১৩ মাস পর শ্রীমঙ্গলের দি বাডস্ স্কুলের শিশু শিক্ষার্থী নাঈম অধিকার ফিরে পেলো

November 13, 2023,
এহসান বিন মুজাহির :  শ্রীমঙ্গলের দি বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নার্সারি ক্লাসের শিক্ষার্থী নাঈম উর রহমান ১৩ মাস পর স্কুলের শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছে। মঙ্গলবার ১৩ নভেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টায় দি বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে শিশু শিক্ষার্থীর অভিভাবককে এ বিষয়টি জানানো হয়েছে। নাঈমের পিতা আব্দুর রহমান মঙ্গলবার সন্ধায় মুঠোফোনে জানান, আজ বিকেল ৫টা ৩৫মিনিটে আমার স্ত্রী ডা. নাদিরা খানম বরাবর বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্যাডে অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম প্রতিষ্ঠানের পিওয়নের মাধ্যমে আমার বাসায় একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, অদ্য ১৩ নভেম্বর অত্র প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব গভর্নরস এর বিশেষ সভার আলোচ্যসূচি-২ এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনার পুত্র নাঈম উর রহমানকে আগামীকাল ১৪ নভেম্বর তারিখ হতে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার অনুমোদন দেওয়া হলো। আপনার পুত্রকে আগামীকাল ১৪ নভেম্বর ২০২৩ হতে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার নিমিত্তে প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। উল্লেখ্য যে, ৮ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের ১১ আইনজীবী শিশু শিক্ষার্থী নাঈম উর রহমানকে ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে ও তার ওপর চলমান মানসিক নিপীড়ন বন্ধ করতে শিক্ষা সচিব, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক, শ্রীমঙ্গল ইউএনও, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, স্কুলের অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। নোটিশ পাওয়ার সাত কর্মদিবসের মধ্যে শিশু নাঈমের ওপর চলমান অমানবিক ও মানসিক নিপীড়ন বন্ধ করতে এবং তাকে ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যথায় নোটিশদাতারা উচ্চ আদালতের দারস্থ হবেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। ১১ আইনজীবীর পক্ষে  নোটিশ পাঠিয়েছিলেন অ্যাডভোকেট মো. আসাদ উদ্দিন। নোটিশ প্রেরণকারী অন্যান্য আইনজীবীরা হলেন- জোবায়দুর রহমান, মোহাম্মদ মিসবাহ উদ্দিন, আল রেজা মো. আমির, রেজাউল ইসলাম, কে এম মামুনুর রশিদ, আশরাফুল ইসলাম এবং শাহীনুর রহমান, মোহাম্মদ হারুন, গোলাম কিবরিয়া ও  বেলায়েত হোসেন সুজা।
নোটিশে বলা হয়েছে, গত ৪ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ আইনজীবীদের নজরে আসে। সংবাদটির শিরোনাম ছিল— ‘প্রতিদিন স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে থাকে শিশু নাঈম’। সংবাদটির সবচেয়ে অমানবিক ও হৃদয়বিদারক দিকটি হলো এক বছরের বেশি সময় ধরে শিশু নাঈম প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলেরপোশাক পরে। এরপর স্কুলব্যাগ নিয়ে তার যমজ ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলের গেট পর্যন্ত আসে কিন্তু গেটে তাকে আটকে দেওয়া হয়। তার সহপাঠী ও অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যখন শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে বা টিফিনের সময় মাঠে খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে, তখন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বিষন্ন মনে তা দেখছে নাঈম। স্কুল ছুটি পর্যন্ত সে দাঁড়িয়ে থাকে স্কুলের প্রধান গেটে। ছুটি হলে ভাইয়ের সঙ্গে বাসায় ফিরে যায়। গত এক বছর ধরে চলছে এমন ঘটনা। নাঈমের যমজ ভাইয়ের জন্য স্কুলের প্রধান ফটক উন্মুক্ত হলেও নাঈমের জন্য ফটকটি বন্ধ রয়েছে ১৩ মাস ধরে। বিধি মোতাবেক স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও বেতন পরিশোধ করলেও সে স্কুলের উপযোগী নয়, কথা বলতে পারে না, পেন্সিল ধরতে পারে না ও দুষ্টামি করে এমন অজুহাতে তাকে অনেকটা অবাঞ্ছিত করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ; যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের প্রতি অবমাননা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন। ঘটনাটি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কলেজ সড়কে অবস্থিত দ্য বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের। শিশু নাঈম ও তার যমজ ভাইকে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ওই স্কুলে নার্সারি বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করা হয়। স্কুলের অধ্যক্ষসহ তিন সদস্যবিশিষ্ট ভর্তি কমিটি তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ওই বছরের জুন মাস পর্যন্ত তারা শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেয়। পরে জুলাই মাসে তাদের ওই স্কুলেরই ইংলিশ মিডিয়ামে পুনরায় ভর্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভর্তি করা হয়। পরে তারা একসঙ্গে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেয়। ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে নাঈমকে ক্লাসে এমনকি স্কুলেও ঢুকতে দেওয়া হয় না।
নাঈমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, সে স্কুলের উপযোগী নয়, কথা বলতে পারে না ও পেন্সিল ধরতে পারে না। এর আগে প্রায় দিনই শ্রেণিশিক্ষক কৃষ্ণা সূত্রধর নাঈমের ডায়েরিতে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য লেখেন; যা শিশুটির ওপর মানসিক নির্যাতনের শামিল। নোটিশে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে শিশুটির বাবা অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি কোনো গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো তার সন্তানকে নিয়ে নানা ধরনের আপত্তিকর কথা বলেন। পরবর্তী সময়ে নাঈমের বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত আবেদন করেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। বরং শিশুটির বাবার এমন তৎপরতার কারণে অধ্যক্ষ তাকে পত্র পাঠিয়েছেন নাঈমের টিসি নেওয়ার জন্য। শিশুটির অসহায় বাবা ব্যবসায়ী মো. আব্দুর রহমান ও মা ডা. নাদিরা খানম দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন প্রায় বছরখানেক ধরে; কিন্তু কোনোভাবেই বিষয়টির কোনো সুরাহা হচ্ছে না। দ্য বাডস রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন কার্যক্রম বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এর মাধ্যমে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হচ্ছে। তাই দেশের সচেতন নাগরিক এবং উচ্চাদালতের আইনজীবী হিসেবে এ আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
চিঠি পাওয়ার পর শিশু শিক্ষার্থী নাঈমের পিতা আব্দুর রহমান এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ছেলের শিক্ষা জীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ
সাড়ে ১৩ মাস চলে গেলো, সে শ্রেণি কক্ষের পাঠদান থেকে বঞ্চিত হলো। মানসিকভাবে আমি এবং ছেলের মা প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছি, যা ঘটে গেলো সেগুলো তো আর রিকভারি করা যাবে না। আমি সুপ্রিমকোর্টের সম্মানিত আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মীসহ যারা যেভাবে আমার ছেলের শিক্ষা জীবন বিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন, যাদের কল্যাণে ছেলে ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আগামীতে যেনো কারো অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও খামখেয়ালীর কারণে কোনো শিক্ষার্থীর পড়ালেখার বিঘ্ন না ঘটে এবং যারা এসবের জন্য দায়ি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এটাই প্রত্যাশা।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দীলিপ কুমার বর্ধন মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, আইনজীবীদের লিগ্যাল নোটিশ পেয়েছি। এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার ও ইউএনও সাহেবকে নিয়ে মিটিং করেছি, আশা করি পজেটিভ সিদ্ধান্ত আসবে। অধ্যক্ষকে বলে দিয়েছি দ্রুত এটি সুরাহা করতে ।
মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা অফিসার ফজলুর রহমান বলেন, বাডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলমকে ইতোমধ্যেে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শোকজ করা হয়েছে এবং ৩ কার্যদিবসের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে, সন্তুষজনক জবাব না না হলে অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।  নোটিশ প্রেরণকারী আইনজীবী এবং ল’ হ্যাভেন-এর প্রধান এডভোকেট মো: আসাদ উদ্দিন মুঠোফোনে
তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমরা চেয়েছিলাম শিশু নাঈমের প্রতি যে অমানবিক আচরন চলছিল তা’ বন্ধ হোক। মৌলিক মানবাধিকার এবং শিশু অধিকার লংঘনের মত অন্যায়ের অবসান ঘটুক। সর্বোপরি শিশু নাঈম তার শ্রেণি কার্যক্রমে বাধাহীনভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাক। যেহেতু আমাদের নোটিশ পেয়ে বাডস্ রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ দ্রুত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং নাঈমকে ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়েছে, এতে আমরা খুশি। কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। প্রত্যশা করবো, ভবিষ্যতে দেশের কোথাও কোন শিশু এমন অমানবিক ঘটনার শিকার যেন না হয়। শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, শিক্ষার্থীর বিষয়টি সুরাহা হয়েছে। আগামীকাল থেকে শিশু নাঈম ক্লাস করতে পারবে।
সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com