হাওর জনপদে কৃষকের দুর্বিষহ জীবন যাপন
মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী॥যে হাওরপাড়ে এখন ধান কাটার মহোৎসব হওয়ার কথা সেই হাওরপাড়ে এখন চলছে কৃষকের করুন আর্তনাদ,চলছে মহাদুর্যোগ! ‘আল্লাহপাক ব্যতিত তাদের দেখার কেউ নেই।’ সত্যি বলতে কি এই প্রতিবেদনটি লেখতে গিয়ে বার বার অশ্রুসিক্ত হতে হলো হাওড়জনপদের লোকজনের অসহায় ভাষ্য শুনে। বৃহত্তর হাওরাঞ্চলে চলছে মহাদুর্যোগ। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাওরের উঁচু-নিচু সকল এলাকার জমিতে এখন কোথাও ৫-৬ ফুট পানি, কোথাও কোথাও গলা থেকে হাটু সমান পানি। কোন কৃষকই এক মুঠো ধান ঘরে তুলতে পারেনি। বড় হাওরের প্রায় সব কয়টিই ডুবে গেছে। হাওরপাড়ের মানুষ অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। শুধু সুনামগঞ্জ জেলাই নয়। বৃহত্তর হাওরপাড়ের একই অবস্থা। জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লার পাশাপাশী সন্নিকটবর্তী নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ডিঙ্গাপোতা হাওরে এখন অথৈ পানি। সোনালী ফসল হারানো বৃহত্তর হাওর জনপদের ৭ জেলার হাজার হাজার কৃষক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। হাওরে বসবাসরত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার পাশে কেউ নেই। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলার হাওর উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্থ ৪৮টি উপজেলার (মোট উপজেলা ৭০) মানুষের মধ্যেই এই হাহাকার-আর্তি। প্রযক্তিবিদ মোস্তফা জব্বারের মতে, হাওরপাড়ে এবারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমান ৪ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা বা ডলারে ৫৪৬ মিলিয়ন ডলার। এর মাঝে শস্য ক্ষতিহয়েছে ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫ হেক্টরের।
সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। কোথাও পানি নেমে যাওয়ায় পচে যাওয়া ধান গাছের গুমোট গন্ধ। মাঝে মাঝে পানিতে মাছ, হাঁস মরে পড়ে থাকার দৃশ্য। উঁচু এলাকায় দু’চারটি ধানী জমিতে ধান দেখা পাওয়া গেলেও কারো মুখে হাসি নেই। ফসল হারানোর যন্ত্রণায় সবাই যেন দিশেহারা। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা এখন আল্লাহর উপর ভরসা ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না। যে বিস্তীর্ণ এলাকা পানি থই থই করতো; মাছ ধরার কলরব উঠতো; সেই এলাকায় সুনশান নীরবতা। চিরচেনা হাওর এখন যেন অচেনা এক অথৈই সাগর।
দেশের উত্তর-পর্বাঞ্চলের ৭ জেলার প্রায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬১ হেক্টর জমি হাওর এলাকায়। হাওর বোর্ডের হিসাব মতে, মোট হাওরের সংখ্যা ৩৭৩টি। সুনামগঞ্জে ৮৫, হবিগঞ্জে ১৪, নেত্রকোনায় ৫২, কিশোরগঞ্জে ৯৭, সিলেটে ১০৫, মৌলভীবাজারে ৩ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওর রয়েছে। এই এলাকায় ৩৭৩টি হাওরের মাঝে ৪৭টি বড় হাওর রয়েছে। হঠাৎ ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে সুনামগঞ্জের ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৩১ হেক্টর, হবিগঞ্জের ১ লাখ ৯ হাজার ৫১৪ হেক্টর, নেত্রকোণার ৭৯ হাজার ৩৪৫ হেক্টর, কিশোরগঞ্জের ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৩ হেক্টর, মৌলভীবাজারের ৪৭ হাজার ৬০২ হেক্টর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৯ হাজার ৬১৬ হেক্টর হাওরের জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অশ্বখুরাকৃতি-বাটির মতো নিম্নাঞ্চল।
হাওর অঞ্চল ঘুরে মনে হলো সর্বত্রই দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। জরুরীভিত্তিতে প্রয়োজনী ব্যবস্থা না নিলে হাওর জনপদের অধিবাসীরা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ এলাকার প্রায় ৩ কোটি মানুষ এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ফসল হারিয়ে ভাটি অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের দিন কাটছে এখন অর্ধাহারে অনাহারে। নিরুপায় হয়ে অনেকেই জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছেন। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা. তাহিরপুর, মধ্যনগর, জামালগঞ্জ, দিরাই শাল্লার মানুষেরা কাজের সন্ধানে ঢাকা চট্টগ্রাম মহানগরীর পথে। ধর্মপাশা উপজেলার বেশির ভাগ অসহায় মানুষ ঢাকার কেরানীগঞ্জ, আবদুল্লাহপুর, কামরাঙ্গীরচর, গাজিপুরে বিভিন্ন কাজের সন্ধানে আশ্রয় নিয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। অনেকেই গরু-ছাগল বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললে তারা জানান, জীবন বাঁচাতেই গরু-ছাগল বিক্রী করছেন। তাছাড়া ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গরুকে খাওয়ানোর জন্য খড়ও পাওয়া যাচ্ছে না। সে জন্যই অর্ধেক দামে গবাদি পশু বিক্রী করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট ও কিশোরগঞ্জে এক লাখ ৭১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমির ধান পানিতে ডুবে গেছে। এতে ওই তিন জেলায় ২ কোটি ৫ লাখ মণ ধান কৃষকের ঘরে উঠছে না। ফসলডুবির ঘটনায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। নিজের ক্ষেতের ধান নষ্ট হতে দেখে অনেক কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় তলিয়ে গেছে ১৫ হাজার ১৮৫ হেক্টর বোরো জমির ফসল। এ উপজেলার ৮২ টি হাওরের মধ্যে ৪৬ টি হাওরের ফসল ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে। এ বছর এখানে ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করা হয়। জানা যায়, ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ধর্মপাশা উপজেলায় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল ডুবির ঘটনা শুরু হয়। এ উপজেলার ছোট বড় ৮২ টি হাওরের মধ্যে ৪৬ টি হাওরের বাঁধ ভেঙে বোরো জমির ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। এ বছর ৩১ হাজার হেক্টর চাষাবাদকৃত জমির মধ্যে ১৫ হাজার ১৮৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায়। সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের জাড়াকোনা গ্রামের কৃষক লিপু মজুমদার বলেন, আমি বোয়ালা হাওরের ১৮ কেয়ার জমি চাষ করেছিলাম। সে জমিও রোববার রাতে তলিয়ে গেছে এবং সোনামড়ল হাওরে ৬ কেয়ার জমি এখনো আছে। পানি যে ভাবে বাড়ছে সেটিও মনে হয় তলিয়ে যাবে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব আহমদ বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ৮২ টি হাওরের মধ্যে ৪৬ টি হাওরের ফসল ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুন খন্দকার বলেন, আমি উপজেলা চেযারম্যান সাহেবকে নিয়ে হাওর পরিদর্শনে আছি। বাকি বাঁধগুলো যাতে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব রকম চেষ্টা অব্যাহত আছে।
এদিকে,চার প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)’র অনিয়ম-র্দুর্নীতির কারণেই জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী, জামালগঞ্জ উত্তর ও তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯ হাজার হেক্টর বোরো জমির হালীর হাওর ডুবেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কালীবাড়ি বাঁধের চার পিআইসির সভাপতি হলেন, বেহেলী ইউপির ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য মনু মিয়া, ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য আবু সুফিয়ান, সংরক্ষিত ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রাশিদা আক্তার ও ৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য অজিত রায়। রবিবার রাতে হালীর হাওরের কালীবাড়ির বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকে। এদিকে হালীর হাওরের বাঁধ রক্ষায় এলাকার হাজার কৃষক আপ্রাণ চেষ্টা করলেও পিআইসি’র লোকজন এলাকা ছেড়ে দিয়েছিল বলে কৃষকদের অভিযোগ। বেহেলী ইউপি চেয়ারম্যান অসীম চন্দ্র তালুকদার কালীবাড়ি বাঁধের পিআইসি সভাপতিদের তাগিদ না দিয়ে ও হাওরের বাঁধ নির্মাণের তদারকি ফেলে যুবলীগের কমিটি আনতে রাজধানী শহরে অবস্থান করছিলেন বলে অভিযোগ করছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা। স্থানীয় ও একাধিক সূত্রে জানা যায়, হালীর হাওরের কালীবাড়ি বাঁধ নির্মাণে প্রথমে দুইটি পিআইসি গঠন করা হয়। একটির সভাপতি ইউপি সদস্য মনু মিয়া ও অন্যটির সভাপতি ইউপি সদস্য আবু সুফিয়ান। প্রথমে দুইটি প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয় ২৮ লাখ টাকা। পরে এই বাঁধের বরাদ্দ আরও ২২ লাখ বৃদ্ধি করতে নতুন করে আরো দুইটি পিআইসি গঠন করা হয়। একটির সভাপতি করা হয় ইউপি সদস্যা রাশিদা আক্তার ও অন্যটির সভাপতি অজিত কুমার রায়কে। একাধিক কৃষকরে অভিযোগ প্রকল্প বরাদ্দ ২২ লাখ বৃদ্ধি করে ৪৬ লাখে উন্নীত করলেও সময়মত কাজ শুরু করা হয়নি। মার্চ মাসে বাঁধের কাজ শুরু করা হয়। শুরু থেকেই বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে পিআইসির সভাপতিদের বিরুদ্ধে। কাগজে কলমে ইউপি সদস্যরা চারটি পিআইসির সভাপতি থাকলেও বাস্তবে সবগুলো প্রকল্পে কাজ করেছেন বেহেলী ইউপি চেয়ারম্যান অসীম চন্দ্র তালুকদার। তিনি ইচ্ছাখুশি ও দায়সারাভাবে বাঁধের কাজ করেছেন। ইউপি সদস্যরা শুধু কাগজে কলমেই দায়িত্ব পালন করেছেন। হালীর হাওর পাড়ের স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ কালীবাড়ি বাঁধের কাজ সঠিক সময়ে শুরু হয়নি ও সঠিকভাবে হয়নি। প্রকল্পের নামে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বার ও এসও মিলে লুটপাট করেছে। যদি বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ হত তাহলে এত সহজে বাঁধ ভেঙে যেত না।’
জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী শহিদুল ইসলাম বলেন,‘ ওয়াপদা (পানি উন্নয়ন বোর্ড) এর সকল কাজই হলো অনিয়ম আর দুর্নীতি। তাদের এমন কোন কাজ নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অকালে হাওরের ফসল ডুবির ঘটনা বার বার ঘটে। সময় এসেছে এবং সারা এলাকাবাসীর দাবি সকল অনিয়ম-দুর্নীতির গণতদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রসূন কুমার চক্রবর্তী বলেন,‘ হালীর হাওরের কালী বাড়ি বাঁধ নির্মাণে শুরু থেকে ব্যাপক অভিযোগ ছিল, সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে কাজ হচ্ছে না। যেহেতু এলাকাবাসী ও কৃষকদের কাছ থেকে নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। ’ (সুত্র-দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর, ৪ এপ্রিল ২০১৭)
বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদে সুনামগঞ্জ-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে ৪ ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা। এসময় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদকে লক্ষ্য করে পায়ের জুতাও নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধরা। বিক্ষুব্ধরা এসময় পূর্ব বীরগাঁওয়ের দক্ষিণ হাওরের রাঙ্গামাটিয়া বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ঠিকাদার ও পিআইসি’র শাস্তি দাবি করেন। এক পর্যায়ে সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাড.শফিকুল আলমকে ধাওয়া করে বিক্ষুব্ধরা। বিক্ষুব্ধদের কবল থেকে অ্যাড. শফিকুল আলমকে রক্ষা করার সময় পুলিশ ও কৃষকদের ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
সোমবার ৩ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২ টা থেকে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সামনে সুনামগঞ্জ-সিলেট মহাসড়কে অবস্থান নেয়। বিকাল সাড়ে ৩ টায় অ্যাড. শফিকুল আলম এই পথ দিয়ে জগন্নাথপুর যাওয়ার সময় অবরোধস্থলে গিয়ে অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে বক্তব্য দেন। এসময় বিক্ষুব্ধ কৃষকরা ‘ঠিকাদারের দালাল দালাল’ বলে মারমুখী হয়ে অ্যাড. শফিকুল আলমকে ধাওয়া দেয়। এই অবস্থায় বিকাল ৪ টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর কবির এসে বিক্ষুব্ধ কৃষকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। তিনি কৃষকদের সকল দাবি দাওয়ার প্রতি একাত্মতা পোষণ করেন এবং রাঙামাটিয়া বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দেন। বিকাল ৪ টায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। অ্যাড. শফিকুল আলম জানান, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে কৃষকদের পক্ষেই কথা বলছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ করলে তারা ক্ষেপে যায় এবং মারমুখী হয়ে ওঠে। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এদিকে, প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক সুনামগঞ্জ জেলার হাওরগুলোতে ফসল রক্ষার জন্য বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য নিয়োগকৃত ঠিকাদার ও পিআইসি’র অধিকাংশ কাজই ছিল চরম দুর্নীতিপূর্ণ। তারা নাম কা ওয়াস্তে কাজ করিয়ে বরাদ্দের পুরো টাকা লুপাটের খায়েশে মত্ত ছিলেন তারা। এবার বাঁধ নির্মাণে সরকারের বরাদ্দকৃত ৫৯ কোটি টাকাই নামমাত্রও কাজে না লেগে ব্যক্তি বিশেষের পকেট ভারী করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে বলে কৃষক ও সচেতন মহলের অভিমত। কোন বাঁধই পানির প্রাথমিক ধাক্কা সামলতে পারে নি। অভিজ্ঞতায় দেখা যায় প্রতিবছরই বাঁধ নির্মাণে অনুরূপ দুর্নীতি হয়ে থাকে। হাওরবাসীর অভিমত- রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি যারা ঠিকাদার, পিআইসি, প্রকৌশলী, আমলা, জনপ্রতিনিধি নামে পরিচিত তাঁরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই বাঁধ দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। তাই এই হাওর দুর্নীতির কোন বিচার হয় না কখনও। ফসল হানির ব্যাপকতা পেলে এইসব ক্ষমতাধররা ভোল পালটিয়ে সাময়িক কৃষক দরদী বনে গরম গরম কথা বলে কৃষকদের ক্ষোভকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি হিসেবে খ্যাত বাঙালি সহজ-সরল কৃষক সমাজ কিছুদিন পরই ভুলে বসেন নিজেদের ক্ষতির কথা। এভাবেই চলে আসতে দেখছি আমরা বছরের পর বছর। গতবছরও বাঁধ ভেঙে ফসল হানির ব্যাপকতা ছিলো। স্থানীয় জেলা প্রশাসন লোকদেখানো একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিলেন। কিন্তু ওই তদন্ত কমিটি কী তদন্ত করেছে আর কী রিপোর্ট দিয়েছে তা কেউ জানে নি। জনগণ জানতে পারে নি কোন দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার-পিআইসি’র বিল আটক করা হয়েছিলো কিনা, কাউকে কোন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছিলো কিনা। সংগতকারণেই সকলেই স্থির বিশ্বাস করেন যে গতবছর কোন ঠিকাদার-পিআইসি’র বিল আটকে থাকে নি। এবারও মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া এইসব ঠিকাদার-পিআইসি’র কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করবে না বলেই ভুক্তভোগী মহল মনে করেন। মানুষের কান্না-আহাজারিকে চাপা দিতে এবারও লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে আর কিছুদিন পরই ওই কমিটি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। একটি জনপদের লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখের অন্ন লুণ্ঠনকারীরা এই ভাবে দিনের পর দিন এস্টাব্লিশম্যান্টের সহায়তায় পার পেয়ে যাবে এমনটি কাম্য নয়। তাই এবার হাওরে হাওরে গণতদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের একটি আওয়াজ উঠেছে। এতে ঠিকাদার-পিআইসি-পাউবো মিলে কী পরিমাণ দুর্নীতি করেছে তার একটি চিত্র সকলের কাছে স্পষ্ট হবে। এরকম গণতদন্তের ফলাফল সরকার এড়িয়ে যেতে পারবে না।
হাওর দুর্নীতির এই গণতদন্ত কীভাবে হতে পারে? কোন ধরনের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বদলে স্থানীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির ব্যক্তিদের হতে হবে অভিজ্ঞ। তারা পাউবো থেকে প্রতিটি বাঁধের প্রাক্কলন সংগ্রহ করে বাস্তবে কতটুকু কাজ হয়েছে তার তথ্য উদঘাটন করবেন। এজন্য তাঁরা বাঁধ এলাকার কৃষকদের স্বাক্ষপ্রমাণ গ্রহণ করে লিখিত বিবরণ তৈরি করবেন। গণতদন্ত কমিশন কত টাকা বরাদ্দের বিপরীতে কত টাকার কাজ হয়েছে আর কত টাকা লুপাট হয়েছে তার হিসাব করবেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত প্রতিবেদন গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে সরকারের দায়িত্বশীলদের নিকট দাখিল করবেন। ওই গণতদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে সরকারের উপর সামাজিক চাপ বাড়াতে সামাজিক উদ্যোগকে সংগঠিত করতে হবে। এর বাইরে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার প্রার্থনার বিষয়টিও সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা উচিৎ। যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণের ভিতর থেকে এই সামাজিক প্রতিরোধের জায়গাটি প্রবল না হবে ততদিন পর্যন্ত দুর্নীতির মহামারীকে রোধ করা সম্ভব হবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এর অনিয়ম-দুর্নীতি, দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার-পিআইসির শাস্তি, ভারী বর্ষণ এবং অকাল বন্যায় সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ হাওরের কাঁচা ধান তলিয়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, পিআইসি ও ঠিকাদারদের বিচার এবং জেলাকে দুর্গত ঘোষণার দাবিতে এই মানববন্ধন আয়োজন করা হয়। সোমবার বেলা ১১ টায় শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘সচেতন হাওরবাসী’র উদ্যোগ এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, হাওরের বাঁধ নির্মাণে মন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিটি পর্যায়ের ব্যক্তিরা জড়িত। ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম আর দুর্নীতি হওয়ার কারণে বছরের পর বছর সুনামগঞ্জের লাখ লাখ কৃষকের বছরের একটি মাত্র বোরো ফসল পানির নিচে তলিয়ে যায়। এজন্য কোন সময়েই দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হয় না।
উল্লেখ্য, চলতি বছর সুনামগঞ্জে বোরো ফসলের আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। ৪২টি হাওরের ফসল রক্ষায় ৫৮ কোটি টাকা ৭০ লাখ টাকার বাঁধের কাজ হচ্ছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জের বৃহৎ ৩৭টি হাওরসহ মোট ৪২টি হাওরে ১০ কোটি ৭৭ লাখ ব্যয়ে ২২৫টি পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) ও ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৬টি প্যাকেজে ঠিকাদার দিয়ে বোরো ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করছে। পিআইসির কাজ ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ঠিকাদারের কাজ ৩১ মার্চের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পিআইসির ও ঠিকাদারের কাজ সময়মত শেষ হয়নি।
এব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন বলেছেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে আওয়ামী লীগ। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার কৃষক বান্ধব সরকার। সরকার বরাদ্দ প্রদানে কোন ত্রুটি করেনি। অথচ. হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে নানা অনিয়মের কথা শুনা যাচ্ছে। এটি মেনে নেওয়া যায় না।বিশিষ্ট লেখক, আইনজীবী হোসেন তওফিক চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জের হিসেবেই হয়তো আষাঢ় মাস আসার আগেই চৈত্র মাসে শুরু হয়েছে আষাঢ়ী বর্ষণ। গত ক’দিন থেকে কখনো থেমে থেমে আবার কখনো মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে ভাটী বাংলার সর্বত্র নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর পানিতে সয়লাব হতে চলেছে। ফলে সবখানেই মানুষ চলতি বোর ফসল নিয়ে আতংকিত হয়ে পড়েছেন। অজানা আশংকায় মানুষ এখন দিশেহারা। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের আশংকা বাড়ছে। ফসল প্রাপ্তির বুকভরা প্রত্যাশা মিলিয়ে যাচ্ছে। একদিকে নদী ভরাট হয়ে গেছে, পানি ধারন ক্ষমতা মারাত্মক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ ঠিকমত হয়নি। ঠিকাদার বা পিআইসির লোকেরা দায়সারা গোছের কাজ করেছে। ফলে নদীর পানি হাওরে প্রবেশ করছে সহজেই। হাওর সমূহেও পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। এতে ফসল বিনষ্টের আশংকা সর্বত্র। ইতোমধ্যেই জেলার বেশ কয়েকটি হাওরে পানিতে ফসল তলিয়ে গেছে। হাওর রক্ষা বাঁধ হুমকির সম্মুখীন। এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় হাওর এখন ঝুঁকিপূর্ণ। হাওরবাসী এখন ফসল রক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে হাওর রক্ষায় প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ঠিক এই বিপদের মুহূর্তে পিআইসি বা ঠিকাদারদের পাওয়া যাচ্ছে না। তারা লা-পাত্তা হয়ে পড়েছে, গা ঢাকা দিয়েছে। বর্তমানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা অভূতপূর্ব।
পূর্বে কখনো চৈত্রমাসে এ ধরনের সর্বনাশা বৃষ্টিপাত হয়নি বা পাহাড়িয়া ঢল নামেনি। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে ধরে নিয়েই কর্তৃপক্ষের সতর্ক থাকা উচিত ছিল। বাঁধের কাজ সঠিক সময়ে হলে হয়তো ফসল রক্ষা করা সম্ভব হতো। এজন্য সকল মহল থেকে দাবিও উত্থিত হয় কিন্তু কার কথা কে শুনে?
হাওর জনপদের হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান পানির নীচে, পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক ফলে হাওরের মাছও মরে যাচ্ছে, মরছে কামারের হাঁস, গরু ছাগল পানির দামে বিক্রি করেছেন কৃষকেরা। ঘরে নেই খাবার, আছে রোগ বালাই। অনেকেই হাওরের বিষাক্ত পানি ব্যবহার করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ছড়িয়ে পড়ছে পেটের পীড়া ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত নানা রোগ। হাওরের বিষাক্ত পানি ব্যবহার না করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে। সুনামগঞ্জসহ ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগামী ৭ দিন হাওরে মাছ ধরতে নিষেধ করেছেন। সেই সাথে হাওরের পানি ব্যবহার না করার জন্যও বলা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, হাওর এলাকার ধনী-গরিব সব মানুষের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। শুধু গরীব কৃষকই নয়, হাওর এলাকার ধনী কৃষকেরাও এখন দিশেহারা। সর্বত্র দেখা দিয়েছে হাহাকার। মাছ ও পানি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন হাওরপাড়ের কৃষকরা। ধানের পর এই দুটিই ছিল শেষ ভরসা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১২০ বছরের ইতিহাসে এমন চরম সংকট মোকাবেলা করতে হয়নি হাওরবাসীকে। ধর্মপাশা উপজেলার গুল্লা রাজাপুরের বাসিন্দা ইউনুছ আলী বলেন, ‘সর্বনাশা’ অকাল বানের পানি কৃষক, খামরি-মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা তছনছ করে দিয়েছে। নবান্নের ভরা মৌসুমে কৃষক, চাষী, খামারিদের ঘরে উৎসব, আনন্দের পরিবর্তে নেমেছে বিষাদের ছায়া। ঘরে ঘরে চলছে হাহাকার, মাতম। যেন নিরব দুর্ভিক্ষ (চৈত্রের নিদান) শুরু হয়েছে হাওর জনপদে। এমতাবস্থায় কিভাবে সারাবছর সংসার আর সন্তানদের লেখা-পড়া চলবে-সে চিন্তায় উদ্বিগ্ন সবাই।
এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না পারলে সামনে হাওরাঞ্চল মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের উত্তর-পূর্ব জনপদে। যদিও জেলা প্রশাসন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী পৌছানো হচ্ছে। কম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে ওএমএস-এর চাল ও আটা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল বলে জানিয়েছে রাজাপুরের কৃষক মাজাহারুল মিয়া। জামালগঞ্জ উপজেলার বেহলী ইউনিয়নের সমাজ সেবক মো: শওকত মিয়া জানান, বেহলী ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষের জমি ছিল হালির হাওরে। এবার হালির হাওর তলিয়ে যাওয়ায় ইউনিয়নের কৃষকরা ফসল হারিয়েছে। তাদের ঘরে নেই খাবার। হাতে নেই টাকা। হয়ে পড়েছে অসহায়। বেঁেচ থাকার জন্য ফসলহারা মানুষ কাজও পাচ্ছে না। কাজ দেওয়ার মত এলাকায় কোন লোকও নাই। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত, কে কাকে কাজ দিবে। সবাই অভাব অনটনের মধ্যে পড়েছে। তিনি আরো জানান, ইউনিয়নের আহসানপুর, উলুখানি, হরিনাকান্দি, যতিন্দ্রপুর আলীপুর, মামদপুর, বদনাকান্দি ৪ গ্রাম, বদরপুর,রাজাপুর,রহিমাপুর সহ এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের ফসলহারা অভাবী কৃষকরা কাজের সন্ধানে বাড়ী ছেড়ে ঢাকা গাজীপুর এলাকায় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে এবং সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারীতে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের ১০ টাকা ও ১৫ টাকা কেজির চাল এ এলাকার সবাই পাচ্ছে না। যারা পাচ্ছেন তাদেরকেও মাঝে মধ্যে দেয়া হচ্ছে। এ চালের সরবরাহ একেবারেই অপর্যাপ্ত। ত্রাণ সাহায্য নাই বললেই চলে। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার একমাত্র শনির হাওরটি ধান এখন পানির নীচে। কিছু এলাকা এখনও কোন উপায়ে টিকে আছে। এ হাওরেও পানিবদ্ধতায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে এ হাওর রক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম গত শুক্রবার প্রচুর বস্তা নিয়ে হাওর রক্ষা বাঁধে ছুটে যান। সারা দিন বাঁধে কাজ হয়েছে বলে জানা গেছে। সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওরাঞ্চলের গরীব কৃষকরা ফসল হারিয়ে অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে বাড়ী ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে পাড়ি দিচ্ছে, এ বিয়য়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, এটি আমার জানা নেই। পর্যাপ্ত চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। খোলা বাজারে ১৫ টাকা এবং সরকারের ১০ টাকা কেজির চাল সরবরাহ চলছে। খাবার সরবরাহে কোন সংকট নেই। ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ হয়েছে তারা বলেছেন পর্যাপ্ত চাল বাজারে সরবরাহ আছে। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক দোয়ারা বাজারের সাবেক এমপি এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন বলেছেন, সুনামগঞ্জ জেলাকে জরুরীভিত্তিতে দুর্গত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করার প্রয়োজন। তা না হলে আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এলাকার মানুষ। কলিম উদ্দিন মিলন বলেন, ভাটি বাংলার অধিবাসীদের সারা বছর চলতে হয় এক মওসুমের বোরো ধান দিয়ে। আর এর সঙ্গে বিকল্প জীবিকা হলো মাছ ধরা। এখানকার উৎপাদিত ধান এবং মাছ দেশের চাহিদার বড় একটি অংশ যোগান দেয়। কিন্তু এবার ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ বোরো ধান তলিয়ে গেছে। কলিম উদ্দিন বলেন, কৃষকের গোলায় ফসল উঠেনি। এরপর বিপর্যয় নামছে মৎস্য সেক্টরে। হাওরের পানিতে বিষক্রিয়ায় ভেসে উঠছে মরা মাছ। আর বিষাক্রান্ত মাছ খেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মারা যাচ্ছে খামারের হাঁস। কৃষকেরা নিরুপায় হয়ে তাদের গরু ছাগল বিক্রি করছে। আছে দেনা, অনেকে দেনার দায়ে দিশেহারা। ফসলহানির পর কয়েকদিন ধরেই হাওরে মাছ আর হাঁস মরছে। মরা মাছ, হাঁসের পচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। পানির পর বিষাক্ত হচ্ছে বাতাসও। খাদ্যের পর পরিবেশ বিপর্যয়ও দেখা দিয়েছে। যা থেকে নানা রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে হাওর জনপদে। এদিকে খাদ্য এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পানি দূষণমুক্ত করতে নানা ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে হাওরের পানিতে দু’দিন ধরে ঢালা হচ্ছে চুন। সেই সঙ্গে হাওর জনপদে মাইকিং করে বিষাক্রান্ত মাছ না খাওয়ার এবং হাওরে হাঁস না ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে এরই মধ্যে অনেকেই গবাদি পশু বিক্রি করতে শুরু করেছে। হাওর এলকার ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে এরইমধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ ও কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্যসহ নানা ধরনের সহায়তার কথা বলা হয়েছে। আর দুর্নীতি দমন কমিশন হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে।
এদিকে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশ্মির রেজা বলেন, সবার আগে প্রয়োজন এখন হাওরের মানুষকে রক্ষা করা। তারা নিজেরা কোনোভাবেই এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না। আমি এখানে মানবিক বিপর্যয়, এমনকি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছি। জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, মাছ খেয়ে সহস্রাধিক হাঁস মারা যাওয়ার স্যাম্পুল সংগ্রহ করে আমরা ঢাকায় পাঠিয়েছি। এসব হাঁস ডার্ক প্লেগ রোগে মারা যায়নি। হাওরপাড়ের লোকজনকে এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অধিদপ্তর সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. ইসলাম ফারুক বলেছেন, বাতাসে ধান পচার দুর্গন্ধের জন্য সমস্যা হওয়ার কথা না! তবে পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। এই পানিতে যেনো কেউ গোসল, খাবার পানি ও রান্নার কাজে ব্যবহার না করেন। দুর্গন্ধযুক্ত এই পানি ব্যবহার করলে মানব দেহে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরীক্ষার পর বলা যাবে- পানিতে কি পরিমাণ বিষক্রিয়া। এই পানির মাছ না খাওয়ারও জন্যও পরামর্শ দেন তিনি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘সাধারণত আগাম বন্যা আসে এপ্রিলে। এবছর মার্চে চলে এসেছে, এ সময়টাতে ফসলে কীটনাশক ছিটানো হয়। আগাম বন্যা আসায় সেই কীটনাশক পানিতে মিশে গেছে। যে কারণে অ্যামুনিয়া গ্যাসের প্রভাবে পানিতে অক্সিজেন কমে বিষক্রিয়ায় মাছ মরছে। মাছ খেয়ে হাঁস ও পাখি মরছে। এখন অধিক বৃষ্টি হলে পানি বাড়বে, গ্যাসের প্রভাব কমবে। নতুবা পানিতে প্রচুর পরিমানে ব্লিচিং দিয়ে বাতাস মেলাতে হবে। অন্যথায় হাওরাঞ্চলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের মাঝেও এর প্রভাব পড়বে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজি অ্যান্ড ইমোনোলজি অনুষদের প্রধান ড. মাহবুব ই ইলাহী বলেন, অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রভাবে মাছ মারা যাচ্ছে। পানি ও বাতাস দূষণ হয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে হাওরাঞ্চলের মৎস্য-পশু সম্পদ তথা জীববৈচিত্র্য চরম হুমকীর মুখে পড়বে। প্রজনন মৌসুমে মাছ বিষাক্রান্ত হওয়ায় মাছের ঘাটতি দেখা দেবে। মাছ প্রজনন ক্ষমতা হারাবে। এছাড়া বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মাছ বেশি খেলে মানবদেহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মানুষ মারাও যেতে পারে। সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিস ও হাওরের প্রত্যক্ষদর্শী কৃষকরা জানান, গত শনিবার থেকে হঠাৎ হাওরে-নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ মরে ভেসে উঠছে। বিশেষ করে গভীর পানির সুস্বাদু মাছগুলো আধমরা হয়ে নিচ থেকে উঠে হাওরে-নদীতে ভাসতে থাকে। বোয়াল, কাতলা, রিটা, রুই, বাইনসহ সুস্বাদু দেশি মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ভাসতে দেখে উৎসুক জনতা তা ধরতে বের হন। তবে মৎস্য বিভাগ মাইকিং করে এই মাছ না খাওয়ার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে।
এদিকে হাওরের মাছ মরে যাওয়ার পর সোমবার ধর্মপাশার বিভিন্ন হাওরে পানি ও মাছ পরীক্ষা করেছে মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র। গবেষকরা মাছের মৃত্যুর কারণ হিসেবে পানিতে মাত্রাতিরিক্ত এমোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি ও অক্সিজেন অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। জেলা মৎস্য অফিসার শঙ্কর রঞ্জন দাস বলেন, পানিদূষণ রোধ করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মাছের মড়ক ঠেকাতে আমরা চুন ও জিওলাইট ব্যবহার করছি। এতে মাছও রক্ষা পাবে। পানিদূষণও রোধ হবে। সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আশুতোশ দাস বলেন, হাওরে ধান পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাতাসে দুর্গন্ধের কারণে শ্বাসকষ্ট, পেটের পীড়াসহ নানা রোগবালাই দেখা দিতে পারে, জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়তে পারে। পচা দূষিত পানি শরীরে লাগলে নানা চর্ম রোগ দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারা জেলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে মেডিকেল টিম গঠন করে রাখা হয়েছে। ধর্মপাশা উপজেলার নিজামপুর গ্রামের কবীর মাস্টার বলেন, সুনামগঞ্জের সবচেয়ে নিচু উপজেলা ধর্মপাশা। প্রতি বছরের মতো এবারো মার্চের শেষ সপ্তাহে অকাল বন্যায় ডুবে গেছে এখানকার ফসল ও বাড়ির আঙ্গিনা। এ অবস্থায় গবাদিপশু রাখার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছেন না উপজেলার কৃষকরা। পুরো উপজেলায় গবাদিপশু বিচরণের মতো কোনো তৃণভূমি অবশিষ্ট নেই। ফলে পশুকে খাওয়ানোর জন্য মিলছে না কোনো ঘাস। জামালগঞ্জ উপজেলা সদরের বাসিন্দা সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য ব্যবসায়ী হারুন মিয়া জানান, শুধু ধর্মপাশাই নয়, জেলার জামালগঞ্জ,তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, দোয়ারাবাজার, বিশ^ম্ভরপুর, জগন্নাথপুর ও ছাতক উপজেলারও অবস্থা একই। সর্বত্রই তৃণভূমিসহ গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে উপায় না দেখে কম দামেই গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছেন এসব অঞ্চলের গৃহস্থ ও কৃষকরা। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাহেদুল হক বলেন, পুরো জেলায়ই গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে আবার অভাবের তাড়নায়ও গবাদিপশু বিক্রি করছেন। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা জানিয়েছে, সুনামগঞ্জের ৮২ ভাগ বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ৩ লাখ কৃষক পরিবার ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত ৩১ মার্চ থেকে ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৬৬০ মে. টন চাল, ২৬ লাখ টাকা ও ১৫০ বান্ডিল ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে। আরো ১০ মে. টন চাল, আড়াই লাখ টাকা ও ৩০ বান্ডিল ঢেউটিন মওজুদ রয়েছে। প্রয়োজনে এসব ত্রাণ সহায়তার পরও প্রয়োজন হলে আরো বিতরণ করা হবে। জগন্নাথপুর উপজেলার সকল নদী ও হাওরের পানি দূষিত হয়ে মাছে মড়ক দেখা দেয়ার পর এবার হাঁসে মড়ক দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে খামারিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। জানাগেছে, জগন্নাথপুরে এবার বোরো ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে। গত প্রায় তিন সপ্তাহ আগে অকাল বন্যায় জগন্নাথপুর উপজেলার সকল হাওরের বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে যায়। গত বছর পাকা ধান তলিয়ে গেলেও এবার কাচা থোড় ধান তলিয়ে যায়। এসব ধান পানির নিচে পচে গিয়ে পানিকে দূষিত করে দেয়। গত কয়েক দিন আগে উপজেলার সকল নদী ও হাওরের পানি দূষিত হয়ে মাছে মড়ক দেখা দেয়। যদিও মাছের মড়ক রোধে জগন্নাথপুর উপজেলা প্রশাসন পানিতে ওষুধ প্রয়োগ করে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। তবে মাছের পর এবার হাঁসে মড়ক দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, নদী ও হাওরের দূষিত পানি খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাঁসে মড়ক দেখা দেয়।
মন্তব্য করুন