হায় স্মৃতি সৌধ!

October 2, 2022,

সরওয়ার আহমদ॥ বিষয়টি দৃষ্টিকটু এবং স্পর্শকাতর হলেও এখন বোধ হয় সহনীয় হয়ে উঠেছে। তবে প্রতিক্রিয়া হীন হয়ে উঠতে পারেনি। শহীদ মিনার বা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সৌধে পূজার আয়োজনের নজির বোধকরি দেশের কোথায়ও নেই। ব্যাতিক্রম শুধু মৌলভীবাজার শহর। মনুব্রীজসংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সৌধে গত ৪বছর যাবত দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবছরেও তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। প্রশ্ন উটতে পারে- অসাম্পাদায়িক চেতনার প্রতীক এ স্মৃতি সৌধে পূজা উদ্যাপনের ব্যাপারে প্রতিবাদকারী কী কেউ নেই? উত্তরে বলা যায়- বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা সহ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড প্রতিবাদি হয়েছিলেন। বিক্ষিপ্তভাবে কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছেন। পত্র-পত্রিকায়ও লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু কোনকিছুই ধোঁপে ঠাইপায়নি। পূজার আয়োজক হরিজন যুবসংঘেরই জয় হয়েছে।

পুরাতন মনুব্রীজের উৎসমুখে কেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে তাঁর প্রেক্ষপট এখানে তুলেধরার প্রয়োজন মনে করছি। পাক হানাদার বাহিনী ৭১ সনের ২৬ মার্চ থেকেই মানুষ ধরে এনে মনুব্রীজের রেলিং এ বেঁধে গুলি করে নদীতে ফেলে দেওয়ার পন্থা অবলম্বন করেছিলো। প্রকাশ্য দিবালোকে ঐবছরের মে মাসে এই ব্রীজে প্রদর্শনী হত্যাকা- ও অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। মনু ব্রীজের বড় বৈশিষ্ট হচ্ছে- ৭১ সনের ২৭ মার্চ হাজার হাজার জনতা এই ব্রীজ দিয়ে শহরে প্রবেশ করে কার্ফু ভঙ্গ করেছিলো। যুদ্ধ বিধ্বস্ত মনুব্রীজ ভেঙ্গে নতুন ব্রীজ স্থাপিত হওয়ার পর পুরাতন ব্রীজের উৎস মুখে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সৌধ গড়ে তুলার গুরুত্ব অনুভূত হয়। ফলে গত ২০০০ সনে তৎকালিন পৌর চেয়ারম্যান মরহুম মাহমুদুর রহমান স্মৃতি সৌধের ভিত্তি স্থাপন করে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম হাতেনেন। কিন্তু তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পর বিএনপি শাসন আমলে স্মৃতি সৌধটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। স্মৃতি সৌধ স্থাপনের আগে এখানে বাঁশ ব্যবসায়ীদের আড়ত ছিলো। এই আড়ত কে অপসারণ করেই সৌধ নির্মাণের কাজ আরম্ভ হয়েছিলো। অসমাপ্ত স্মৃতি সৌধটি পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্টিত হওয়ার পর সৌধটির পূর্ণাঙ্গ প্রাপ্তিসহ দৃষ্টিনন্দন অবয়ব ধারণ করে। এই দৃষ্টিনন্দন পরিসরে হরিজন যুব সংঘ দূর্গাপূজা অনুষ্ঠানের গোঁ ধরে বসে। স্থান টি যখন বাঁশ ব্যবসায়ীদের কবলে ছিলো এবং রাতে এখানে মদ ও গাজার আসর বসত তখন এ খায়েশ ছিলো কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সৌধ টি নির্মিত হওয়ার পর এ স্থান টি জাতীয় আবেগ অনুভূতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এমতবস্থায় এখানে পূজা আয়োজনের হেতুকি? বিষয়টি দুর্বোধ্য। তবে স্মৃতি সৌধ ও লাগোয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণকালে পূজার প্রধান আয়োজক হরিজন যুবকটি শুধু প্রতিবন্ধকথা সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকে নি, আলোড়নও তুলেছিলো। তাই সংগতভাবে এই প্রশ্ন উঠে- এরা কি মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত? তবে মানতে হবে তাদের খুঁটির জোর অনেক শক্ত।

স্মৃতি সৌধের জমির মালিক কোনো হরিজন নয়। এটি সড়ক ও জনপদ বিভাগের মালিকানাধীন। পূজার বাহানায় এই জমির উপর দখল প্রতিষ্ঠা কি মূল লক্ষ্য? সত্য-মিথ্যা জানিনা, তবে জনশ্রুতি আছে জেলা আওয়ামী লীগের দুই হিন্দু নেতার আশির্ব্বাদ পুষ্ঠ এই হরিজন। এই কারণেই বোধহয় অন্যান্য নেতৃবর্গ বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছেন। তাছাড়া ভোট ব্যাংকের কথাটি ও মাথায় আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- ভোট ব্যাংক বড় না জাতীয় আবেগ অনুভূতি বড়? প্রাসঙ্গিক যে এব্যাপারে শাসক দল আওয়ামী লীগ যেমনি মৌনব্রত পালন করছে তেমনি বিরোধীদলও গরজহীন। বিরোধীদলের রাজনৈতিক দর্শনেতো শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সৌধ গুরুত্বহীন। অন্যান্য দলের অবস্থা ধরি মাছ নাছুই পানির মত। আর সুশীল ও ধ্যানী বুদ্দিজীবীদের অবস্থাতো তথৈবচ। সুতরাং এ ব্যাপারে আর বলার কিছুই নেই। মেনেছি গো… হার মেনেছি… এই গানের সুর তোলাই ভালো। তবে এই ব্যাপারে একটি দাবি তোলা যৌক্তিক মনে করছি। স্মৃতি সৌধে যদি হরিজনদের দূর্গাপূজা বাঁধাহীন হয়ে থাকে তাহলে অন্যান্য সম্পদায়ের অধিকার ও তদ্রুপ নিশ্চিত হোক। এখানে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কীর্ত্তণ, বাউলদের ফকিরমেলা, মনিপুরি সম্প্রদায়ের রাস উৎসব, শিয়া সম্প্রদায়ের মর্সিয়া, চা শ্রমিকদের ফাঁগুয়া, খিৃষ্টানদের বড় দিন এবং বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা জন্য স্মৃতি সৌধ কে উন্মক্ত করে দেওয়া হোক। তা ছাড়া দাবি অনুযায়ী নিকটবর্তী পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের বার্ষিক ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল এখানে অনুষ্ঠিত হলে ক্ষতি কি?

পরিশেষে বলতে চাই আমি মুসলাম হলেও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে অন্তর থেকেই লালন করি। তাই দূর্গাপূজার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। পূঁজাটি এখন সার্বজনীন আদল ধরেছে। মনেপড়ে কিশোর বয়সে নিজপাড়ার হিন্দু বাড়ির হরিলুটে বাতাসা কুঁড়িয়েছি। পৌষ সংক্রান্তির সন্দেশ পিঠা খেয়েছি আগ্রহের সাথে। ধর্ম তাতে অন্তরায় হয়ে উঠে নি। মুক্তিযুদ্ধকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি বাস্তবের চশমায়। তাই অনুরাগ বশত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখিকে প্রাধান্য দেই।

ফলতঃ অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতি থেকেই আজকের এই কলমি প্রয়াস।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com