হেকমতের বাপ
মোঃ আবু তাহের॥ আমাদের দেশের বড় একটি ঐতিহ্য হইল পিঠা। শীতকালে বেশী করে পিঠা তৈরী হয় আর এই মৌসুমেই পিঠা খাইতে স্বাদ বেশী। সব ঋতুতেই কম বেশী পিঠা খাওয়া হয়। বিশেষ করে অগ্রহায়নের শেষে নুতন ধান ঘরে উঠার পরই আরম্ভ হয় নুতন চালের পিঠা। আহ্ নুতন চালের পিঠা কি স্বাদ ! বাড়ীতে বাড়ীতে পিঠা,এক এক বাড়ীতে এক এক দিন পিঠা খাওয়ার দাওয়াত। আমাদের অঞ্চলে একটি রেওয়াজ আছে ক্ষেতের ধান ঘরে তুলেই মেয়ের বাড়ীতে সব জাতের পিঠা তৈরী করে দিতে হয় আর জামাইকে পিঠা খাওয়ার দাওয়াত দিতে হয়। গ্রাম গজ্ঞে আরো একটি রীতি প্রচলিত আছে,কোন মহিলা সন্তান সম্ভবা হইলে সাত মাসের সময় তাহার বাপের বাড়ী থেকে বেশী করে কয়েক জাতের পিঠা তৈরী করে ভার ভাড়াটি দিয়ে মেয়ের বাড়ী পাঠাইতে হয়। ইহাকে স্বাদ পিঠা বলে। কথা আছে, স্বাদ পিঠা না খাইলে নাকি উদরের সন্তান কাঙ্গাল হয়। তাই বাড়ীর সব মেয়ে লোক মিলে রং তামাশা করে বিভিন্ন সাজে পিঠা তৈরী করেন। বিয়াই বিয়াইনের এবং মেয়ে ও জামাইর জন্য আলাদা থাল সাজিয়ে দিতে হয়।
শহরের লোকেরা চালের গুড়ির পিঠা তৈরিতে তেমন আভ্যস্ত নয়। তবে গ্রামে গিয়ে পিঠা খাইতে অভ্যস্ত। চালের গুড়ি দিয়ে কত জাতের পিঠা তৈরী হয় তাহা বলে শেষ করা যাবেনা। এক এক অঞ্চলে পিঠার এক এক নাম। আমাদের অঞ্চলে সন্দেশ,নুনের বড়া,ভাপা,চিতই,চইপিঠা, সমসা,সিংগারা,মারিপিঠা,আখ ও খেজুরের রস দিয়ে রস পিঠা এবং তাল দিয়ে তালের পিঠা। আমি শুধু কয়েকটি পিঠার নাম লিখেছি। এক নামে চার পাঁচ জাতের পিঠা হয়। পিঠার ভিতর চিন ,গুড়,নরিকেল, ডাল,সবজি,মাছ ও মাংস ইত্যাদি দিয়ে সুস্বাদু পিঠা তৈরী হয়। পাঠালী গুড়ের সন্দেশ যে কি স্বাদ,পাঠালী গুড় নাম শুনেই জিভে পানি আসে। চইপিঠা চুলার অঙ্গারে পুড়িয়ে চুলার পাশে বসে গরম পিঠা খাইতে কিনা স্বাদ।
পিঠা দিয়ে কত কেচ্ছা কাহিনী আছে তাহার অন্ত নাই। এক স্বামী তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে বলেছিলেন চিতই পিঠা তৈরি করার জন্য। স্ত্রী গুড়ি তৈরী করে সানন্দে পিঠা তৈরী করিতে লাগিলেন আর স্বামী শয়ন কক্ষে ঘুমিয়ে অপেক্ষায় আছেন। পিঠার ঘ্রান পেয়ে স্ত্রীরির এক অসৎ বন্ধু ছিল,সে রান্না ঘরের পিছনের দরজায় লুকিয়ে বসে পিঠার ভাগ চাহিল। স্ত্রী তাহার প্রিয় বন্ধুকে কিছু পিঠা দিয়ে সরিয়ে দিল। পিঠা তৈরী শেষকরে সুন্দর একটি প্লেইটে পরিবেশন করে আদরের স্বামীর কাছে গেলেন,দু’জনে একসাথে বসে খাবেন। স্বামী চেয়ে দেখলেন প্লেইটের মধ্যে দশটি পিঠা সুন্দর করে সাজানো। তিনি স্ত্রীকে বলিলেন, “ছেত পনেরো আর খাইতে দশ,এই কি তোমার পিঠা শেষ”? স্ত্রী উপস্থিত বুদ্ধি করে বলিলেন, “আমি তোমাকে ভয়ে বলি নাই, কিছু পিঠা তৈরী করে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে বাহিরে গিয়েছিলাম। এসে দেখি বড় কাল বিড়াল পিছনের দরজা দিয়ে কিছু পিঠা নিয়ে দৌড় দিয়েছে”।
স্বামী : হ্যাঁ আমিও কিছুটা নড়াচড়ার শব্দ পেয়েছিলাম,তুমি রান্নাঘরে আছ বলে আর লক্ষ্য করি নাই। তাহলে বিড়াল ও বুঝি পিঠা খায়। অনুশোচনা করে লাভ নেই, বিড়ালের ভাগ্যের পিঠা বিড়াল খেয়েছে।
কিভাবে পিঠা তৈরী করিতে হয়,সেটি আরেক শিল্প। পিঠার চাল কয়েক ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পানি থেকে তুলে, পানি ঝেরে নিতে হয়। তারপর গাইলে ছিয়ায় পাড় দিয়ে গুড়ি তৈরী করিতে হয়। বেশী চাল হইলে ঢেঁকিতেও গুড়ি পাড় দেওয়া যায়। গাইলে ছিয়ায় গুড়ি করতে দুইজন লাগে,হয় ননদ ভাবী,দুই জায়া অথবা বউ শাশুরী। গাইলের মধ্যে চাউল রেখে দুই ছিয়া দিয়ে দুইজন শ্বাস বন্ধ করে তালে তালে ধুরুম ধুরুম করে গাইলে পাড় দিতে হয়। ধুরুম ধুরুম আওয়াজ শুনে পাশের বাড়ীর লোকেরা অনুভব করতে পারে,ঐ বাড়ীতে পিঠা তৈরী হইতেছে। অনেক সময় পাশের বাড়ীর মেয়েরা এসে গুড়িপাড়ে সাহায্য করে। এখন আর গাইল ছিয়ায় গুড়ি পাড় না দিলেও চলে,মেশিনে গুড়ি তৈরী করা যায়।
চালের পেকেটজাত গুড়ি কিনতেও পাওয়া যায়। মেশিনের করা গুড়ির পিঠা হাতের করা গুড়ির পিঠার মত স্বাদ হয় না। একই ভাবে ধান দিয়ে চিড়া তৈরী হয়।
আধুনিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান,স্ন্যাকবার এবং রেষ্টুরেন্টে পিঠার অনুকরণে কিছু মুখরোচক খাবার যেমন সেন্ডুইস,চমচা,সিঙ্গারা,বার্গার ও হটডক ইত্যাদি বেশ আলোচিত খাবার পাওয়া যায়। এছাড়া ফুটপাতে,কোন ঝমঝমাট কর্ণারে ও রিক্সা ভ্যানে করে চিতই পিঠা,ভাপা পিঠা ইত্যাদি কত রখমের গরম গরম পিঠার চাহিদা পুরন করিতেছে। আমরা প্রায় সময়ই পত্র পত্রিকায় দেখি বাঁসি,পচা মাংস,গরু ছাগলের নাড়িভুড়ি ও সাকসবজি দিয়ে তৈরী করা হয়। এছাড়া ফুটপাতের ধুলিবালি,ময়লা আবর্জনা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বিভিন্ন উপকরণে এগুলো সুস্বাদু হইলেও স্বাস্থ্যসম্বত নয়। এগুলা খেয়ে আমাদের পেটের পিড়া হইতেছে। পক্ষান্তরে আমাদের বাড়ীতে করা চালের গুড়ির পিঠার সাথে এগুলির তুলনা হয় না।
আমাদের শৈশবে দেখা ও শুনা কিছু কাহিনী না লিখে পারছি না কারণ উল্লেখিত গল্পের সাথে সে কাহিনীর সম্পৃক্ততা আছে। আমাদের গ্রামের উত্তর পাশে গাড়ী চলার বড় রাস্তা,তার উত্তরে মনু নদী। ভাদ্র ও অগ্রহায়ণ মাসে কত নৌকা আসত মাটির বাসন,কলসি ও কত জাতের খেলনা নিয়ে। বাসনের নৌকার লোকদেরকে বলা হইত “বাসনিয়া”। বাসনিয়ারা গ্রামে গ্রামে হাঁটিয়া কাঁধভার করে বাসন বিক্রি করিত। একটি ধাঁধা আছে, “লাল মিয়া হাটে যায় আর দুই গালে থাপ্পর খায়”। মহিলারা মাটির বাসন রাখার সময় একহাতের তালুতে বাসন রেখে অন্য হাতে থাপরাই থাপরাই শব্দ করে দেখেন,টুটাফাটা আছে কিনা। আর ধান দেওয়ার সময় ভাল ধানের সাথে চুচা মিশিয়ে দেয়। বাসনিয়া এক পাতিল ধানের বাসন,বিশ পাতিল ধান দাম চায়। দর দাম করে পাঁচ সাত পাতিল বিক্রি করে। চুচা মিশাইয়া দিলে কি হইবে সেও ঝারিয়া মুছিয়া অনেক বেশী নেয়।
আমাদের মুরব্বিরা কাহারো মাথায় অযত্নে নাচাটা লম্বা চুল দেখলে বলতেন চুল বসনিয়ার মত লম্বা কেন ?তাহা হইলে নিশ্চয় তাদের মাথায় লম্বা চুল ছিল। হ্যাঁ বেশীর ভাগ বসনিয়াদের মাথায় অযত্নে,নাচাটা, তৈল ও সাবানবিহিন খসখসে ঝাকড়া চুল দেখা যাইত। সঠিক কারণ জানা নাই হয়ত বা লম্বা সফরে সময় ও টাকা বাঁচানোর জন্য হইতে পারে। একদিন জুম্মার নামাজের পর বাসনের নৌকার সরদার নালিশ জানাল,কে বা কাহারা রাতের অন্ধকারে ঢিল মেরে অনেক বাসন ভেঙ্গেছে। মসজিদের মুতওয়াল্লি সন্দেহজনক কয়েক ছেলেকে শাসাইলেন। পরে জানতে পারলাম কোন এক ডানপিটে ছেলে নৌকায় গিয়ে একটি মাটির ঘোড়া চেয়ে ছিল। দেয় নাই বলে,রাতে ঢিল মেরে অনেক বাসন ভেঙ্গে দিয়েছে। এখন আর সে যুগ নেই। নদীও ভরাট হয়েছে,হেমন্তে নৌকাও আসে না। মাটির বাসনের প্রচলন ও নাই। কাহার মাটির বসনের দরকার হইলে ,বেশী দাম দিয়ে শহরের কোন দোকান থেকে কিনতে হয়।
একটি ছোট গল্প লিখতে আবুল তাবুল পুরানা কথা অনেক কিছু লিখে ফেলেছি আবুল তাবুল বলা ঠিক হবে না আসলে আমার গল্পটাই আবুল তাবুল। ছোট কালে মায়ের কাছে শুনা গল্পের অনেক কিছু ভুলে গেছি। গল্পের নাম “হেকমতের মা” লিখতে গিয়ে “হেকমতের বাপ” লিখে ফেলেছি।
বউ শাশুরী ধুরুম ধুরুম গুড়ি পাড় দিতেছেন,পিঠা তৈরী করিবেন। বাড়ীর পাশ দিয়া এক বাসনিয়া যাইতেছিল। ধুরুম ধুরুম গুড়ি পারের শব্দ শুনে তাহার জিভে পানি আসিল, “পিঠার কি স্বাদ,অনেক দিন যাবত মায়ের হাতের পিঠা খাই নাই। যে ভাবেই হোক এ বাড়ীতে,আমাকে পিঠা খেতেই হবে”। মাটির বাসন,মাটির বাসন ডাকিতেছে। তাহাদের মাটির কলসের দরকার। শাশুরী বলিলেন,মাটির ভাল কলস থাকলে এবাড়ীতে আস। সে খুব পরিচিত,প্রতি মৌসুমেই অত্র এলাকায় বাসন বিক্রি করে। ভাল কলসি আছে মা দেখিয়া রাখেন।
বাসনিয়া : মাগো আপনারা চাল দিয়া কি করিতেছেন ?
শাশুরী : কেন তুমি দেখতেছ না ? আমরা চালের গুড়ি তৈরী করিতেছি,পিঠা তৈরী করব।
বাসনিয়া : গুড়ি কি আর পিঠা কি কোন দিন নাম শুনি নাই। আজ প্রথম শুনলাম
শাশুরী : তোমার মা চাচিয়ে কোন দিন পিঠা তৈরী করে খাওয়ায় নাই।
বাসনিয়া : আমার মা নাই,কিন্তু মা থাকতে ও কোনদিন পিঠা খাওয়া দুরের কথা পিঠার গল্প শুনি নাই। পিঠা কি কি জিনিস দিয়ে তৈরী হয় আর খেতে কি মঝা তাও জানিনা
শাশুরী : গুড়,চিনি,নরিকেল ও তেল ইত্যাদি দিয়ে গুড়িকে কাই করে বিভিন্ন ভাবে পিঠা তৈরী করিতে হয় অনেক সময় লাগে,তুমি কাল আসিও পিঠা খাইয়া যাইবায়।
বউ : বেত্তমিজ বেটা, মেয়েদের চেহারা দেখা আর গল্প করার জন্য কত ভংগির মাত মাতের। পিঠা একবার চিনে না। কি দরকার তারে পিঠা খাওয়াইবার।
শাশুরী : এ বাসনিয়া প্রতি মৌসুমে আসে,বাসন বিক্রি করে। লালছ করছে পিঠা খাইত,তার মা নাই। পিঠা খাইলে কোন গুনা হইত নায়।
বউ : বেটারে পিঠা খাওয়াইলে ছোয়াব হইব,বেশী করি খাওয়াইন।
পর দিন এসে পিঠা খাইয়া, গৃহকর্ত্রীর গুণগান করে। এত মঝার পিঠা,পেট ভড়ে খাইছি মা সারা জীবন মনে থাকব। আচ্ছা মা পিঠার ভিতর নরিকেল আর মিঠা দিলায় কেমনে? তিনি কি ভাবে পিঠা তৈরী করেছেন বর্ণনা করিলেন। সব শুনে সে বলে,বুঝেছি গো। “তুমি হেকমতের মাই আমার ক্ষুদ্রতের পিঠা আর পিঠার ভিতর কেমনে দিলায় গো মাই মিঠা”। আমার মাও কোন দিন এত মঝার পিঠা খাওয়াইন নাই। তুমি আমার মার স্থলে মা। এখন নৌকায় গিয়ে যদি এত মঝার পিঠার গল্প করি, সবাই বলবে তুমি একা এত মঝার পিঠা খাইলায়,আমাদের জন্য আন নাই কেন ? মাইগো যদি থাকে,অল্প কয়টা পিঠা দাও। তাদেরকে একটি করে দিয়ে আপনার পিঠা তৈরীর গল্প বলব।
কি বুদ্ধি করে পেট ভরে পিঠা খাইল আর গাইট ভরি এক গাইট লইয়া গেল। এখন পাঠক নিশ্চয় বিচার করবেন,আমার এ গল্পে পিঠা তৈরী করার হেকমত বেশী না বাসনিয়ার পিঠা খাওয়ার হেকমত বেশী।
মন্তব্য করুন