হাকালুকি হাওর, নদীতে ফের দ্রুত বাড়ছে পানি, জনমনে আতঙ্ক

July 3, 2024,

স্টাফ রিপোর্টার॥ ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে হাকালুকি হাওর, মনু ও জুড়ী নদীর পানি ফের দ্রুত বাড়ছে। এতে নতুন করে আতঙ্কিত হচ্ছেন বন্যা দুর্গত এলাকার হাজার হাজার মানুষ। গত ১৬ দিন ধরে বন্যার পানিতে সরকারি হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ও উপজেলা প্রশাসনিক অফিসসহ আশেপাশের আবাসিক এলাকা নিমজ্জিত থাকায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও সরকারি দাপ্তরিক কার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটছে।

পানিবন্দি থেকে চিকিৎসা সেবা ও উপজেলা প্রশাসনিক কাজ-কর্ম করছেন বিভিন্ন দাপ্তরিক কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা। এতে সরকারি অফিস ও হাসপাতালের সেবা গ্রহীতাদের চরম ভোগান্তি হচ্ছে। এর আগে গত শুক্রবার ও শনিবার বৃষ্টিপাত হলেও মৌলভীবাজারে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু রোববার, সোমবার ও মঙ্গলবার থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যার কারণে হাকালুকি হাওরসহ মৌলভীবাজারে বিভিন্ন নদ নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে।

১৭ জুন থেকে এখনও হাকালুকি হাওরের বন্যার পানিতে কুলাউড়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৪টি ওয়ার্ডের ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সড়ক পানির নিচে ডুবে আছে। ২৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ২ হাজার ৬৩ জন মানুষ ও উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এখানকার মানুষের বাসাবাড়িসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ডুবে আছে। এতে করে এখনও স্বাভাবিক হয়নি এ উপজেলার মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থা। বন্যার শুরু থেকে জনপ্রতিনিধি, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই বন্যার্তদের পাশে রয়েছেন।

বন্যার পানি কিছুটা নামতে শুরু করায় হাওর, নদী তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রামের ঘরবাড়ি ছাড়া মানুষ নিজ ভিটে ফিরতে শুরু করলেও গত দুই দিন ধরে ফের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরছেন বানভাসি লোকজন।

এলাকাবাসী জানায়, হাকালুকি হাওর তীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। জেলার নদী তীরবর্তী বন্যাকবলিত অন্যান্য এলাকায় কিছুটা উন্নতি হলেও অনেকটাই অপরিবর্তিত রয়েছে হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকা। চলমান পরিস্থিতিতে রান্না করা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, পানিবাহিত রোগবালাই ও গবাদিপশুর খাবার ও বাসস্থান সংকটে চরম দুর্ভোগে বানভাসিরা।

এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সসদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার-২ মোহাম্মদ আবু জাফর রাজু, জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মাওলানা ফজলুল হক খান সাহেদ প্রমুখ।

ভূকশিমইল গ্রামের আলী আহমদ জানান, আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষ খাদ্য সংকটের সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির সমস্যায় ভুগছে। এতে পানিবাহিত রোগজীবাণুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে হাওর এলাকায়।

কুলাউড়া পৌর এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা সজিব আহমদ জানান, বন্যার পানি কিছুটা কমায় আমার ঘর থেকে পানি অনেকটা নেমে গিয়েছিল। গত দুই দিনের বৃষ্টিতে পানি আগের মতো বেড়েছে। তাই আবার আমি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছি।

ভূকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, হাকালুকি হাওর এখন তার উত্তাল রূপ দেখাচ্ছে। ভয়াবহ ঢেউ তীরবর্তী এই এলাকাগুলোর রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি করছে। মানুষের কাঁচা বাড়িঘরও ভাঙছে। হাওর পাড়ের মানুষ এখন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। ইউনিয়নের অনেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত তিন হাজার পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। গভীর নলকূপগুলো ডুবে যাওয়ায় ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানি তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বানভাসিদের এমন বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াতে তিনি সরকারের পাশাপাশি সমাজের বৃত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

কুলাউড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শিমুল আলী বলেন, বন্যায় যাদের বাড়িঘরে পানি উঠেছে তাদেরকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে রয়েছে প্রশাসন। উপজেলা পরিদ প্রাঙ্গণ প্লাবিত থাকায় আমরা নিজেরা পানিবন্দি থেকে সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। কুলাউড়ায় ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা মিলে প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা ১১৬টি। ২৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ হাজার ৬৩ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সরকারিভাবে নগদ ২ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে ৬২০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে।

কুলাউড়া পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদ জানান, পৌরসভার ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও খাবার সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

এদিকে গত ২৮ জুন কুলাউড়ায় জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনের সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, কুলাউড়ায় বন্যায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। বন্যার শুরু থেকে জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বন্যার্তদের পাশে রয়েছেন। একসাথে হয়ে বন্যার্তদের জন্য সবাই কাজ করছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকার ২৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে বর্তমানে ২ হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিদিনই আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যাকবলিত এলাকায় শুকনো খাবারের পাশাপাশি রান্না করা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৮ শত ২০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। মৎস্য সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ২৩০০ কৃষকের মাঝে বীজ ও সার বিতরণ করা হয়েছে। বন্যার পরে ক্ষতিগ্রস্থ ঘরবাড়ির জন্য ঢেউটিন বিতরণ করা হবে বলেও তিনি জানান।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com