হারানো বাংলা চাই
সায়েক আহমদ॥ ঐতিহাসিক ২৩ জুন। দিনটি ঐতিহাসিক হওয়ার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো ‘স্বাধীন বাংলা’ অপরটি হলো ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’। ‘স্বাধীন বাংলা’র সর্বশেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাতে পরাজয় বরণ করায় বাঙালি জাতিকে ১৯০ বছর পরাধীনতার মালা গলায় পরে নিতে হয়েছিল। অন্যদিকে দুশ বছর পর ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ এর জন্ম হয়। একদিকে স্বাধীন বাংলার সর্বশেষ নবাবের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এর জন্মের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার হারানো সূর্য নতুন করে উদিত হওয়ার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুনের সম্মেলনে দলের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরদিন ২৪ জুন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্য জনসভার মধ্য দিয়ে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এর পথচলা শুরু হয়। ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির নতুর নাম হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব ধরনের আন্দোলনে কাজ করে গেছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে যুদ্ধে হেরে যান। সেখানে মীরজাফর আলী খান বেঈমানি করেছিল। তার ফলে কিন্তু এই পতন ঘটেছিল। অর্থাৎ তখন সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাসহ এই অঞ্চলের শাসক। সেই স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধে ‘আম্রকাননে’। আর এই ২৩ জুনই প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর সেই আওয়ামী লীগই আবার সেই সূর্য উদয় করে। আওয়ামী লীগের সংগঠন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে।’
তবে বর্তমান ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেই ‘স্বাধীন বাংলা’ নয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজত্ব ছিল পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে বৃহৎ বাংলা, সাথে ছিল বিহার ও উড়িষ্যা। আজকের বাংলাদেশ সেই স্বাধীন বাংলার তিন ভাগেরও কম অংশ নিয়ে গঠিত ক্ষুদ্র বাংলাদেশ।
কেন আমরা হারালাম আমাদের সেই স্বাধীন বাংলার বিশাল অংশ। প্রথমে আমরা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ হতে জেনে নিই বঙ্গবন্ধু এ সম্বন্ধে কী লিখেছেন?
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটির ৭৮ পৃষ্টায় বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধিটা ছিল এরকম, ‘পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরাপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল ।
নাজিমুদ্দীন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা করলেন, ঢাকা রাজধানী হবে এবং তিনি দলবলসহ ঢাকায় চলে গেলেন। একবার চিন্তাও করলেন না, পশ্চিম বাংলার হতভাগা মুসলমানদের কথা। এমনকি আমরা যে সমস্ত জিনিসপত্র কলকাতা থেকে ভাগ করে আনব তার দিকেও ভ্রুক্ষেপ করলেন না। ফলে যা আমাদের প্রাপ্য তাও পেলাম না। সরকারি কর্মচারীরা ঝগড়া গোলমাল করে কিছু কিছু মালপত্র স্টিমার ও ট্রেনে তুলতে পেরেছিলেন, তাই সম্বল হল। কলকাতা বসে যদি ভাগ বাটোয়ারা করা হত তাহলে কোনো জিনিসের অভাব হত না। নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ বা অন্য কারোর সাথে পরামর্শ না করেই ঘোষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার উপর আর কোনো দাবি রইল না। এদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, কলকাতা নিয়ে কি করবেন? ‘মিশন উইথ মাউন্ডব্যাটেন’ বইটা পড়লে সেটা দেখা যাবে। ইংরেজ তখনও ঠিক করে নাই কলকাতা পাকিস্তানে আসবে, না হিন্দুস্তানে থাকবে। আর যদি কোনো উপায় না থাকে তবে একে ‘ফ্রি শহর’ করা যায় কি না? কারণ, কলকাতার হিন্দু-মুসলমান লড়বার জন্য প্রস্তুত। যে কোন সময় দাঙ্গাহাঙ্গামা ভীষণ রূপ নিতে পারে । কলকাতা হিন্দুস্তানে পড়লেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল । হিন্দুরা কলকাতা পাবার জন্য আরও অনেক কিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হত।
এই বইতে আরও আছে, একজন ইংরেজ গভর্ণর হয়ে ঢাকা আসতে রাজি হচ্ছিল না, কারণ ঢাকায় খুব গরম আবহাওয়া। তার উত্তরে মাউন্টব্যাটেন যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে দুনিয়ার অন্যতম পাহাড়ি শহর, থাকার কোন কষ্ট হবে না। অর্থাৎ দার্জিলিংও আমরা পাব। তাও নাজিমুদ্দীন সাহেবের এই ঘোষণায় শেষ হয়ে গেল। যখন গোলমালের কোনো সম্ভাবনা থাকল না, মাউন্টব্যাটেন সুযোগ পেয়ে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগা জংশন অঞ্চল কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমান বেশি, তবু কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ওদের দিয়ে দিলেন। মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশি, কিন্তু সমস্ত জেলাই দিয়ে দিলেন। মালদহ জেলায় মুসলমান ও হিন্দু সমান, তার আধা অংশ কেটে দিলেন। দিনাজপুরে মুসলমান বেশি, বালুরঘাট মহকুমা কেটে দিলেন যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্তানে যায় এবং আসামের সাথে হিন্দুস্থানের সরাসরি যোগাযোগ হয়। উপরোক্ত জায়গাগুলি কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারত না। সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতবর্ষকে দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, আসামের কাছাড় জেলা ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের ভাগে না দিয়ে পারবে না। আমার বেশি দুঃখ হয়েছিল করিমগঞ্জ নিয়ে। কারণ, করিমগঞ্জে আমি কাজ করেছিলাম গণভোটের সময়। নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়। যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়। অথবা পূর্বেই গোপনে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী নেতা হলে তাদের অসুবিধা হত তাই তারা পিছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইল। কলকাতা পাকিস্তানে থাকলে পাকিস্তানের রাজধানী কলকাতায় করতে বাধ্য হত, কারণ পূর্ব বাংলার লোকেরা দাবি করত পাকিস্তানের জনসংখ্যায়ও তারা বেশি আর শহর হিসাবে তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শহর কলকাতা। ইংরেজের শাসনের প্রথমদিকে কলকাতা একবার সারা ভারতবর্ষের রাজধানীও ছিল।’
এই উপলব্ধিটুকু ঘটেছিল স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তা চেতনায়। ‘কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়।’- বঙ্গবন্ধুর এ কথায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে, জিন্নাহ কোনদিনই চাননি বাংলা তার পূর্ণশক্তি নিয়ে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হোক। কারণ যুক্তবাংলা যে কোন সময়ই পাকিস্তানকে কোনঠাসা করে ফেলবে এ ভয় জিন্নাহর সবসময়ই ছিল। কারণ ১৯৪০ সালে শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাবে যে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব এনেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যানারে, সেটা জিন্নাহ কোনদিনই মেনে নিতে চাননি। অবশ্য তখন সেটা পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে উল্লেখ ছিল না। সেটা ছিল ‘সি জোন’। চল্লিশের দশকের মুসলিম কবি আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী যে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে গিয়েছিলেন সেখানে উল্লেখ আছে, ‘কেবিনেট মিশন ভারতবর্ষকে এ, বি ও সি জোনে বিভক্ত করে একটি ফেডারেশন করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। ‘এ জোনে’ রাখা হয়েছিল সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। ‘বি জোনে’ ছিল মধ্য ভারত। আর ‘সি জোনে’ ছিল ‘অবিভক্ত বাংলা ও আসাম’। মুসলিম লীগ এ পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস তা না মানার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ এ ও সি জোনে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। লর্ড ওয়াভেল ছিলেন তখনকার ভাইসরয়।’
বঙ্গবন্ধুও তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে একই কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বঙ্গবন্ধুর মত বাংলার প্রধান প্রধান নেতারা সেসময় জিন্নাহর অভিসন্ধিটুকু উপলব্ধি করতে পারেননি। জিন্নাহ দেখেছিলেন ‘সি জোনে’ বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘বৃহৎ বাংলাদেশ’ স্বাধীন হয়ে যাবে। এতে পাকিস্তানের কোন লাভ হবে না। তবে খণ্ডিত বাংলা অর্থাৎ শুধুমাত্র পূর্ববাংলা পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত থাকলে সহজেই বাঙালিদেরকে কব্জায় রাখতে পারবেন। সেজন্যই জিন্নাহ শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে আলাদা রাষ্ট্রের জায়গায় এক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছিলেন। অর্থাৎ তখনই জিন্নাহ পশ্চিমবঙ্গকে পূর্ববাংলা হতে পৃথক করার ষড়যন্ত্র করে সফল হয়েছিলেন। এর ফলে অবিভক্ত বাংলা অর্ধেক দুর্বল হয়ে গেল। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের নেতারা পশ্চিমবঙ্গ হতে কলকাতাসহ অন্যান্য শহর ও জেলাগুলোকে পূর্ববঙ্গে অন্তর্ভূক্তির পরিবর্তে এ শহরগুলোকে কৌশলে ভারতবর্ষের কাছে হস্তান্তর করে ১৯৪৭ সালেই বাংলাকে আরো দুর্বল করে দিয়েছিলেন। তারপরও বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগণ জিন্নাহর সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। জিন্নাহ যে ভয় করেছিলেন ১৯৪০ সালে, বাঙালিরা সেটা বাস্তবায়ন করেছিল ১৯৭১ সালে। তবে তৎকালীন ভারতবর্ষের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ভবিষ্যদ্বাণীতে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করে যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির সময় বাংলার নেতারা হয়ত পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্বার্থে নীরব ভূমিকা পালন করবেন, কিন্তু পরবর্তীতে অবশ্যই পাকিস্তানের আওতার বাইরে চলে আসবেন। হয় পাকিস্তানের নেতৃত্বে আসবেন, নতুবা পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করে ফেলবেন। মাওলানা আজাদের ভবিষ্যদ্বাণী কাঁটায় কাঁটায় মিলে গিয়েছিল।
১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে যে লড়াই শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে তার চূড়ান্ত পরিণতিতে বাংলার মুক্তিকামী বীর জনতার তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। বাঙালি ছাত্র-যুবক-জনতার যে রক্তক্ষয় হয়েছিল, তা মোটেই ব্যর্থ হয়নি। বরং শহীদের রক্ত বাঙালিকে করেছিল অধিকার সচেতন, প্রতিবাদমুখর, ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতাপ্রত্যাশী। তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে। শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আতাহার আলী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল। একে ফজলুল হক হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রাদেশিক এই নির্বাচনের রায় পাকিস্তানি শাসকদের কাছে অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে মুসলিম লীগবিরোধী মনোভাব কতটা তীব্র হয়েছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই ফলাফলে। প্রাদেশিক আইন পরিষদের মোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ৯টি আসন। কারো কাছেই এ কথা আর অস্পষ্ট থাকেনি যে, পূর্ব পাকিস্তানে যথার্থই মুসলিম লীগের বিদায় ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল।
পাকিস্তান স্বাধীন হবার মাত্র ৭ বছরের মাথায় মুসলিম লীগের এ ভরাডুবি প্রমাণ করেছিল মাওলানা আজাদের ভবিষ্যদ্বাণীর গুরত্বটুকু। জিন্নাহ যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন ১৯৪০ সালেই, সে জালটা ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ১৯৫৪ সালেই। জিন্নাহ ভেবেছিলেন অবিভক্ত বাংলার চেয়ে বাংলাকে বিভক্ত করে ছোট করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এতে করে তিনি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চবিলাসী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ফায়দা লুটতে পারবেন। কিন্তু খণ্ডিত বাংলার কাছেও জিন্নাহর ধূর্তামিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।
এ তো গেলো জিন্নাহ এবং তার পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ধূর্তামির ব্যর্থতার কাহিনী। কিন্তু তখন অবিভক্ত বাংলার বাঙালি হিন্দু রাজনৈতিক নেতৃবর্গ কী করেছিলেন? তারা কেন অবিভক্ত বাংলার পক্ষে না থেকে বাংলাকে বিভক্ত করে ভারতবর্ষে যোগদান করার মত কুটিল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন? কেন তারা ১৯৪০ সালে যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক ‘স্বাধীন বাংলা’র যে রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন তাতে সমর্থন দেননি? জিন্নাহকে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য প্রকাশ্যে দায়ী করা হয়, এটা যেমন ধ্রুব সত্য- পাশাপাশি বাঙালি হিন্দু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে অত্যন্ত কুটিলতার সাথে ধর্মকে হাতিয়ার করে ভারতবর্ষে যোগদান করার নীরব ষড়যন্ত্র করেছিলেন তা কিন্তু এখনও প্রকাশ্যে আলোচনায় আসে না। এর কারণটা কি শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য, নাকি প্রকৃত ইতিহাসকে বর্তমান প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার জন্য? কতদিন ইতিহাসকে আড়ালে রাখা যাবে? চাইলেই কি তা সম্ভব হবে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস পাঁচশত বছর আগে আমেরিকা আবিস্কার করে স্থানীয় অধিবাসীদের উপর নীপিড়নের যে ভয়াবহ বিভীষিকা চালিয়ে ইউরোপের সুপারহিরো বনে গিয়েছিলেন, তার মূর্তি কি আজ মাটিতে লুটিয়ে পড়েনি?
বিদেশী শাসকদের দ্বারা সর্বদা শাসিত-শোষিত, বঞ্চিত-নির্যাতিত এতদঞ্চলের সাহসী জনগোষ্ঠী কিন্তু কখনোই বাইরের শক্তির অধীনতা নির্বিবাদে মেনে নেয়নি। আপন জাতিসত্তার পরিচয়কে সমুন্নত রাখতে খণ্ড খণ্ড ক্ষুদ্র বিদ্রোহ-বিপ্লব, আন্দোলন-সংগ্রাম তারা করে আসছে সেই সুদূর অতীত থেকেই। সেই অর্থে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সূত্রপাত ঘটেছে বহু পিছনে, দূর অতীতে।
পলাশীর ট্র্যাজেডি সত্যিকার অর্থে পলাশীর প্রান্তরে ‘যুদ্ধ নামের প্রহসনের একটি খেলা’ ছিল। সে খেলায় পরাজিত হয়েছিলেন ঘরে-বাইরে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়া হতভাগ্য বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তিনি অমিত তেজ আর অসীম সাহসিকতা এবং প্রবল দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধকে যুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। সফল হয়েছিল দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমেই পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা সূর্য। পলাশীর এই পতনের মধ্য দিয়ে শুধু বাংলা নয়, বরং গোটা ভারতবর্ষই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনের নিষ্ঠুরতম অধ্যায় বয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাস হতে অনেক দূরে থাকায় আজ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এই তিনটি শব্দের মধ্যেই বাংলার অতীত ইতিহাস সীমাবদ্ধ বলে মেনে নিয়েছে। তারা জানে নবাব সিরাজউদ্দোলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সে সূর্যই নতুন করে উদিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু তারা জানে না যে, সে সূর্য ছিল চাঁদের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক চিলতে সূর্যের সূর্যোদয়। সে সূর্যোদয়ের আঁধার অংশে হারিয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা। আজ নতুন করে বাংলার ইতিহাস নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদেরকে হারিয়ে যাওয়া বাংলার অংশ নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। আমাদেরকে হারানো বাংলা ফিরে চাওয়ার মত দুঃসাহসিক কিন্তু প্রাপ্য দাবী উত্থাপন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম।’ এ কথাটির গভীর তাৎপর্য আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে। আসলে পশ্চিম পাকিস্তান যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের হাতিয়ার বানিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই সুদূর অতীতে পূর্ববঙ্গকে শোষণের হাতিয়ার বানিয়েছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ। এ কারণেই ১৯০৫ সালে যখন পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল তখন সাথে সাথেই এর প্রতিবাদে নেমে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের জমিদার-জোতদার বাহিনী। তারা বঙ্গভঙ্গের জন্য গড়ে তুলেছিল ‘স্বদেশী আন্দোলন’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই ‘স্বদেশী আন্দোলনে’ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে সেই ‘স্বদেশী আন্দোলন’ এর নেতৃবৃন্দরাই আবার নিজেরাই নেতৃত্ব দিলেন ‘বঙ্গভঙ্গের’ রাজনীতিতে। ১৯১১ সালে তাদের বিরাট প্রতিরোধের মুখে বঙ্গভঙ্গ রহিত করে আবারো পূর্ববঙ্গ যুক্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সাথে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তখন সিলেট রয়ে গিয়েছিল আসামের সাথে। আবার অবাক করা ব্যাপার হল মাত্র ৩৬ বছরের মধ্যেই স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাদের ভোল পাল্টে ফেললেন। তখন কেন তারা ‘বঙ্গভঙ্গের’ জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন, এ রহস্য কে উদঘাটন করবে? কবে উদঘাটিত হবে? যদি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জীবিত থাকতেন, তখন হয়ত তাকেই বিস্ময়ে হতবাক হতে হত!
কালের করাল গ্রাসে আজ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি সংস্কৃতির প্রবল জোয়ারে বাংলাভাষা এবং বাঙালি জাতিসত্ত্বাই হুমকীর সম্মুখীন। কিন্তু ১৯৭১ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ চেয়ে চেয়ে দেখল মাত্র নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পূর্ববঙ্গ কিংবা পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ তারপরও তো তারা স্বাধীনতার দাবী তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা যেন পরাধীনতার নাগপাশে বন্দী হয়ে ভারতবর্ষে সংযুক্ত থাকাটাকেই নিজেদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করে। ধর্মের ভিত্তিতেই বিভক্ত হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ। পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানরা অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের অবৈধ নেতৃত্ব মেনে নিতে না পেরে বীরের মত যুদ্ধ করে স্বাধীনতার গৌরব অর্জন করেছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুরা অবাঙালি ভারতবর্ষের হিন্দুদের নেতৃত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মেনে নিয়েছিল এবং এখনও তারা তাতেই সন্তুষ্ট আছে।
সহজ এবং সারকথা হচ্ছে সুদূর অতীত হতেই ‘পূর্ববঙ্গ’ ছিল মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বাসভূমি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গই হোক কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানই হোক, তারা ছিল জমিদার-জোতদারদের স্বর্গভূমি। তারা পূর্ববঙ্গকে শোষণের চারণক্ষেত্রেই পরিণত করেছিল। ‘স্বদেশী আন্দোলনে’ যেমন আন্তরিকতার পরিবর্তে ছিল জমিদার-জোতদারদের স্বার্থসিদ্ধির দূরভিসন্ধি, ঠিক তেমনিই ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের অভিলাস ছিল একই ধরণের স্বার্থসিদ্ধির দূরভিসন্ধি।
বর্তমান প্রজন্মের বর্তমান শ্লোগান হোক আমরা ‘হারানো বাংলা’ ফিরে চাই। স্বাধীন বাংলাদেশকে ব্রিটিশরা খণ্ডিত করেছিল, কিন্তু তার জন্য বাঙালিদের একটি অংশের ঊন্নাসিকতা কি দায়ী নয়? যদি আমার কথা মিথ্যে হয়, তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে মিশে এক হয়ে যেতে চাইবে। চাইবে কি?
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন