হাকালুকি হাওরের নাগুয়া ও চাতলাবিলে ২৭টি পরিযায়ী পাখি মৃত উদ্ধার
January 13, 2024,
সাইফুল ইসলাম॥ পরিযায়ী বা অতিথি পাখিদের আবাসস্থল এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে। এই হাওরের নাগুয়া ও চাতলা বিলে বিষটোপে ২৭টি পরিযায়ী পাখি হত্যা করা হয়েছে। সেখানে গোপনে এভাবে নিয়মিত পাখি শিকার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
১৯৯৯ সালে সরকার হাকালুকি হাওরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা ইসিএ) ঘোষণা করে।
শনিবার ৬ জানুয়ারি জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরের নাগুয়া ও চাতলাবিলে ২৭টি পরিযায়ী হাঁস পানি থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে এসব মৃত হাঁস আইইউসিএনের প্রোগ্রাম অ্যাসিস্ট্যান্ট সুলতান আহমদসহ স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সহযোগিতায় সেখানে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় সুলতান আহমদ তার ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রথমে কয়েকটা দেখে এভিয়ান ফ্লু মনে হলেও, কিন্তু মৃত পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। এবং খুঁজতে খুঁজতে বিষ প্রয়োগের সত্যতাও মেলে। সর্বমোট ২৭ টি মৃত পাখি পেলাম কয়েক ঘণ্টার মাঝে! এখানে আসার আগে খোঁজ নিয়ে দেখলাম। স্থানীয় জেলেরা জানান, এখানে সাধারণত বিষ প্রয়োগ করে না! তবে আরও তথ্য নিয়ে জানা গেলো, এক শ্রেণির অসাধু লোক এইভাবে গোপনে বিষ দিয়ে হাঁস মেরে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে!
‘যদিও জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখি শিকারে সরকারের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জলাভূমিগুলোকে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, তবুও সেসব এলাকায় পাখি হত্যা চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। শিকারিরা এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর এড়াতে হত্যার নিষ্ঠুর এই পথ বেছে নিয়েছেন। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাখি শিকারি চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।’
হাওর পারের জুড়ী উপজেলার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাওর শুকিয়ে যাওয়ায় শীত প্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথি পাখিরা বিলে বিলে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে ও ‘বিষটোপ’ তৈরি করে বিভিন্ন বিলের পাড়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে। পাখিরা খাবার ভেবে প্রতিনিয়ত এসব টোপ খেয়ে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া পেশাদার পাখি শিকারিরা শিকার করা এসব পাখি লুকিয়ে আশপাশের বিভিন্ন হাটবাজার ও বাড়ি বাড়ি ফেরি করে চড়া দামে বিক্রি করে।
আইইউসিএনের বাংলাদেশ প্রোগ্রাম অ্যাসিস্ট্যান্ট সুলতান আহমেদ ফোনে বলেন, ‘মোট মৃত ২৭টি হাঁস পাওয়া গেছে। তার মধ্যে তিন প্রজাতির হাঁস রয়েছে– উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, পিয়াং হাঁস। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ওই এলাকায় বহুদিন ধরে বিষ প্রয়োগে পরিযায়ী হাঁস শিকার হয়ে থাকে। বিষগুলো ভোররাতে প্রয়োগ করে। হাঁসগুলো বিষ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে শিকারিরা ধরে জবাই করে। পরে সিলেট-মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে থাকে।’
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিকারি বলেন, ‘হাকালুকি হাওর এলাকার পরিযায়ী পাখি চড়া দামে বিক্রি করি। অনেকে তাদের কর্তাব্যক্তিদের উপহার হিসেবে দিতে বেশি দাম দিয়ে পাখি কেনেন। অনেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখেন।’
মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদী সরোয়ার বলেন, ‘হাকালুকি হাওরের হাল্লা এলাকায় আমাদের একটা ক্যাম্প আছে। সেখানে আমাদের দুজন স্টাফ আছে। তারা ওই এলাকা দেখাশোনা করেন। এ ঘটনায় ডিএফও স্যার ইতোমধ্যে রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম সারওয়ারকে (ওয়াইল্ড লাইফ) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।’
রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘ঢাকা থেকে বন্যপ্রাণী গবেষকরা এসেছিলেন হাকালুকি হাওরে পাখি দেখতে। সেখানে নাগুয়া ও চাতলা বিলে ২৭টি হাঁস মরে পড়ে থাকতে দেখেন তারা। পরে তারা উদ্ধার করে মাটিচাপা দিয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
ফেসবুকে অনেকেই এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন ফেসবুকে কমেন্টে বলেন, ‘ঘটনাটা খুবই হৃদয়বিদারক! বিষ দিয়ে মারা পাখির মাংস খেয়ে শুধু নিজের লিভার এবং কিডনি ধ্বংসের ভয়ে নয়; জীব বৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়োজনে পাখি খাওয়া বন্ধ করুন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রয়কারীর কাছ থেকে পাখি কেনা বন্ধ রাখুন। নিজের পাশবিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করুন। আপনি পাখি কেনা বা খাওয়া বন্ধ করলেই ওরা পাখি মারা বন্ধ করবে।’
মন্তব্য করুন