হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তাল গাছ
শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি॥ বাংলা ও বাঙালির জনপ্রিয় ফল তাল। সেই তাল ভাদ্র মাসের প্রচন্ড গরমে পাকে বলে তালকে বলা হয় ভাদ্রের ফল। আর ভাদ্র মাসের গরমকে বলা হয় তালপাকা গরম। বছর ঘুরে ভাদ্র মাস এলেই পাকা তালের মোহনীয় গন্ধ জানান দেয় এই বুজি এলো ভাদ্র মাস। বাঙালিরা পাকা তাল দিয়ে মুখরোচক খাবার তৈরি করে। তার মধ্যে অন্যতম হল তালের পিঠা, তালের বড়া, তালের ক্ষির বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার। যুগ যুগ ধরে বাঙালিরা ঘরে ঘরে এসব খাবার তৈরি করে নিজেরা খায় এবং অতিথি আপ্যায়ন করে। ভাদ্র মাসের তাল না খেলে কালে ছাড়ে না বলে বাঙালি সমাজে প্রবাদও রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন ভাদ্র মাসের পূর্বেই বাজারে পাকা তাল উঠতে দেখা যায়। এ বছর শ্রাবণের প্রথম দিক থেকেই বাজারে পাকা তাল উঠতে শুরু করেছে। দামও অত্যন্ত্য চওড়া। এক হালি পাকা তালের দাম হাকা হচ্ছে ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। তাল খেতে দুধ, চিনি, গুড়, কিশমিশ, বাদাম, নারকেল, সাগুদানা, আলুবুখারা ও বিভিন্ন গরম মসলার মতো বিভিন্ন দামি উপকরণ প্রয়োজন হয় বলে সাধারণ মানুষ এমনিতেই তাল খেতে খুব একটা আগ্রহী হয় না। এর উপর তালের দাম শুনে সাধারণ মানুষ এর ধারেকাছেও যায় না। বাংলাদেশে তালের প্রাচুর্য ও জনপ্রিয়তার কারণে বাঙালির শিল্প-সাহিত্যে তাল ও তালগাছের উপর রচিত হয়েছে অনেক গল্পকথা, কল্পকথা, গান, কবিতা, প্রবাদ, প্রবচনসহ বিভিন্ন রচনাবলী। প্রবীণজনেরা জানিয়েছেন, আজ থেকে ৩ দশক পূর্বেও বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে প্রচুর সংখ্যক তালগাছ ছিল। দিগন্ত বিস্তৃত গ্রামগুলোতে তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো। সে সময় গ্রামগুলো চিহ্নিতকরণের প্রতীক ছিল তাল গাছ। কবি তাই নিজের গ্রামকে পরিচিত করেছেন ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ বলে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উকি মারে আকাশে। এসব আকাশছোঁয়া তাল গাছে প্রচুর তাল ধরতো। পাকা তাল কখনো বাজারে বিক্রি হতে দেখা যেতো না। বাজারে তালের আষাঢ়ীও বিক্রি হতো না। মাঝে কাঁচা তাল রাখালরা দু-একটা আষাঢ়ী অতিকষ্টে গাছ থেকে পেরে কাঁছি দিয়ে কেটে খেতো। তাল ও তাল গাছ নিয়ে বাঙালি সমাজে অনেক সুন্দর সুন্দর প্রবচন ও প্রবাদ রয়েছে। যেমন রয়েছে তাল পাখার ব্যবহার। গ্রামের নববধুরা ভাদ্রের প্রচ- গরমে তালের পাখা দিয়ে বাতাস দিয়ে নতুন বরকে ঠা করে। শহরের অলি-গলিতে বিক্রি হয় তালের আষাঢ়। যার ফলে তাল বলতে এখন আর বেশি কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বলতে গেলে দেশে এখন পাকা তালের খুবই সঙ্কট। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা ১০ টাকা হালির তাল এখন বিক্রি করছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা হালি দরে। এছাড়াও তালে রয়েছে বিভিন্নমুখী অর্থ। তালের একটি অর্থ হচ্ছে এক বিঘৎ পরিমাপ। যেমনভাবে তাল গাছ ও তাল হারিয়ে গেছে ঠিক তেমন ভাবে হারিয়ে গেছে এসব নাম। কারণ, আগে আমাদের পাঠ্যবইসহ অনেক বইতে তালের তাল গাছ নিয়ে অনেক গল্প, কবিতা, ছিলো যা কালের বিবর্তে হারিয়ে গেছে। কারণ যে হারে তালগাছ নিধন হচ্ছে না থাকাই-তো কথা।
মন্তব্য করুন