সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়ানো দরকার
ড. মোহাম্মদ আবু তাহের॥ সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইনটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে নৈরাজ্য বেড়েই চলছে। সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার ক্রমেই উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। দুর্ঘটনার প্রধান কারণ গুলো হলো ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বেপরোয়া গতি, চালকের অদক্ষতা, চালকের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, তরুন ও যুবকদের বেপরোয়া মটর সাইকেল চালানো দূর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজী মাদকাসক্ত চালক, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা, অবৈধভাবে ও ওভারটেকিং, চালকের আসনে হেলপার, অতিরিক্ত যাত্রী বহন ইত্যাদি। সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক অভিশাপের নাম। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। প্রায় সব দুর্ঘটনার পেছনেই গাড়ী চালকদের অমনোযোগিতা ও অদক্ষতা অনেকাংশে দায়ী। যানবাহন চালকদের ইউনিয়নের কাছে সরকার জিম্মি বললেও অত্যুক্তি হবে না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। এতে দেশের জিডিপির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তেমনি স্বজন হারানো বা পঙ্গুত্ব বরণ করার কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎপাদন শীলতা কমছে। সড়কে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনা দুর করতে হলে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা তৈরীর পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু দূভার্গের বিষয় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। দূর পাল্লার রুট গুলোতে অতিরিক্ত চালক রাখা ও চালকদের কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করে দেয়া দরকার। সড়কে নৈরাজ্য যেন বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি হয়ে দাড়িয়েছে। একেকটা যানবাহন যেন একেকটা দানবে পরিণত হয়েছে। একটু আগে যাওয়ার জন্য একজন যাত্রী বেশী পাওয়ার জন্য পরিবহন চালক ও তাদের সহকর্মীরা যা ইচ্ছা তাই করে। ফিটনেসহীন যানবাহনে ফুয়েল ও জালানী সরবরাহ বন্ধের নির্দেশনা রয়েছে উচ্চ আদালত থেকে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। সড়কে শৃঙ্খলা না থাকার ও দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো যানজট। এখন অনেক জেলা শহরে ও রাজধানী ঢাকার মতো যানজট দেখা যায়। মহাসড়ক গুলোর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সত্বেও সেখানে কম বেশী যানজট হচ্ছে। আবার যেখানে যানজট নাই, সেখানে বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালানোর ফলে মারাত্বক দূর্ঘটনা ঘটছে। বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা শহরের মানুষের জীবন যাত্রার দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জকে সামনে এনে তা মোকাবিলায় সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। চ্যালেঞ্জ দুটি হলো যানজট ও জীবনযাত্রার ব্যয়। এ দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঢাকা চট্টগ্রামের পাশাপাশি অন্যান্য সব জেলায় শিল্পায়ন, কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থ্াপন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানির দাম রেকর্ড পরিমানে বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারনে পরিবহন খাতের ভাড়া বেড়েছে, যে কারনে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ঢাকায় অসহনীয় যানজট অবস্থা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ফলে ঢাকা শহরের মধ্যে যান চলাচলের গতি নেমে এসেছে ঘন্টায় ৭ কিলোমিটারেরও কম। এ অবস্থায় অনেক বিমানের যাত্রী ও বিদেশগামী ফ্লাইট মিস করার খবর সংবাদপত্র থেকে জানা যায়। যানজট ব্যবস্থাপনার জটিলতার কারনে মানুষের জ্বালানির অপচয় হওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘন্টার ক্ষতি করছে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা ও গাড়ির অনুপাতে সড়ক দুর্ঘটনা বেশী হচ্ছে, প্রাণহানি ও হচ্ছে অনেক বেশী। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত, আহত ও পঙ্গুদের হতভাগ্য উত্তরাধিকারীদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ তথা বিমার টাকা পাওয়ার চেয়ে শতগুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো আদৌ তেমন পরিস্থিতির শিকার না হওয়া অর্থাৎ কারও সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত না হওয়া, আহত ও পঙ্গু হয়ে পড়ার মতো দুর্ভাগ্যের শিকার না হওয়া। দৈব-দুর্ঘটনার ওপর মানুষের কোন হাত না থাকলেও পূর্বাহ্নে সতর্কতা অবলম্বন করলে এবং সাবধান হয়ে চললে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়, ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস পায়। এ কথাটি সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য ও সত্য। কারণ সড়ক দুর্ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার এবং জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মূলে রয়েছে সংশ্লিষ্টদের অসতর্কতা ও দায়িত্বহীনতা। একথা ও সত্য সরকারের একার পক্ষে সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব নয়। এটি সমন্বিত প্রক্রিয়া, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক থেকে শুরু করে নাগরিকদের ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তবে সরকারি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অনেক বেশী। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে যাত্রী-পরিবহন মালিকরা ও শ্রমিকগণ আরও দায়িত্বশীল হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকার কারণে কেউ আইন অমান্য করার সাহস দেখায়না। আমাদের দেশে পথচারীরা ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারেনা। অনেক ফুটপাত দখল হয়ে গেছে। কোন কোন ফুটপাতে একটু জায়গা থাকলেও সেখানে দাড়িয়ে যাত্রীরা নিরাপদ থাকতে পারছেনা। পরিবহন চালকরা ফুটপাতে গাড়ি তুলে দিচ্ছেন। জুলাই ২০১৮ রাজধানীতে ফুটপাতের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষর্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে। তখন শিক্ষার্থীরা সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। দেশের ইতিহাসে এ ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছে ইচ্ছে থাকলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব।
পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ীর মধ্যে যাত্রীদের বসিয়ে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় প্রতিদিন লাখ লাখ আনফিট গাড়ী চলছে সড়কে। বিনা প্রশিক্ষণে বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালাচ্ছেন ড্রাইভার ও হেলপাররা। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে আনফিট গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সড়কে অশুভ প্রতিযোগীতা বন্ধ করতে হবে। কেউ যেন লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে না পারে সেটা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন মালিক শ্রমিকের কাছে যাত্রী সাধারণ জিম্মি হয়ে না থাকে সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর হতে হবে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি বেসকারি পর্য্যায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একটানা ৬-৭ ঘন্টার বেশী গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে ফিটনেসবিহীন ঝুকিপূর্ণ গাড়ি চালানো। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে ওভারটেকের প্রবণতা যে কোন মূল্যে বন্ধ করতেই হবে। উন্নত দেশ গুলোতে অনেক রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ও দেখা যায়না। শুধু সিসি ক্যামেরা আর সিগনাল লাইটের মাধ্যমেই ট্রাফিক কন্ট্রোল করা হচ্ছে। জনগণ ও জেব্রা ক্রসিং ব্যতীত রাস্তাই পার হয়না। আর আমরা জেব্রা ক্রসিং সামনে পেলেও তা দিয়ে যাইনা। আমাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। গণ পরিবহনে শ্রমিক নিয়োগের ব্যাপারে ও সচেতন হতে হবে, শৃঙ্খলা আনতে হবে। প্রায়ই বাসের হেলপার বা শ্রমিকদের কাছে যাত্রীরা হয়রানীর শিকার হন। চলন্ত বাসে ধর্ষনের খবর ও মাঝে মধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। যাত্রীদের সাথে মারামারির ঘটনায় যাত্রীদেরকে বাস থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনাগুলোই প্রমাণ বহন করে বাসে যাত্রীরা কতটা অসহায়। নারীরা যাতে গণপরিবহনে নির্বিঘেœ যাতায়াত করতে পারেন সেজন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। ওই ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। কি ভয়ংকর অবস্থা, ভাবতে অবাক লাগে। বাসে ওঠেও নারী নিরাপদ নয়। একটা নীতিহীন আদর্শহীন মূল্যবোধহীন অস্থির অশান্ত সমাজের মধ্যে যেন আমরা বাস করছি। ধর্ষক বা নির্যাতন কারীদের যথাযথ শাস্তি না হলে পরিবহন সেক্টরের অবাজকতা ও দূর হবেনা। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে লেখা লেখি সভা সেমিনার অনেক কিছুই হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না। নিরাপদ সড়ক ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নি¤েœাক্ত সুপারিশ করছি-
(১) দুর্ঘটনায় আহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
(২) দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহন প্রায় ৪৪ লাখ ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। প্রতিটি যানবাহন নিবন্ধন বছর বছর ফিটনেস নবায়ন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুকালে একটি নুন্যতম নির্দিষ্ট অংকের ফি আরোপ করে এই তহবিলে জমা করা যেতে পারে। তাছাড়া হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ, মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিএর ভ্রাম্যমান আদালতের জরিমানার অর্থ থেকে নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে এই তহবিল গঠন করা যেতে পারে।
(৩) গণ পরিবহন ব্যবস্থাকে যাত্রীবান্ধব করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
(৪) যানবাহনের গতি তারতম্য নিয়ন্ত্রন ওভারটেকিং ওভার লোভিং ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা (উন্নত দেশের মতো) গ্রহণ করতে হবে।
(৫) গাড়ী চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাৎক্ষণিক জরিমানা প্রয়োগ করার ব্যাপারে পুলিশের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
(৬) সিলেট ঢাকা মহাসড়ক চারলেন করার কার্যকরী উদ্যোগ ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৭) পথচারীদের আইন মানার জন্য সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের জন্য তহবিল গঠনের বিষয়ে রুল জারি করেছেন মহামান্য হাইকোর্ট। রুলে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৫৩ ও ৫৪ ধারা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে অবিলম্বে একটি আর্থিক সহায়তা তহবিল এবং বোর্ড অব ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই রুল জারি করেছেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
সড়কে শৃঙ্খলা বা নিরাপদ সড়ক এর বিষয়টির সাথে মানুষের জীবন মৃত্যু জড়িত। সরকারের বুঝতে হবে এর সঙ্গে জড়িত শুধুমাত্র জননিরাপত্তাই নয়, জড়িত সরকারের ভাবমুর্তির প্রশ্নও। এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০০৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বাংলাদেশে ৫১ হাজার ৬৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ৫০৬ জন, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বিদেশে ৯৮ শতাংশ মানুষ ট্রাফিক আইন মানে এবং আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ ট্রাফিক আইন মানে না। বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে আইন না মানার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এবং সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, পথচারী, যাত্রী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও গণমাধ্যম সহ সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্যোগ প্রয়োজন।
লেখক-সভাপতি, যাত্রীকল্যাণ পরিষদ, মৌলভীবাজার ও কলামিষ্ট, গবেষক, ব্যাংকার।
মন্তব্য করুন