স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ আরবি ভাষায় একটি প্রবচন হলো হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ঈমান। স্বাধীনতা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি নেয়ামত। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই নেয়ামতকে সুনিশ্চিত করেছে। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্মভূমির প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ছিল। প্রতিপক্ষ মুশরিকদের নির্যাতনে রসুল(সঃ) মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যেতে বাধ্য হন। যখন তিনি মক্কা ছেড়ে মদীনার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন তখন পিছন ফিরে প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি তাকাচ্ছিলেন এবং বলেছিলেন হে প্রিয় জন্মভূমি মক্কায় যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বাধ্য না করত আমি কোন দিন তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। মহানবীর মদীনা শরীফের ভালবাসার বিষয়টি সম্পর্কেও জানা যায়।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে দেশকে ভালবাসা ঈমানের দাবি। দেশ প্রেমের কারনেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করে বাংলাদেশের অনেক মানুষ জীবন দান করেছে অকাতরে। মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। স্বদেশপ্রেমই মুক্তিযোদ্ধাদের অমর করে রেখেছে। তাদের শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও দেশবাসীর অন্তরে তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল। স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভূমিকে ভালবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট থাকা ঈমানের দাবি। সাহাবায়ে কেরামও দেশকে ভালবাসতেন। সুদীর্ঘ তের বছর রসুল(সঃ) ও তার সাহাবীরা মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়ে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিজরতের পর মদীনায় হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত বিলাল(রাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন তাঁরা জন্মভূমি মক্কার স্মৃতিসমূহ স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। এ অবস্থায় মহানবী (সঃ) সাহাবীদের মনের অবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, হে আল¬াহ্ আমরা মক্কাকে যেমন ভালবাসি তার চেয়েও বেশি মদীনার ভালবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন। হযরত আব্দুল¬াহ্ ইবনে আব্বাস(রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রসুল(সাঃ) কে বলতে শুনেছি দুই প্রকারের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। প্রথমত সেই চক্ষু যা আল¬াহর ভয়ে কাঁদে, দ্বিতীয়ত আল¬াহ্র পথে সীমান্ত পাহাড়াদারি করতে করতে রাত কাটিয়ে দেয়। দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। নিজ দেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশমাতৃকাকে ভালবাসা সকলের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। ড. মুহাম্মদ শহীদুল¬াহ বলেছেন মানুষের তিনটি করে মা থাকে। একটি জন্মদাত্রী মা, একটি মাতৃভাষা আর একটি মাতৃভূমি। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পর লন্ডন টাইমস্ পত্রিকা একটি রিপোর্ট করেছিল, যদি রক্ত স্বাধীনতার মূল্য হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মূল্যেই স্বাধীনতা কিনেছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবজনক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছি। দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রাম সর্বোপরি নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি মহান স্বাধীনতার লাল সূর্য, পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ ও পতাকা। অসাধারণ ও অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কারণেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ম্যাকব্রাইড বলেছেনBangabandu Sheik Mujib was the soul of his nation. 1973 m‡bi e½eÜzi WvBwi‡Z wj‡L‡Qb As a man what concern mankind concerns me, As a Bengali I am deeply involved in all that concerns Bengalis . The abiding involvement is born of nourished by love enduring love, which gives meaning to my politics and to my very being. একজন মানুষ হিসেবে আমি সমগ্র মানবজাতি নিয়ে ভাবি। একজন বাঙ্গালী হিসাবে যা কিছু বাঙ্গালীর সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা যে ভালবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ডাইরীর এ লেখা তাঁর মানবতাবোধ ও গভীর দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বিবিসির জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাঙ্গালি জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। একাত্তরের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে অভিনন্দন জানাতে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন অভিমূখে ছিল জনতার ঢল। বিকেলে জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন এ দেশের মানুষ সত্য ও ইনসাফের পক্ষে সংগ্রাম করছে। তাদের দাবীর প্রশ্নে কোন আপস হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর এসব বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে উঠে অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্য। বর্তমানে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সুনাম অর্জন করছে তার সব কিছুর পিছনে আছে স্বাধীনতা। আর তার পিছনে সবচেয়ে গুরুত¦পূর্ণ ভূমিকা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সামাজিক খাতে এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বিশ্ববাসীর মুখে মুখে। আন্তÍর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ চীনের সমপর্যায়ে চলে যেতে পারে। সব মিলিয়ে তৈরী হয়েছে উন্নয়ন অগ্রগতির এক বিস্ময়কর পরিবেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে সাধারণ মানুষরা ঝাঁপিয়ে পড়ার কারনে দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিক তেমনি দেশের উন্নয়নের কারিগর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন এদেশের সাধারন মানুষ। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারী খাতের সম্মিলিত উদ্যোগ ও দেশকে দ্রƒতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বাংলাদেশের যে অর্জন যে অগ্রগতি তার কিছুই হয়তো সম্ভব হতো না যদি না বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি তৈরী হতো। লক্ষ লক্ষ শহীদ ও অগণিত মা বোনের জীবন সম্ভ্রম এর বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে তখনই সার্থক হবে যখন দেশের প্রতিটি মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবে মৌলিক অধিকারগুলো যথাযথভাবে ভোগ করতে পারবে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জলতম অধ্যায়। যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। স্বাধীনতার প্রধান আকাংখা ছিল সব ধরনের অধীনতা থেকে মুক্তি, গনতন্ত্র, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা। সহজ কথায় মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্নœ একাট শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। সমতা, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায় বিচার এই তিনটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটেছিল যা পরে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহন করা হয়। সেই কাংখিত সমাজ যদি ও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। তারপরও বাংলাদেশের অর্জন অনেক। ধানের উৎপাদন চার গুনের ও বেশী বেড়েছে। মঙ্গা হয়েছে ইতিহাস। মানুষের জীবনাচরনে পরিবর্তন এসেছে। ব্যবসা বানিজ্য বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আজকের এ অবস্থায় উন্নীত হতে দেশের কৃষক শ্রমিক উদ্যোক্তা ও সাধারন মানুষ কঠোর পরিশ্রম করছে। এদের স্বীকৃতি দিতে হবে। এদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরী করে দিতে হবে। মানুষের মানবাধিকার যাতে লংঘিত না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতির মজবুত ভিত্তির উপর দাড় করাতে আমাদের প্রবাসীদেরও রয়েছে বিরাট ভূমিকা। তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে টেকসই রূপ দিতে হলে নৈতিক চর্চাও বাড়াতে হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতার চর্চা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আসলে স্বাধীনতা হলো মানুষের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। স্বাধীনতার মানেই হলো নিজের মান সম্মান ও ধন সম্পদ ইত্যাদি নিয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের সেই নিশ্চয়তার উপরে বাধা সৃষ্টি করেছিল। বাংলা সাহিত্যের যুগ সন্ধিক্ষনের কবি নবীন চন্দ্র সেন স্বাধীনতার মূল্য সম্পর্কে তার এক কবিতায় লিখেছেন “চাহিনা স্বর্গের সুখ নন্দন কানন, মূহুর্তে পাই যদি স¦াধীনতা ধন।” ২৬ শে মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। এটি বাংঙ্গালির অসাধারন অর্জন। বাংলাদেশের মানুষের শৃঙ্খল মুক্তির দিন। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির দিন। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বিশ্বের বুকে স্বাধীনতার অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙ্গালী। দক্ষিন এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিল এদেশের মুক্তিকামী মানুষ । দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা । রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহংকার ২৬ শে মার্চ। ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের উপরে। পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে শুরু হয় ভয়াবহ গণহত্যা । দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্বের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিঃশর্ত আত্বসমর্পণ করে দখলদার বাহিনী। বিশ্ব মানচিত্রে আত্বপ্রকাশ ঘটে সার্বভৌম স¦াধীন বাংলাদেশ। “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশ্বেষে প্রাণ যে করিবে যে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই” বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে যারা নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তাদের সিংহভাগই ছিলেন তরুণ। আজকে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই তরুণ প্রজন্মের ওপর। তরুণরাই পারে স্বাধীনতার শহীদের ঋণ পরিশোধ করতে। গভীর কৃতজ্ঞতা ও বিন¤্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ শহীদ কে।
মোহাম্মদ আবু তাহের
লেখক
ব্যাংকার ও কলামিষ্ট।
মন্তব্য করুন