হিন্দু জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে শ্রীমঙ্গলে আওয়ামী লীগের সমাবেশ
এহসান বিন মুজাহির : দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দোকানপাঠ, বাড়িঘর ও মন্দির ভাংচুর, লুঠপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ এনে হিন্দু জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে গতকাল শ্রীমঙ্গলে আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এমিছিল ও সমাবেশে অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ডা. হরিপদ রায়, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক সুশীল শীল, সদস্য মিতালি দত্ত, আওয়ামীলীগ ঘরনার প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জেলা ও উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহর তরফদার, ভুনবীর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি পিনাকি রঞ্জন দেব, সাধারণ সম্পাদক সুব্রত কুমার দাস, আশিদ্রোন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পুনেন্দু দেব, সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য চন্দন চক্রবর্তী, নির্মল পাল, অমেরেন্দু চন্দ্র,সিন্দুর খান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্পাদক চানমারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিনয় ভুষন দেব, শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উত্তরসুর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ নেতা “স্বপন বিশ্বাস”, রামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আওয়ামী লীগ নেতা উপেন্দ্র দেবনাথ, শ্রীমঙ্গল উপজেলা মহিলা বিষয়ক সরকারি কর্মকর্তা সুদীপ দাস রিংকু, উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়ন ও চা বাগান ইউনিটের আওয়ামী লীগ সভাপতি/সম্পাদক ও বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ ঘরানার শিক্ষক শিক্ষিকাকে সমাবেশে যোগ দিতে দেখা গেছে। সোমবার বিকালে হিন্দু “জাগরণ মঞ্চ” নামে একটি ধর্মীয় সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী ও সনাতন সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ, যুবক, তরুণ, কিশোর অংশ নেয়। সমাবেশে তারা বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। স্লোগানের মধ্যে ছিল, জেগেছে রে জেগেছে, সনাতনীরা জেগেছে, মন্দিরে হামলা কেনো, জবাব চাই, জবাব চাই, কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কী কারও বাপ-দাদার, আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘আমার মাটি আমার মা, ছেড়ে কোথাও যাব না, স্বাধীন দেশে হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই, বিচার চাই বিচার চাই, হামলাকারীর বিচার চাই’। সমাবেশ চলাকালে শহরের চৌমুহনা এলাকা ও এর আশপাশের সংযোগ সড়কগুলো সনাতনী লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। এসময় শহরে তীব্র যানজটে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ও নাশকতার আশঙ্কায় পরবর্তীতে সেনাবাহিনী এসে বিক্ষোভকারীদের দ্রত সরিয়ে দেয়। এসময় বিক্ষোভকারীরা সমাবেশ থেকে ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন এবং তা বাস্তবায়নের দাবি জানান। এর আগে শহরে বিশাল মিছিল বের করে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পরে চৌমুহনা চত্ত্বরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে ৮ দফা দাবি পেশ করা হয়। তাদের দাবিগুলো হলো: সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের দ্রুততম সময়ে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্তদের যথাপোযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে,অনতিবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রনয়ন করতে হবে,সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে,হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে হিন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে,পাশাপাশি বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টিকেও ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে,দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইন’ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনা রুম বরাদ্দ করতে হবে,সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড, আধুনিকায়ন করতে হবে ও শারদীয় দুর্গাপুজায় ৫ দিন ছুটি দিতে হবে। এদিকে শ্রীমঙ্গলে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের বাড়ি ঘর, মন্দিরে কোন হামলা, অগ্নি সংযোগের ঘটনা না ঘটলেও প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বে এ ধরণের সমাবেশ করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলেছেন, এই উপজেলায় কওমি মাদরাসার আলেম, ছাত্র-শিক্ষকসহ মুসলিমরা পালাক্রমে করে হিন্দুদের বাড়ি ঘর, মন্দির পাহারা দিয়ে তাদের রক্ষা করছেন, সেখানে এ ধরণের ধর্মীয় সংগঠনের ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশে উস্কানীমূলক স্লোগান দেয়ায় উপজেলায় ধর্মীয় সম্প্রীতির বিনষ্টের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এছাড়া শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ও প্রতিটি গ্রামে গ্রামে অজপাড়াগাঁয় গত ৫ আগস্ট থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মোঃ মহসিন মিয়া মধুসহ বিএনপি-জামাত, হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, কওমীমাদরাসা শিক্ষার্থীসহ মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পেশার মানুষ অপরিসীম ভূমিকা রাখায় উপজেলার কোনো আওয়ামী লীগ ঘরানার কোনো ব্যক্তিসহ সনাতন ধর্মের কোনো ব্যক্তি বা মন্দির,গির্জায় কোনো আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মুসলিম সম্প্রদায়ের যুবকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের রাত জেগে পাহারায় মন্দির-গির্জা রক্ষা, চোর-ডাকাতি ঠেকানোসহ নানা মহতি কর্মকাণ্ডের কারণে সনাতন ধর্মের মানুষজন, গির্জা,মন্দির সংশ্লিষ্টরা এবং উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভূয়সী প্রশংসা করেন। শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) “বিনয় ভূষণ রায়” কর্মবিরতির পর শ্রীমঙ্গল থানার কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পর গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, শ্রীমঙ্গলের পরিস্থিতি শান্ত। এখন পর্যন্ত এ উপজেলায় কোনো মন্দির-গির্জায় দুষ্কৃতিকারীরা হামলা করেনি এবং আওয়ীমী লীগের নেতাকর্মীর উপর কেউ হামলা করেছে বলে খবর পাইনি।
জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা মোঃ মহসিন মিয়া মধু বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শহর শ্রীমঙ্গলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অমুসলিমদের বাড়ি-ঘর পাহারাসহ তাদের উপাসনালয় রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে উপজেলা বিএনপিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। বিশেষ করে ৫ আগস্ট বিকেল থেকে শহরে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান,ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাঠ ও স্থাপনা ভাঙচুর থেকে রক্ষা করতে আমি ছাত্র-জনতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসক বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে মতবিনিময় করি। দুষ্কৃতিকারীরা যাতে করে উপজেলায় কোনো নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা না করে এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহবান করি। এরপর আমি শহর-শহরতলী এবং উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন এলাকাার পাড়া-মহল্লায় বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, পৌরসভার কাউন্সিলর, ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিকদের সাথে নিয়ে সবাইকে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করি। সবাইকে আহবান করি শান্তিপূর্ণভাবে যার যার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যোগদান করতে। আমি তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেই। যার কারণে শ্রীমঙ্গলে কোনো মন্দির-গির্জা এবং অমুসলিম কারো বাড়ি-ঘরে দুষ্কৃতুকারীরা হামলা-ভাঙচুর করতে পারিনি। এমনকি জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তাও আমি নিশ্চিত করি। পর্যায়ক্রমে যখন উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশসহ সবাই কর্মস্থলে আসা শুরু করলেন। পরিস্থিতি স্বাাভাবিক হতে শুরু করলো। ঠিক তখনই শ্রীমঙ্গল চৌমুহনাতে বিভিন্ন সনাতন ধর্মীয় সংগঠনের ব্যানারে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে শ্রীমঙ্গলে মন্দিরে হামলা কেনো, প্রশাসন জবাব চাইসহ বিভিন্ন উস্কানীমূলক স্লোগান দিয়ে উপজেলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাঁয়তারায় লিপ্ত হলো। কাজেই কোনো ধর্মীয় সংগঠনের আড়ালে কেউ যেনো রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে না পারে এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
পৌর মেয়র মহসিন মিয়া মধু আরও বলেন, ছাত্র-জনতা যখন বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছে, তখন একদল মানুষ ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে ব্যর্থ করতে উপজেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাঁয়তারা করছে। তিনি বলেন, শ্রীমঙ্গলে সড়কে নিরাপত্তা রক্ষায় ট্রাফিকের কাজ, ভয়াবহ চুরি-ডাকাতি এবং থানা ও অমুসলিমদের বাড়ি-ঘর রক্ষায় দিনরাত পাহারা বসিয়ে হেফাজত করেছে শ্রীমঙ্গলের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এরপরও যারা অমুসলিমদের বাড়ি-ঘর ও উপাসনালয়ে হামলার অজুহতা তুলে উপজেলায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে তারা পরাজিত শক্তি এবং দেশের শত্রু। কাজেই সম্মিলিতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাঁয়তারা রুখে দিতে হবে।
মন্তব্য করুন