাষ্ট্রীয় সর্ব্বোচ পদক-“স্বাধীনতার পদক”।
আব্বা অত্যন্ত Stylish একজন মানুষ ছিলেন। পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। সব সময় রঙিন কাপড়চোপড় পরিধান করতেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, লন্ডন, কানাডা, জার্মানী থেকে কেউ আসলে স্যুট আর জুতা আনতে বলতেন,বাসায় দরকারী ক্রোকারিজ নিজে কিনতেন। সবচেয়ে পছন্দ করতেন মানুষকে খাওয়াতে। কাউকে দাওয়াত দিলে রান্নার তদারকি নিজে করতেন। মন্ত্রী হওয়ার পর ও মিন্টো রোডের বাসায় প্রায়ই রান্নাঘরে চলে যেতেন। নেহারী আর ডালজুরী রান্না করতেন বেশী। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে মন্ত্রণালয়ের একটি অনুষ্ঠানের খাবার রান্নার জন্য নিজেই গিয়ে বাজার করেছিলেন। জীবনের সবক্ষেত্রে সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতেন। মন্ত্রী হওয়ার পর ৩৪, মিন্টো রোডের সরকারী বাস ভবনকে গাছপালা লাগিয়ে আরুপ দৃষ্টিনন্দন বাসভবনে রূপান্তর করেছিলেন। গ্লাস ঘেরা একটি রুম বানিয়ে ছিলেন যা থেকে চাঁদ আর বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যেত। মৌলভীবাজারের বিভিন্ন জায়গায় ফুল-ফলের চারা লাগিয়েছিলেন। সার্কিট হাউস আর সদর হাসপাতালের সামনের দৃষ্টিনন্দন বাগান গড়েছিলেন। মৌলভীবাজারের রোড ডিভাইডারে লাগানো বিচিত্র গাছ আজ শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধন করেছে।
মন্ত্রী হবার পর প্রায়ই অনুষ্ঠানে দেশের গান গেয়ে মানুষকে দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ করতেন। পূর্নিমা রাতে কবিতার আসর বসাতেন বাসায়। কবিতার বিভোর হতেন তিনি, বই, কবিতা আর গান ছিলো অবসরের বিনোদন। যেখানেই ভ্রমন করতেন সেখান থেকে বিচিত ধরনের বই, কবিতার বই সংগ্রহ করতেন।
আব্বা মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে আম্মা আর আমাদেরকে সময়ই দিতে পারতেন না। সত্যি বলতে আমরা আব্বাকে সেভাবে কাছে পাইনি। এখন মনে হয় সৈয়দ মহসীন আলী বাবা হিসেবেও সফল। আমরা তিন বোন পড়াশুনা করে মানুষ হয়েছি। ভালো মানুষ হওয়ার বীজ তিনি আমাদের মাঝে ছোট থাকতেই পুঁতে দিয়েছিলেন। আজ আমি রাজনীতি করছি, সমাজ সেবা করছি, আব্বার দেয়া শিক্ষার জন্যই করতে পারছি। আব্বা যখন ঢাকা যেতেন চেয়ারম্যান থাকাকালিন সময়ে, তখন বিচিত্র ধরনের পেপার, বই ম্যাগাজিন নিয়ে আসতেন।
আমি ক্লাস ফোর থেকে প্রতিদিন খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন পড়তাম। সেই পেপার আর ম্যাগাজিন পড়তে পড়তেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম বড় হলে সাংবাদিকতায় পড়ব। আমরা পরিবারের সদস্যরা তাঁর আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলে ও তিনি অনেকের অভিভাবক ছিলেন। জীবনে সৎ থাকলে ভালো অনেক কিছু অর্জন করা যায়। মানুষের মনে বেঁচে থাকা যায় ভালো কাজ করলে। সৈয়দ মহসীন আলী আমাদের নীতি আর আদর্শের পথে হাঁটার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আজ মৃত্যুঞ্জয়ী বীর সৈয়দ মহসীন আলী মানুষের স্মৃতিপটে চিরভাস্বর। মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজে ঋণে জর্জরিত ছিলেন, বিলাসী জীবন-যাপন করতে পারেননি। তাই এখন আর দুঃখ নেই। দেশপ্রেমিক নির্ভিক যোদ্ধা আর সততার অনন্য প্রতীক সৈয়দ মহসীন আলী। গর্বিত পিতার সন্তান আমি।
-সৈয়দা সানজিদা শারমিন, সৈয়দ মহসীন আলীর কন্যা, সাধারণ সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলী ফাউন্ডেশন ও যুবলীগ নেত্রী।
মন্তব্য করুন