হাকালুকি পাড়ে ধীরে বন্যার উন্নতি বাড়ছে দুর্ভোগ : ত্রাণ নিয়ে গেলেই দুর্গতদের বেসামাল ভিড় এখনও সরকারী ত্রাণ পায়নি অনেকে
আবদুর রব॥ মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরপাড়ের বড়লেখার ৬ ইউনিয়নে ধীর গতিতে বন্যার উন্নতি হচ্ছে।
৭ জুলাই শুক্রবার বিকেল থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করে। তবে প্রতিদিনের বৃষ্টির কারণে দ্রুত বন্যারর উন্নতি হচ্ছে না। রাস্তা-ঘাট ও বসত ঘরের কিছু পানি কমলেও বন্যার্তদের দুর্ভোগ বাড়ছে। পানি নামার সাথে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, দেখা দিচ্ছে অসুখ-বিসুখ। অনেকের গায়ে জ্বর উঠেছে। যা জল বসন্তের লক্ষণ। তবে এখনও নৌকা দেখলে দুর্গত মানুষজন দৌঁড়ে বেসামাল ভীড় জমাচ্ছেন। রোববার দিনব্যাপি সরেজমিনে হাওর এলাকা ঘুরে জানা গেছে এখনও দুস্ত বন্যাদুর্গত ৬০-৭০ ভাগ মানুষ ত্রাণবঞ্চিত। প্রাপ্ত সরকারি ত্রাণ বিতরণে কতিপয় জনপ্রতিনিধির স্বজন প্রীতির কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তি বন্যার্তকে ত্রাণ বিতরণ করছেন।
সরেজমিনে তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা, পূর্বহাল্লা, খুটাউরা, আহমদপুর, নুনুয়া, দুর্গাপুর, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, পাবিজুরি, গগড়া, পশ্চিম গগড়া, কটালপুর এলাকায় এখনও ত্রাণ পায়নি শত শত দুর্গত মানুষ। এরা ভোট রাজনীতির শিকার হয়ে দুর্যোগে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি, রাঙ্গিনগর, দশঘরি, বাড্ডা, ব্রাহ্মণেরচক গ্রামেও ত্রাণ পায়নি অনেকে। এসব এলাকার বেশিরভাগ বাড়িঘর, রাস্তাঘাট এখনও পানিতে নিমজ্জিত। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। বাহন হিসেবে নৌকাই ভরসা এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের।
হাওরপারের দুর্গত মানুষের জন্য উপজেলা প্রশাসন তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয়, হাকালুকি প্রাইমারী স্কুল, সুজানগরের ছিদ্দেক আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও আজিমগঞ্জ প্রাইমারী স্কুলসহ ১৩টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ২৫৩ পরিবার মাথা গুজা ঠাঁই করে নেয়। পানি কমায় অর্ধশত পরিবার নিজ বাড়িতে ফিরে গেছে। তবে হাওরপারের লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দী দিনাতিপাত করছেন। বোরো ধান, আউশ, সবজি ক্ষেত হারিয়ে নি:স্বদের নীরব কান্না চলছে। দেখা দিয়েছে গোখাদ্য চরম সংকট। হাওরে প্রচ- ঢেউ থাকায় মাছও ধরতে পারছে না মৎস্যজীবি পরিবারের লোকজন। সীমাহীন দুর্ভোগের পাশাপাশি আর্থিক অনটনে মানবেতর জীবন-যাপন হাওরপাড়ের বানভাসি মানুষের নিত্যসঙ্গী। হাওরের ভেতরের বাড়িগুলোতে আফাল (ঢেউ) তাড়া করছে। অনেকের বাড়িঘর ঢেউয়ের প্রচ- আঘাতে ভেঙ্গে ও তলিয়ে যাওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোই এখন কঠিন। দফায় দফায় দেখা দেয়া বন্যায় হাওরতীরবর্তী বাসিন্দাদের দুর্ভোগ যেন পিছু ছাড়ছে না। গত প্রায় সাড়ে ৩ মাস থেকে তারা চরম ভোগান্তির শিকার। আর গত একমাস ধরে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়ে হাহাকার বেড়েছে হাওর তীরবর্তী মানুষের মধ্যে।
হাওর এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা শুধু মুখ চিনে ও যারা ভোট দিয়েছে তাদেরকেই ত্রাণ দিচ্ছেন। কেউই তাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। বানভাসীদের নিয়েও যে রাজনীতি চলছে তা সরেজমিনে গিয়েই জানা গেলো।
হাওর তীরবর্তী মানুষের দাবি, ফেঞ্চুগঞ্জের বুড়িকিয়ারি বাঁধ অপসারণ ও হাওর খনন না করলে এ দুর্ভোগের রেহাই নেই। এমনকি সিলেট বিভাগের অন্যান্য হাওরগুলোতে যেভাবে হাওর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেভাবে হাকালুকির উন্নয়নে কোনো ভূমিকা নেয়া হয়নি।
তালিমপুর ইউপির আহমদপুর গ্রামে হাওরের তীরে ১৫টি পরিবার বাস করছে। বাসিন্দা বৃদ্ধা রেবতি বিশ^াস, রাজন বিশ^াস, রায়মোহন বিশ^াস, চঞ্চলা বিশ^াস প্রমুখ অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন থেকে চরম দুর্ভোগ পোহালেও কেউ ত্রাণ দেয়নি। বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে ঢেউয়ের আঘাতে। কেউ কিছু না দিলেও ইউপি চেয়ারম্যান একদিন তাদের দেখে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, সাহায্য করবেন, কিন্তু এখনও কিছু দেননি।
পশ্চিম মুর্শিবাদকুরা গ্রামে হাওরের তীরে ৬টি পরিবার। সুবেদা বেগম, মিনারা বেগম, ছালিক আহমদ, ফারুক আহমদ, কালা মিয়া, মঈন উদ্দিন প্রমুখ অভিযোগ করেন, তারা আজ ও কোনো ত্রাণ সহায়তা পায়নি। তবে কিছুদিন আগে একটি সংস্থার পক্ষ থেকে চিড়া, মুড়িসহ কিছু খাদ্য সামগ্রি পেয়েছে। জীবিকা নির্বাহ করছে হাওরে মাছ ধরে। কিন্তু ঢেউয়ের কারণে মাছও ধরা যাচ্ছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
ত্রাণবঞ্চিত ছাবির হোসেনের স্ত্রী সুলতানা বেগম, নূর আলীর স্ত্রী নাদিয়া বেগম নৌকা দেখে দৌঁড়ে এগিয়ে এলেন। চোখ মুছে মুছে জানালেন, এতোদিনেও তারা কোনো ত্রাণ পায়নি।
খুটাউরা গ্রামের কালাই মিয়া, ছত্তার মিয়াসহ অনেকেই জানালেন, তারা সরকারিভাবে কোনো ত্রাণ পাননি। তবে কিছু যুবক তাদের একদিন ত্রাণসামগ্রি দিয়েছে। পরিবার নিয়ে বেশ কষ্টেই দিন কাটাচ্ছেন।
পূর্বহাল্লা গ্রামের মঈন উদ্দিন, ছরকুম আলী, জয়নাল মিয়া প্রমুখ জানান, কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। এখন পর্যন্ত কোনো কিছু দেয়া হয়নি তাদের।
দুর্গাপুরের বাসিন্দা নজিব আলীর ছেলে ফখর উদ্দিন পক্ষাঘাতগ্রস্থ। পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তিনি জানান, চেয়ারম্যান ও মেম্বারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ত্রাণ পাননি।
মুর্শিবাদকুরা গ্রামের সুবেদা বেগমকে দেখা গেলো এক ছেলে কোলে ও অন্য ছেলেকে নৌকায় বসিয়ে দ্রুত পাশর্^বর্তী অপেক্ষাকৃত উঁচু বাড়িতে উঠছেন। জানালেন, হাওরে আফাল (ঢেউ) উঠছে। ডরাইয়া (ভয়ে) হুরুতা (সন্তান) নিয়ে নিরাপদে আইলাম (আসলাম)।
এমনই অবস্থা এখন হাওরে। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ঘরের ভিটায়। ঘরের বেড়া ভেঙে পানির ¯্রােতে মিশে যাচ্ছে। বাড়িঘরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে ঝুঁকি সত্ত্বেও বাড়ি ছাড়ছেন না। অনেকের ভিটেবাড়ির মাটি পানির তোড়ে ভেসে গেছে। ঘরের বেড়া ভেঙে পড়েছে। অনেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র। অনেকে ঝুঁকি নিয়েই বাড়িতে আছেন। অনেকে কচুরিপানার বেড়া দিয়ে শেষ সম্বল রক্ষার চেষ্টা করছেন। বাড়ির নলকূপ ঢুবে যাওয়ায় এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। যাদের নৌকা আছে তারা পাশর্^বর্তী বাড়ি কিংবা গ্রাম থেকে পানি নিয়ে আসছে। কিন্তু যাদের নৌকা নেই তারা পড়েছে বেকায়দায়।
হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো হচ্ছে তালিমপুর ইউপি’র হাল্লা, ইসলামপুর, খুটাউরা, বাড্ডা, নুুনুয়া, পাবিজুরি, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, পশ্চিম গগড়া, পূর্ব গগড়া, বড়ময়দান, গাগড়াকান্দি, তেলিমেলি, গোপালপুর, হাউদপুর; সুজানগর ইউনিয়নের দশঘরি, রাঙ্গিনগর, ঝগড়ি, বাড্ডা, পাটনা, ভোলারকান্দি, উত্তর বাঘমারা, বাঘেরকোণা, চরকোনণা, পশ্চিম সালদিগা, বর্ণি ইউপির পাকশাইল, সৎপুর, কাজিরবন্দ, নোয়াগাঁও, উজিরপুর, মুন্সিনগর এবং দাসেরবাজার ইউপির চানপুর, অহিরকুঞ্জি, উত্তর বাগিরপার, দক্ষিণ বাগিরপার, পানিশাইল, ধর্মদেহী, চুলারকুড়ি, কোদালী, ধলিরপাড়, নেরাকান্দি, মাইজমজুড়ি, মালিশ্রী গ্রাম। পানি কমলেও সুজানগর ইউনিয়নে ১৫টির মতো কাঁচা ও পাকা গ্রামীণ রাস্তা এখনও নিমজ্জিত। তালিমপুর ইউনিয়নে ২০টির মতো ও বর্ণি ইউনিয়নে আরও ১০টির মতো গ্রামীণ রাস্তা নিমজ্জিত। একমাত্র নৌকাই পানিবন্দী মানুষের চলাচলের মাধ্যম।
সুজানগর ইউপির আজিমগঞ্জ প্রাইমারী স্কুলে আশ্রয় নেয়া ভোলাকান্দি গ্রামের আলমাছ আলী, বাড্ডা গ্রামের আজিরুন জানান, আফালে (ঢেউয়ে) ঘর-দুয়ার, নৌকা ভাঙ্গি নিছেগি (নিয়ে নিছে)। এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাননি।
এ বছর নানা সমস্যা আর সংকট সঙ্গী হয়েছে হাওরতীরের মানুষের। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বির্পযস্ত তারা। ৩য় দফা বন্যায় এখন নতুন উপদ্রব পানিবাহিত রোগ-বালাই। বন্যাকবলিত নিন্মাঞ্চলের লোকজন পানিবাহিত নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা। এর অন্যতম কারণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশন সংকট।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: আহম্মদ হোসেন জানান, একজন উপ-সহকারি মেডিক্যাল অফিসারের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের মেডিক্যাল টিম বন্য দুর্গত ইউনিয়নে পানিবাহিত রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিছু ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে তবে তা নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া পর্যাপ্ত ঔষধও মজুদ রয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজাদের রহমান জানান, ১ হাজার ৮৫০ জন ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ২৫২.৫৮ মেট্টিক টন চাল ও ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, জিআর কর্মসূচির আওতায় দুর্গতদের মধ্যে ১৫০ মেট্টিক টন চাল ও নগদ ৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ না পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সুন্দর জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদেরকে বলা হয়েছে সবাই যেন ত্রাণ পায়। তবুও কেউ কেউ ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করছেন।
মন্তব্য করুন