স্বাধীনতাযুদ্ধে আলেমদের অবদান

March 18, 2018,

এহসান বিন মুজাহির॥ দেশের মজলুম জনগণের স্বার্থে দেশের অনেক ওলামায়ে কেরাম তাদের জান-মালসহ সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী মনে করেন স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজের কোনো অবদান নেই। এমনটি মনে করার কোনো অবকাশ নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেমদের অবদান অনস্বীকার্য। আজাদী আন্দোলন, সিপাহী বিপ্লব, ইংরেজ খেদাও আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ দেশ ও জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্দোলনে আলেম সমাজ ছিলেন অগ্রগামী।

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ‘জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই’। এদেশের নিরীহ মানুষ ছিলেন মজলুম। বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ কখনও জালিমের পক্ষাবলম্বন করতে পারেন না। বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও বুজর্গ মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রাহ.) সে সময় স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন-‘এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হলো জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ’। পাকিস্তানীরা জালেম, এদেশের বাঙালিরা মজলুম। তাই সামর্থের আলোকে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং এটাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতে হবে’।

ফেদায়ে মিল্লাত আল্লামা হজরত হোসাইন আহমদ মাদানীর (রাহ) বিশিষ্ট খলিফা, আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী (রাহ.) ছিলেন একজন দূরদর্শী সিপাহসালার। তিনি তখন পাকিস্তানর পক্ষ অবলম্বন না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিপদগ্রস্ত বাঙালি মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে একবার তিনি আল্লামা আশরাফ আলী ধরমপুরী (রাহ) কে বলেছিলেন-‘আমি সূর্যের মতো স্পষ্ট  দেখতে পাচ্ছি যে, কিছু দিনের মধ্যেই এদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে এবং পাকিস্তানী হানাদারের জুলুমের কবল থেকে এদেশের জনগণ মুক্তি লাভ করবে’।

আড়াইহাজার থানার কমান্ডার মরহুম শামসুল হকের অধীনে আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রাহ) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-‘১৯৭১ সালে যখন আমি লালবাগ মাদরাসার ছাত্র তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধ শুরু হলে আমার মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি হাফেজ্জি হুজুর (রা) কে প্রশ্ন করলাম; হুজুর এ যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা কী? তখন হুজুর আমাকে বলেছিলেন-‘পাকিস্তানী জালিম হানাদার বাহিনীর জুলুম থেকে এদেশের মানুষকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। তাই বসে থাকার আর সময় নেই, জালিমদের কবল থেকে মজলুমদের বাঁচানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ কর’।তাঁর একথার উত্তর শুনে আমি অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

হজরত মাওলানা মুফতি মাহমুদও (রাহ) বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল বাঙালিদের পক্ষে। মাওলানা আব্দুস সালাম বলেন-’৭১ সালে আমি করাচিতে ইউসুফ বিন নুরী মাদরাসার ছাত্র। একদিন মুফতি মাহমুদ সাহেব মাদরাসায় এলে তাকে এক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বলেছিল, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। তাকে এখনই হত্যা করা হবে। তখন মুফতি সাহেব হুজুর রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন শেখ মুজিব একজন দেশপ্রেমিক মুসলমান’। মুফতি মাহমুদ (রহ) ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে পরিষ্কার ভাষায় পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগঠক হিসেবে এবং এদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহ ও সহযোগিতায় কমবেশি হলেও আলেম সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে। মাওলানা শাকির হোসেন শিবলির ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার  খোঁজে গ্রন্থ থেকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। কারণ সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন অসংখ্য আলেম ও পীর-মাশায়েখগণ। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন, আল্লামা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজি হুজুর, আল্লামা আসআদ মাদানী, আল্লামা শায়খ লুৎফুর রহমান বরুণী, চরমোনাইর পীর মাওলানা ইসহাক, আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহ), আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ, আল্লামা মুফতি নুরুল্লাহ, আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী (রহ) প্রমুখ।

স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিসাংবাদিত মুসলিম নেতা বিশ্বের প্রখ্যাত আলেম আওলাদে রাসুল সাইয়্যেদ আসআাদ আল মাদানীর (রাহ) ভূমিকা অবিস্মরণীয়। যখন পাকিস্তানী বাহিনী এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বোরোচিত হামলা চালালো, তখন তাৎক্ষণিক তিনি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালেন এবং নিরীহ বাঙালিদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে উলামায়ে কেরামদের ভূমিকা তথা অবদান দেখে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুল জলিল হজরত হাফেজ্জি হুজরের (রাহ.)এর হাতে বাইয়াত তথা মুরিদ হয়ে গেলেন।

এহসান বিন মুজাহির: আলেম ও সাংবাদিক ও প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।

ahsanbinmujahir@gmail.com

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com