হাজীপুরে মৎস্য খামারের বিরোধ নিয়ে প্রতি পক্ষ ফজর বাহিনীর হামলায় নিহত ১ : আহত ৬ জন

April 10, 2017,

স্টাফ রিপোর্টার॥ শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইলহাওর এলাকার হাজীপুরে মৎস্য খামার নিয়ে (ফিসারী) বিরোধের জের ধরে প্রতি পক্ষের হামলায় ১ জন নিহত। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ৬ জন।
এলাকাবাসী সূত্রে জানাযায়, হাজীপুর এলাকার প্রভাবশালী ফজর আলী মেম্বার দীর্ঘদিন যাবৎ হাইল হাওর এলাকায় নিজের একক আদিপত্য বিস্তার করতে নিজ পুত্র, ভাই, ভাতিজা সহ এলাকার বেশ কিছু লোকজন নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন। যার নেতৃত্ব ফজর আলী নিজেই দেন। ফিসারী ব্যবসা, কৃষিকাজ সহ যে কোন প্রয়োজনে হাইল হাওরে যে কেই প্রবেশ করতে হলে তাকে দক্ষিণা দিয়ে হাওরে যেতে হয়।
মামলার বিবরণে জানাযায়, গত ২৯ মার্চ বুধবার দূপুর আড়াইটার দিকে নিহত সানজব আলী, পিতা-হাজী মছদ্দর আলী, হাজীপুর বাজার থেকে বাড়ী ফেরার পথে ফজর আলীর নেতৃত্বে ২০ থেকে ২৫ জন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলার প্রস্তুতি নিলে, সানজব আলী দেখে প্রাণের ভয়ে দৌড়ে গিয়ে পার্শবর্তী আব্দুল জলিলের বাড়ীতে উঠেন। এ সময় ফজর আলী দা দিয়ে সানজব আলীর মাথায় আঘাত করেন ও অন্যান্যরা এলোপাথারি আঘাত করে মারাত্মক ভাবে আহত করলে মাটিতে লুটিয়ে পরেন সানজব আলী। মুর্মুষ অবস্থায় তাকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ মার্চ ভোর ৫ ঘটিকায় কর্তব্যরত চিকিৎসক সানজব আলীকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যান্য আহতরা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীর রয়েছেন।
এ ঘটনায় নিহতের ভাই মিন্নত আলী শ্রীমঙ্গল থানায় ১৫ জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাত আরো ৭-৮ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। আসামীরা হলেন-১ ফজর আলী ২। মোঃ খোকন মিয়া ৩। আছান মিয়া ৪। জলিল মিয়া ৫। নজমুল মিয়া ৬। রুয়েল মিয়া ৭। তোফায়েল মিয়া ৮। বিলাল মিয়া ৯। ফয়ছল মিয়া ১০। সিফিল মিয়া ১১। রশিদ মিয়া ১২। আরবেশ আলী ১৩। ডোকল মিয়া ১৪। নজব আলী ১৫। আব্দুল্লা সর্ব সাং হাজিপুর, থানা-শ্রীমঙ্গল, জেলা-মৌলভীবাজার।

উল্লেখ্য হাইল হাওরের আদিপত্য বিস্তার নিয়ে ফজর বাহিনী বিভিন্ন সময়ে চাঁদাবাজি, ঘুম, হত্যা, অপহরণ, খাস ভুমি দখল ও ফিসারীর মাছ লুট, সরকারী অভয়আশ্রম বাইক্কা বিলের মাছ লুট সহ অসংখ্য ঘটনার অভিযোগ থাকলেও অধিকাংশ ঘটনায় কেউ থানা-পুলিশকে জানাতে সাহস পায়নি।
২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গল থানায় দায়েরকৃত মামলা সূত্রে জানা যায়, মোঃ জমিস উদ্দিন হাইল হাওরের ফিসারী নির্মাণ করে মাছ চাষ করে আসছিলেন। ফিসারী নির্মাণকালীন সময়ে হাজীপুর এলাকার ফজর বাহিনীর প্রধান ইউপি সদস্য ফজর আলীর নেতৃত্বে পরিবহনকারী ট্রাক থেকে ২০/৩০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন। এভাবে কিছু দিন যেতে না যেতেই ফজর বাহিনী ফিসারীর মালিকের কাছে ৫ লাখ চাঁদা দাবী করে। দাবীকৃত চাঁদা প্রদান না করায় ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ফজর বাহিনীর শতাধিক লোকজন নিয়ে চাষকৃত ফিসারীতে হামলা চালিয়ে ফিসার ঘরবাড়ী ভাংচুর ও ফিসার পার কেটে ৭ লক্ষ ৮০ হাজার ফিসারীর মাছ লুটপাট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মোঃ জমিস উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করলে তৎকালিন শ্রীমঙ্গল থানার উপ-পরিদর্শক রমা প্রসাদ চক্রবর্তী মামলাটি সরজমিনে তদন্ত করে সাক্ষী প্রমাণমতে ঘটনার পারিপার্শি¦কতায় ২৪জন আসামীর বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪৪৭/৪৮৫/৩২৩/৩৭৯/৫০৬/৩৪ দন্ডবিধি ধারা মতে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বর্তমানে মামলটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইল হাওরের হাজীপুর গ্রামের মনির মিয়ার মৎস্য খামার ফজর বাহিনী দখল করতে গিয়ে ফিসারীর পাড়ের কয়েকটি ঘড়ে অগ্নি সংযোগ করে ও এলোপাথারি মারধর করে নারী পুরুষ সহ অন্তত ৪০ জনকে আহত করে। আহতদের মৌলভীবাজার ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া হয়। এ ঘটনায় মনির মিয়া শ্রীমঙ্গল থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ হাইল হাওরের এ ঘটনাটি তদন্তে এলাকায় গেলে ফজর বাহিনী পুলিমকে তাড়িয়ে দেয়। মামলা না দিতে পেরে মনির মিয়া এলাকার গন্যমান্য ব্যাক্তি ও তৎকালিন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে বিচার প্রার্থী হলে এলাকায় বিরোধ মিমাংসার জন্য এক বৈঠক বসে। বৈঠকে তৎকালিন সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আশরাফুল ইসলাম, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জলিল উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী সভা শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে অনুষ্ঠিত হবে। প্রশাসনের কর্মকর্তা বৈঠকের অদুরে আসলে ফজর বাহিনীর লোকজন দেশী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে নারীসহ প্রায় ৩০জন আহত হন। এ সময় মনির মিয়া, ছানু মিয়া, বাদশা মিয়া ও আনসার মিয়ার বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ফজর বাহিনী।
২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল বাইক্কা বিল সরকারি অভয়াশ্রমের মাছ ফজর বাহিনীর প্রধান ফজর আলীর নেতৃত্বে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের মাছ লুট হয়। এলাকার প্রায় ৫-৭শ লোককে নিয়ে বিলের বড় বড় রুই, কাতল, মৃগেল, বোয়াল, গনিয়া, গ্রাসকার্প, চিতল প্রজাতির মাছ ধরে বিক্রি করে। তার মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি ওজনের মাছও রয়েছে। ঐ সময়ের শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী বাইক্কা বিল ও তার আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ পহারা শুরু করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিলে মাছ ধরা অব্যাহত রাখে ফজর বাহিনীর লোকজন। মাছ লুটে জড়িত থাকায় সুনির্দিষ্টি নাম না পাওয়া এখোনও কোন মামলা হয়নি।
২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ফজর আলী পুত্র খোকন মিয়া সহ আরো কয়েকজন শ্রীমঙ্গল শহরের কণিকা এন্টার প্রাইজে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে। এ সময় শ্রীমঙ্গল উপজেলার মতিগঞ্জ এলাকার প্রমোদ সরকারের পুত্র রিপন সরকারকে মারাত্মক ভাবে আহত করে। এ ঘটনায় শ্রীমঙ্গল থানায় মামলা করেন রিপন সরকার। পরে ফজর আলী বৈঠকে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মামলার সমোঝতা হয়। সমোঝতা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা চেয়ারম্যান রনধীর দে, শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভানুলাল রায়, শ্রীমঙ্গল পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়না মিয়া সহ গন্যমান্য ব্যাক্তি বর্গ।
২০১৩ সালের ২০ মার্চ ফজর বাহিনীর প্রদান ফজর আলী পুত্র খোকন মিয়া শ্রীমঙ্গল শহরের বেঙ্গল মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনের রাস্তায় বরুনা এলাকার লন্ডন প্রবাসি মোঃ নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী জোসনা বেগমকে মারধর করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় প্রবাসি মোঃ নুরুল ইসলামের বাগ্নে জমসেদ আহমেদ শ্রীমঙ্গল থানায় মামলা দায়ের করেন। খোকন মহামান্য হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে নি¤œ আদালতে হাজির না হয়ে পলাতক রয়েছে।
হাইল হাওরের এলাকায় যাতায়াতকারী বিভিন্ন ট্রাক গাড়ী হতে চাঁদা আদায়ের ঘটনা, ফিসারীর মাছ লুট, বাইক্কা বিলের মাছ লুট, খাস ভুমি দখল সহ নানান অপরাধের সংবাদ স্থানীয় ও দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনী ব্যবস্থা হয়নি। যে কারণে একের পর এক ঘটনা ফজর বাহিনী ঘটিয়ে যাচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com