স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা
ইসমাইল মাহমুদ॥ বাল্যকাল থেকে জেনে এসেছি শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষিত মানুষই পারে সমাজের অত্যাচার, অনাচার দুর করতে। আর শিক্ষিত মানুষ তৈরির কারখানা অর্থাৎ স্কুল-কলেজের স্বাভাবিক গতি অব্যাহত রাখতে এবং শিক্ষিত সমাজ বির্নিমাণে স্কুল-কলেজের জন্য অত্যাবশ্যক হলো শক্তিশালী, কর্মতৎপর, শিক্ষিত মানুষদের নিয়ে গঠিত ব্যবস্থাপনা বা ম্যানেজিং কমিটি।
এ বিষয়ে একটি ছোট ঘটনার অবতারণা করা প্রয়োজন। ঘটনাটির স্থান শ্রীমঙ্গল। সঙ্গত কারনে স্কুলের নাম, ঘটনাকারীর নাম, কাল, সময় উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত হবে না বিধায় এগুলো রাখা হলো পর্দার অন্তরালে।
২০১৩ সালে হবিগঞ্জের একটি স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণি পড়–য়া একটি শিশুকে তার পিতা-মাতা মাতার পৈত্রিক নিবাস শ্রীমঙ্গলের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে নিয়ে আসেন। যথাযথভাবে সাবেক স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেটও আনা হয়। কিন্তু শিশুটির নানাবাড়ির পাশে যে স্কুলে শিশুটিকে ভর্তি করার কথা সে স্কুলে শিশুটিকে নিয়ে যাবার পর সেই সময়ের প্রধান শিক্ষক বেকেঁ বসেন। শিশুটির মাকে সাফ জানিয়ে দেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির অনুমোদন ছাড়া স্কুলে ভর্তি করা যাবে না। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আবার এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর সামনে দাড়িয়ে কথা বলার সাহস এলাকার কারো নেই। প্রধান শিক্ষক কর্তৃক শিশুটিকে স্কুলে ভর্তি করতে অনিহা প্রকাশ করার পরপরই ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এলাকায় দৌড়-ঝাপ শুরু হয় উপজেলা প্রশাসন, শিক্ষা অফিনের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম কর্মীদের। গণমাধ্যম কর্মীরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন প্রভাবশালী সভাপতির বাড়ি ও ওই শিশুটির নানাবাড়ি পাশাপাশি। ওই দুই বাড়ির মধ্যে পানির ড্রেন নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ম্যানেজিং কমিটির প্রভাবশালী সভাপতির কাছে যেন অসহায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকও। ‘টু’ শব্দটি করার যেন ‘জো’ নেই তাঁর। পরে এলাকার শিক্ষক নেতা, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম কর্মীদের হস্তক্ষেপে অনেক জল ঘোলা করে শিশুটি শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পেরেছিল ওই স্কুলে।
আলোচ্য নিবন্ধে এ ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে এ জন্য যে, সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী কোন শিশুই বিদ্যালয়ের বাইরে থাকবে না। আর এটি শিক্ষক-অভিভাবকদের সাথে সমন্বয় করে নিশ্চিত করবে ম্যানেজিং কমিটি। অথচ সভাপতির পরিবারের সাথে পারিবারিক বিরোধের কারণে একটি শিশুর শিক্ষা জীবনই থেকে যেতে বসেছিল।
এবারে জেনে নেয়া যাক স্কুল ম্যানেজিং কমিটি গঠন কেমন হওয়া উচিত, তাঁদের কর্মতালিকা কি কি এবং কমিটির কি যোগ্যতা থাকা উচিত।
আমরা যদি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকাই তবে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ স্কুলেই স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠনের অসংখ্য প্রমান আমরা পাই। ম্যানেজিং কমিটি সঠিক ও দিকনির্দেশনা মূলক পরামর্শ দিয়ে শিক্ষার মান দ্রুত উর্ধমুখির চেষ্টা করবেন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে অংশ নেবে এটিই হওয়া বাঞ্চনীয়। কিন্তু সরকারের ম্যানেজিং কমিটি গঠনের নীতিমালায় কমিটির সদস্য হতে কতটুকু শিক্ষিত হতে হবে তা উল্লেখ নেই। এ সুযোগে গ্রামের প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক দলের নেতারাই (যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকেন সেই সরকার দলের নেতারা) সম্মানের জন্য বাগিয়ে বসেন ম্যানেজিং কমিটির পদ-পদবী। কোন কোন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির দেখভালও দুরের কথা মাসিক সভায়ও সদস্যদের খুঁজে পাওয়া যায়। তবে কমিটির পদ-পদবী বাগিয়ে নিয়ে শিক্ষকদের উপর ছড়ি ঘুরাতে অনেকে সিদ্ধহস্ত। অনেক সময় নিজেদের পছন্দের মতামত শিক্ষকদের উপর জোড় করে চাপিয়ে দেন। এ অবস্থায় শিক্ষকরা ‘না পারি কইতে, না পারি সইতে’ অবস্থায় নিপতিত হন। ম্যানেজিং কমিটির বাহাদুরির! অসংখ্য অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি মন্তব্য করেছেন ‘মাতব্বরি করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন করা হয়নি’।
গত বছর দেড়েক আগে শ্রীমঙ্গলের একটি স্কুলে কমিটির সভাপতি পদ নিয়ে এলাকার দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। অনেক চেষ্টা করেও বিরোধ যখন মীমাংশা করা যায়নি তখন আমি স্বইচ্ছায় বিরোধ নিস্পত্তির দায়িত্ব কাধে তুলে নেই। উভয় পক্ষের সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক করি। সঅবশেষে দুই পক্ষের সম্মতিতে স্কুল বৈঠকে বসি। সমাধান হয় এ টার্মে সিনিয়র যিনি তিনি সভাপতি থাকবেন আর জুনিয়র যিনি তিনি হবেন সহ-সভাপতি। পরবর্তী টার্মে বর্তমান সভাপতি আর সভাপতি পদে থাকবেন না। জুনিয়র ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় এ পদ ছেড়ে দেবেন। তবে উভয়েই যদি ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হয়ে আসতে পারেন তবে এ প্রক্রিয়া বহাল থাকবে। উভয় পক্ষ এতে খুশি হন। তবে প্রতিনিয়তই এক পক্ষের বিরুদ্ধে আরেক পক্ষের অভিযোগ আমাদের শুনতে হয়। এমনি একটি অভিযোগ শুনে গেলাম ওই স্কুলে। সেদিন আবার ছিল মাসিক সভা। সভা শেষে আমি যখন স্কুলে উপস্থিত হই তখন কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর দেবার পালা। দেখলাম যিনি সভাপতি তার স্বাক্ষর দুটি নীচে একটি উপরে দাগ ছাড়া আর কিছু নেই। পরে যখন সহ-সভাপতি স্বাক্ষরের পালা আসলো তখন সহ-সভাপতি তার ছেলেকে শ্রেণিকক্ষ থেকে নিয়ে আসলেন স্বাক্ষর দেবার জন্য। কারণ তিনি স্বাক্ষর জানেন না।
মে মাসে শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে সনাক-টিআইবি আয়োজিত প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষকদের সমন্বয় সভায় আমার বক্তব্যে আমি প্রস্তাব করেছিলাম তারা যেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে প্রস্তাবনা পেশ করেন নুন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের স্কুল ম্যানেজিং কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করার। আমি মনে করি একজন শিক্ষিত ব্যক্তিই শিক্ষার মর্ম উপলব্ধি করতে পারবে। দেশের সকল স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে যদি শিক্ষিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্ত করা যায় তবে শিক্ষার প্রসার আরো দ্রুত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
স্কুল ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত নিন্মে উপস্থাপন করলাম-
০১. ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে অবশ্যই দুরদৃষ্টি সম্পন্ন, কমপক্ষে এইচএসসি পাশ, বয়স চল্লিশোর্ধ এবং সমাজ সচেতন হতে হবে।
০২. কমিটির অন্যান্য সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে কমপক্ষে এসএসসি পাশ।
০৩. ম্যানেজিং কমিটিতে যারা অন্তর্ভূক্ত হবেন তাদের হতে হবে সৎ, নির্ভিক ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য।
০৪. ম্যানেজিং কমিটির সদস্য যারা হবেন তারা যে কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শের অনুসারী হতে পারেন তবে জনপ্রতিনিধি (সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানদ্বয়, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার ইত্যাদি) ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলের পদবীধারী কেউ ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।
০৫. কোন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, মামলার চার্জশীটভূক্ত, মামলার এজহারভূক্ত কেউ ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হতে পারবেন না। কেউ যদি সদস্য হিসেবে ইতোপূর্বে অন্তর্ভূক্ত হবার পর কোন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, মামলার চার্জশীটভূক্ত, মামলার এজহারভূক্ত হন তবে তাৎক্ষনিত তার পদ শুন্য ঘোষণা করতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমার এ প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনায় আনলে দেশে শিক্ষার সুতিকাগার প্রাথমিক শিক্ষার মান দ্রুত উর্ধমুখী হবে। বিদ্যালয়গুলোতে স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে এবং দেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় গতি বৃদ্ধি পাবে।
মন্তব্য করুন