হাকালুকি হাওরে বোরো ধানে ব্লাস্ট : দিশেহারা কৃষক ধানে ব্লাস্ট রোগ : ক্ষতিতে হাকালুকি হাওরের কৃষক
স্টাফ রিপোর্টার॥ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ ছত্রাক জনিত রোগে নষ্ট হয়ে গেছে ব্রি-২৯ জাতের ধান। ধান কাটার পরে দেখা যাচ্ছে কোনো ধানেই চাল নেই। আছে শুধু খোসা।
এতে হাওর পাড়ের কৃষকদের চোখে মুখে শুধুই হতাশার ছাপ। ব্লাস্ট রোগের পাশাপাশি দু-দফায় শিলা বৃষ্টি হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে হাওর এলাকায় বোরো ফসলের লক্ষ্য মাত্রায় ধ্বস দেখা দিয়েছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটা উৎসব শুরু হলেও মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওর অংশে অনেকটাই সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। ব্লাস্ট রোগে কৃষকের ধান সম্পূর্ণ চিটায় পরিণত হওয়ায় ধান কাটতে কৃষকদের মধ্যে কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। মাঠের ধান নষ্ট হওয়ায় এসব ধান এখন গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হাকালুকি হাওরের জুড়ী অংশে বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে ব্লাস্ট রোগ। বিশেষ করে উপজেলার চাতলা ও মরা চাতলা বিলের অংশ, নয়াগ্রাম, ইউছুফ নগর, বেলাগাঁও, জাঙ্গিরাই, শাহপুর, গরগরন বিল, কইয়ার কোনা, খাকটেকা এলাকার কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা জনিয়েছেন, ক্ষেতের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত ব্লাস্ট রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগে প্রথমে ধানগাছের শীষ ভেঙে যায়, ধান শুকিয়ে চিটা হয়ে যায়। ধানের এ বিপর্যয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
জুড়ী উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর উপজেলায় হাকালুকি হাওর এলাকায় হাওর ৫ হাজার ৮০ হেক্টর ও নন হাওরসহ মোট ৫ হাজার ৯ শত ২৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছিল। এর মধ্যে হাইব্রিড জাত-ঝখ ৮ ঐ, টিয়া, রুপালী, উফশী, ব্রি ধান-২৯, ব্রি ধান ২৮, ব্রি ধান ৮৯, বিআর ১৪, ব্রি ৯২ জাতের ধানসহ অন্যান্য জাতের ধান রোপণ করা হয়েছিল।
এর মধ্যে ব্রি-২৯ ধান ছত্রাক জনিত ব্লাস্ট রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, উপজেলার হাকালুকি হাওরে দু-দফা শিলায় ৬ হেক্টর ও ব্লাস্ট রোগে ৩.৫ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, হাকালুকি হাওরে মাঠের পর মাঠ পাকা ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। এসব পাকা ধানের মধ্যে বেশির ভাগ ধান কাটার কোনো আগ্রহ নেই কৃষকের।
কারণ সব ধানই ব্লাস্টের আক্রমণে চিটা হয়ে গেছে। কেউ কেউ গবাদিপশুর খাবারের জন্য কিছু ধান কাটছেন আবার কেউ কেউ ধান নষ্ট হওয়ায় ধান কাটার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। উপজেলার ইউছুফ নগর গ্রামের কৃষক কালা মিয়া ও শুক্কুর মিয়া জানান, আমরা ঋণ করে এ বছর জমিতে ব্রি-২৮ ধানের চাষ করেছিলেন। প্রথমে ফলন ভালো দেখে মনটা ভরে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ায় পুরো জমির ধান এখন চিটা। কিছু ধান গরুর খাদ্যের জন্য কাটা হয়েছে। বাকিটা জমিতেই রয়েছে। আমাদের এখন পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সরকারের কাছে আমরা সহায়তা চাই।
বেলাগাঁও গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘প্রায় ১৫/২০ বিঘা জমিতে ব্রি-২৯ ধান লাগাইছিলাম। ফলন ভালো হলেও যখন ধান আসার কথা তখনই ব্লাস্ট রোগে ধান জ্বলে একবারেই শেষ। ধান এখন চিটা হয়ে গেছে। এখন ঋণ কিভাবে দেব সে চিন্তায় দিন কাটছে। এ পর্যন্ত কৃষি বিভাগের কোনো লোক এসে খোঁজখবর নেয়নি বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
হাকালুকি হাওরের কৃষক আফজাল মিয়া বলেন, ‘সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ২০ বিঘা জমিনে ব্রি-২৯ জাতের ধান লাগিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ধান বিক্রি করে সমিতির টাকা পরিশোধ করব। সব ধান চিটা হয়ে নষ্ট হওয়ায় ঋণের টাকা কীভাবে শোধ করব তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
তবে উপজেলা উপ কৃষি কর্মকর্তা চমক আচার্য বলেন, ‘যেভাবে কৃষকরা দাবি করছেন তা সঠিক নয়। ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কৃষকদের উঠান বৈঠকের মাধ্যমে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান খান বলেন, এ বছর উপজেলায় হাকালুকি হাওর এলাকায় হাওর ৫ হাজার ৮০ হেক্টর ও নন হাওরসহ মোট ৫ হাজার ৯ শত ২৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। হাওর এলাকায় দু-দফায় শিলা বৃষ্টি ও ব্লাস্ট রোগের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ার পর কৃষকদেরকে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, জেলার হাকালুকি হাওরে ব্লাস্ট রোগে কিছু ধানের জমি নষ্ট হয়েছে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের পাশে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা শুরু হয়েছে। সরকারের কোনো বরাদ্দ বা প্রণোদনা এলে তাদের সহায়তা করা হবে।’
ইউটিউবে দেখুন পাতাকুঁড়ির ভিডিও গ্যালারি
মন্তব্য করুন