হায় আজি যে রজনী যায়-
সরওয়ার আহমদ॥ বর্তমানের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এবং চোখের দৃষ্টিকে প্রখর করে চারিদিকে তাকালে আশার চাইতে হতাশার বলিরেখা, আনন্দের চাইতে বেদনার হাতছানি যেন প্রকট অবয়ব ধারণ করে। দিক-দিগন্তকে যেন ঘিরে রেখেছে স্থবিরতার অক্টোপাস। অর্ন্তলোক থেকে ভেসে উঠেÑ যাহা চাই তাহা পাই না। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটকে ডিঙিয়ে পাঁচ বছর শেষে একই দুর্দশাগ্রস্ত মাইলফলকের দিকে ফিরে তাকালে মনে হবেÑকি সুন্দর সময়টি ফেলে এলাম। অর্থাৎ আজিকার কর্দমাক্ত সময় পাঁচ বছর পরই সোনালি দিন হিসেবে প্রতিয়মান হয়। সময়ের কি বিপ্রতীপ বাস্তবতা! বর্তমানের পাদদেশে দাঁড়িয়ে অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকালে, যতই ভারাক্রান্ত হোক সেই দিনগুলো স্মৃতির মর্মরে দোল খায়, অনুভূতিকে নাড়ায়।
এখন থেকে ছয় দশক আগের কথা। তখন (১৯৬২) সবেমাত্র মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। শিক্ষক পিতা তাঁর পেশায় সাময়িক বিরতি টেনে ছুটে যান লন্ডনে। তাঁর বড় ভাই অর্থাৎ আমার চাচা তখন একাধারে উনত্রিশ বছর যাবৎ দেশছাড়া অবস্থায় লন্ডনে বসবাস করছিলেন। তাকে ফিরিয়ে আনাই ছিল আমার পিতার মূল উদ্দেশ্য। অভিভাবকহীন পরিবারে তখন অন্ধেরযষ্ঠি হিসেবে আমি এদিক সেদিক দৌঁড়ঝাপ দিতাম। বিশেষেত দৈনন্দিন হাটবাজার ছিল আমার উপর নির্ভশীল। মনে পড়ে, শনি এবং মঙ্গলবার ছিল হাটের দিন। দাদি একটাকা হাতে ধরিয়ে নিকটবর্তী একাটোনা বাজারে আমাকে পাঠাতেন বাড়ির কোনো চাচা কিংবা দাদার সাথে। তাঁদের সাথে কয়েকদিন বাজারে আসা যাওয়ার সুবাদে বাজারি তরিকা রপ্ত করে নিয়েছিলাম। একসময় বাজার-সদাই করে একাএকাই বাড়ি ফিরতাম। বাজারে আগে ছোট মাছ ‘ভাগা’ হিসেবে বিক্রি হতো। একভাগা টেংরামাছের মূল্য ছিল চারআনা (বর্তমানে ৩০০ টাকা)। একভাগা গুলশা বিক্রি হতো আটআনা (বর্তমান মূল্য ৫০০ টাকা)। সেসময় মধ্যমানের ইলিশ কিনেছি আটআনা থেকে বার আনায়। শীত মৌসুমে হাওরের মধ্যমানের বোয়াল দেড় টাকায় কেনারও স্মৃতি আছে। দাদি যেদিন একটাকা ধরিয়ে দিতেন বাজারের জন্য, সেদিন মাছ, পান, কাঁচা মরিচ এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে আনাজ কেনার পরও হাতে এক কিংবা দু’আনা উদ্ধৃত থাকত। যেদিন দু’টাকা দিতেন সেদিন ছোট মাছ এবং বড় মাছের কাটা টুকরাসহ আনাজপাতি কেনার পরও দুই চারআনা হাতে থাকত। ফেরার পথে দুই পয়সার বাদাম কিনে তিন পকেটঅলা শার্টের এক পকেটে ভরে চিবিয়ে চিবিয়ে বাড়ির পথ ধরতাম। সেই আমি তো এখনও এই আমিতেই আছি। মধ্যে কেটে গেছে শুধু ষাটটি বছর! ষাট বছর আগে এক টাকা দিয়ে যে বাজার-সদাই করতাম এখন এক হাজার টাকায়ও সে বাজার সঙ্কুলান হচ্ছে না। জামানা আগায় না পিছায় সেটি তো মালুম করতে পারছি না। মরমে শাহ আব্দুল করিমের গানের কলি ভেসে ওঠেÑ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা…। মাঝেমধ্যে রবি ঠাকুরের কবিতাও ছুটে আসেÑ হায় আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে! গান এবং কবিতা অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং নস্টালজিয়াকে জাগিয়ে তুলে ঠিকই। কিন্তু অতীতকে বাস্তবতার মোড়কে টেনে আনা যাবে না। অতীত বাসির তালিকা ভুক্ত! এবং বর্তমান হচ্ছে উষ্ণতার ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত। কিন্তু এই উষ্ণতাকে কেন জানি মনে হয় হিম শীতল দংশন সমতূল্য। এই দংশনে নীল হয়ে যাচ্ছে অবয়ব। অবশ্য বর্তমানের ছোঁয়ায় এবং পরিবর্তনশীলতার ধর্মানুসারে আ-মানুষ মানুষ হচ্ছে , আ-ঘাটে ঘাট হচ্ছে, আ-পথে পথ হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু অন্তর থাকলেও আন্তরিকতা পথ হারিয়ে লাপাত্তা হচ্ছে, হৃদয় থাকলেও হৃদিকতা হচ্ছে ফেরারি এবং মনন থাকলেও মানবিকতা হচ্ছে নিরুদ্দেশ।
ষাট বছর আগের যে স্বর্ণালি স্মৃতির জাবর কেটেছি, সেসময়েও অস্পষ্ট হাহাকার ছিল। এক দাদা বলতেন এ কোন জমানা আসল! চারআনার কাঠি ধরা (গামছা) এখন আটআনা, দু’টাকার করুতেল, (সরিষাতেল) এখন চারটাকা! বাঁচি কেমনে? সম্ভবত বাজার অর্থনীতির অঙ্কুরোদগম সেসময়ে-ই হয়েছিল। বাজার অর্থনীতি ডালপালা প্রসারিত করে এবং মহীরুহ সেজে নাট্রোজেন অক্সিজেনকে গিলে খাচ্ছে। একই সমান্তরালে গানও রচিত হচ্ছেÑ বাজার লুটিয়া নিল চড়াইরে এই বাজার অর্থনীতির বেসামাল ট্রেনে চেপে বিশ্বমানবকূল কোন স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলেছে তা কী কেউ বল তে পারবেন? তবে যার শুরু আছে তার শেষও আছে। এই শেষটা কেমনতর হবে তা ভেবে কোন কিনারা মিলছে না।
লেখক : সরওয়ার আহমদ, সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধের লেখক ও গবেষক।
মন্তব্য করুন