১৪২৯ বঙ্গাব্দ : জয় হোক মানবতার সবার জীবনে বয়ে আসুক অনাবিল শান্তি সুখ ও সমৃদ্ধি
মকিস মনসুর॥ বাঙালির জাতিসত্তা-অনুভূতি নবায়নের দিন পহেলা বৈশাখ’ হচ্ছে, বাঙালি জাতির আবহমানকালের সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক উৎসব। চেতনা,অস্তিত্ব, ও হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্যের পহেলা বৈশাখ’ হচ্ছে আমাদের অহংকার, এ যেনো চিরচেনা বীর বাঙ্গালীর বিজয়ী রণহুংকার। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয়, উত্থান এবং জাতিসত্তা বিকাশের শেকড়। স্বাধীনতা পূর্বকালে আমাদের সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধের ওপর বারবার আঘাত এসেছে। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করতে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভিনদেশি সংস্কৃতি। কিন্তু বাঙালি জাতি তা কখনো মেনে নেয়নি। তাইতো প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা বিকাশের প্রবল শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়। সর্বজনীন এই উৎসবটি বাঙালির জীবনাচার, চিন্তা-চেতনা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে একাকার হয়ে। বাংলা নববর্ষ তাই কেবল আনুষ্ঠানিকতানির্ভর কোনো উৎসব নয়, তা বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শেকড় সন্ধানের মহান চেতনাবাহী দিন।
বাঙালির লোকসংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা নববর্ষ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাংলার লোকজ-সংস্কৃতির মূল্যবান অনুষঙ্গ যেমন-যাত্রাগান, পালাগান, পুতুলনাচ, হালখাতা, অঞ্চলভিত্তিক লোকসংগীত, খেলাধুলাসহ গ্রামীণ মেলা যেমন প্রাণ ফিরে পায়, তেমনি বাংলার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হয়ে ওঠে উজ্জীবিত। ব্যবসা-বাণিজ্যেও এর ইতিবাচক প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা নববর্ষের এই বর্ণিল উদযাপন মানুষের মাঝে অনাবিল আনন্দ, উৎসাহ-উদ্দীপনা আর সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আসে।
আমাদের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা বাঙালি হিসেবে বিশ্বের বুকে আমাদের মর্যাদাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ। যেখানে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস বা সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রতি যে জাতির চিরকালীন ঐতিহ্য তা কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না। বাংলা নববর্ষের চেতনা অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে প্রেরণা এবং শক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে আমার দৃঢ বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রীর তার বাণীতে বলেন, বাংলা নববর্ষের উন্মেষ মূলত গ্রামীণ জীবন ঘিরে। হালখাতা উৎসব এবং গ্রামীণ মেলা ছিল একসময়ের মূল আকর্ষণ। হালখাতা এবং মেলাকে কেন্দ্র করে জারি, সারি, পালাগানের আসর বসত এবং গ্রামীণ পণ্যের বেচাকেনা হতো। গ্রামীণ বৈশাখি উৎসব কালক্রমে প্রবেশ করেছে নগর জীবনে। দেশের প্রতিটি শহরেই পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ ঘিরে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়।
বাঙালির মুখের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একদিন এদেশে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। বাঙালিকে বাঙালি হয়ে বেঁচে ওঠার পথটি দেখিয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির উৎসব, সংস্কৃতি সবকিছুকে রক্ষা করে তাকে বিকশিত করার জন্য যে সংগ্রাম, তা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের সব শ্রম, কর্মনিষ্ঠতা ও কুশলতা মিলিয়ে। বাঙালি অন্তঃপ্রাণ শেখ মুজিব সেই পঞ্চাশ, ষাটের দশকেও দলীয় কার্যালয়ে আয়োজন করতেন বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানমালার।
যার উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ৯-মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা মানে আমাদের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজ আমরা প্রগতি এবং অগ্রগতির দিকে ধাবিত হচ্ছি। বাংলাদেশ আজ আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বের ‘রোল মডেল’।
আজ ১৪২৯ বঙ্গাব্দের শুভমুহূর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হয়ে আসুন বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলি, শঙ্কা ,অস্থিরতা দুর্নীতি ও সংঘাত থেকে মুক্তির দিকে অগ্রসর হবে বাংলাদেশ। যেখানে বৈষম্য থাকবে না, মানুষে মানুষে থাকবে না কোন ভেদাভেদ, থাকবে না ধর্মে-ধর্মে কোন বিভেদ। জনতার আশা আকাংখার জয় হবেই। পারস্পরিক সৌহার্দ্য আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আসুন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলাদেশ’প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রধানমন্ত্রী ম্যাদার অব ইউমিনিটি দেশরত্ন শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলার আলোর মিছিলকে এগিয়ে নিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে এই হোক আমাদের দীপ্ত শপথ,,জীর্ণ-পুরানোকে দূরে সরিয়ে আনন্দের ডালি নিয়ে আসুক নতুন বছর। আঁধার কেটে যাক, আসুক আলো, হিংসা-বিদ্বেষ শেষ হয়ে যাক বৈশাখের উৎসবের আনন্দে।
দেশে-বিদেশে যে যেখানে আছেন রক্তের বাঁধন, আত্মীয়-স্বজন, বান্ধব-বান্ধবী সকলের প্রতি রইলো বাংলা নতুন বছরের শুভ-কামনা সহ ১৪২৯ বঙ্গাব্দের শুভমুহূর্তে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে বিশ্ব গড়ে উঠুক একটি শান্তি ও সন্ত্রাসমুক্ত, যুদ্ধমুক্ত আবাসভূমি, নতুন বছরে দূর হোক করোনা ও কুসংস্কার; বিষমুক্ত হোক আমাদের বাংলা, অভিশাপমুক্ত হোক আমাদের পৃথিবী।
মানবিক হোক মানুষ, মানুষের সমাজ হোক বৈষম্যহীন শান্তির।ফিরে আসুক বাঙালীর বঙ্গ সংস্কৃতি, জয় হোক সভ্যতার। বিশ্বময় সকল মানুষের মাঝে স্রষ্টা শক্তি প্রকটিত হোক, বিকশিত হোক সৃষ্টিশক্তির সুন্দরতম চেতন-ইচ্ছা। বিশ্বজগতকে মহাশান্তির উচ্চাসনে স্থাপন করুক, জয় হোক মানবতার সবার জীবনে বয়ে আসুক অনাবিল শান্তি সুখ ও সমৃদ্ধি,সবাইকে জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় হোক মানবতার…!! বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক পরিচিতি : মোহাম্মদ মকিস মনসুর, লেখক, সাংবাদিক ও কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট।
মন্তব্য করুন