১৪৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে এ প্লাস! মৌলভীবাজারে রমরমা কোচিং বাণিজ্য
হোসাইন আহমদ॥ মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ, মহিলা কলেজ, পলিটেকনিক, শাহ্ মোস্তফা কলেজসহ সদর উপজেলায় স্কুল ও কলেজ আছে প্রায় ২শতাধিক। এর বাইরে নামে বেনামে রয়েছে বেশ কিছু কিন্ডারগার্টেন। তবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোচিং সেন্টার। বাণিজ্যিক এ কোচিং সেন্টার গুলো থেকে প্রতি মাসে কিছু শিক্ষক কোমলমতি ছাত্র/ছাত্রীদের পলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। অনেক সরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকদের দিয়ে চলে ওই কোচিং সেন্টার গুলো। অনেকেই প্রকাশ্যে এবং অনেকই অন্তরালে থেকে সেন্টার গুলো পরিচালনা করছেন। এমন অভিযোগ সর্ব মহলে।
কোচিং সেন্টার ছাড়াও রয়েছে ‘প্রাইভেট হোম’। এসব প্রাইভেট হোম মূলত একজন শিক্ষক চালান। সেখানে ব্যাচ করে শিক্ষার্থীরা পড়ে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে শহরে এমন প্রাইভেট হোম ও কোচিং সেন্টার হবে প্রায় ৫ শতাধিক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মৌলভীবাজার শহরে রয়েছে ৪০/৫০টি কোচিং সেন্টার। এর মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলো, কলম্বিয়া কোচিং সেন্টার, নলেজ হোম, এক্সটা টাইম কোচিং ইনিস্টিটিউট, ই-টাইম, সাইফুর্স একাডেমি, ফিউচার গ্রুপ, মেনটরস, হার্বাড, ইকরা, রাইজিং, প্যারাডাইস, সাকসেস, শাহীন, কমার্স, কর্ণিয়া, ফিউচার ব্রাইট, স্টাডি এবরোড, গুলশান একাডেমি, অক্সফোড এডুকেশন, মুসলিম উম্মাহ, মিজানস সহ আরো বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে পৌরসভা থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত হচ্ছে মাত্র ৬টি। বাকী কোচিং সেন্টার গুলো মাসে ১ থেকে দেড় লক্ষ টাকা আয় করলে আদায় করছেনা কোন কর।
শনিবার মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের পার্শ্ববর্তি ফরেন্স টিলা, বড়বাড়ি, সোনাপুর, বনবীথি, বনশ্রী, উত্তর কলিমাবাদ, দক্ষিণ কলিমাবাদ, টিভি হাসপাতল রোড, সার্কিট হাউস এলাকসহ আরো কয়েকটি বাসা বাড়িতে সরেজমনি গেলে দেখা যায়, পৃথক পৃথক ভাবে শতশত শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াচ্ছেন কলেজের শিক্ষকরা। কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, ক্লাসে ঠিকমতো বিষয়টি না বুঝার কারণে প্রাইভেট পড়তে হচ্ছে তাদের।
বিভিন্ন লোভনিয় অপার দিয়ে লিফলেট, ফেষ্টুন, ব্যানার, সাইনবোর্ড ও স্টিকার ছাপা করে অভিবাবক ও শিক্ষার্থীদের মন আকৃষ্ট করছে তারা। এমন এক লোভনীয় অপার দিয়েছে কলাম্বিয়া কোচিং সেন্টার। “এসএসসি ২০১৭ তে মাত্র ১৪৫০ টাকায় এ প্লাস” শিরোনামে কয়েক হাজার লিফলেট ছাপা করে হাতে হাতে বিলি করছে শহরে। এনিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। কি ভাবে ১৪৫০ টাকায় এ প্লাস পাওয়া যাবে? এমন প্রশ্ন অভিবাবক ও সাধারণ মানুষের। অভিবাবক হয়ে শহরের কয়েকটি কোচিং সেন্টারে গেলে মৌখিক ভাবে ভালো ফলাফলের বিভিন্ন লোভনীয় অপারদেন তারা।
শহরে এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে দিনে চলে স্কুল আর রাতে চলে ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোচিং। অনেকটাই এখন স্থানীয় লোকদের কাছে রাতের স্কুল নামে পরিচিত। শহরের বড়হাট এলাকার শাহ জালাল কেজি এন্ড জুনিয়র হাই-স্কুলের এভারের পিএসসি পরীক্ষর্থীদের কাছ থেকে ২ মাসে কোচিং এর নামে আদায় করা হচ্ছে ১৫০০ টাকা করে। শাহ হেলাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কোচিং এর নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ৩০০ টাকা করে। জাতি গড়ার কারিগর এবং সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র শিক্ষকদের এমন বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে ক্ষুব্ধ অভিবাবকরা।
শনি ও রোববার মৌলভীবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট হোমে প্রতিদিন সকাল-বিকেল-রাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ¯্রােত নামে। স্কুল-কলেজের সমান্তরালে শ্রেণিকক্ষের মতো আয়োজন করে এখানে পড়ানো হচ্ছে। স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের প্রফেশনাল মনোভাবের কারণে শিক্ষার মান ভেঁঙ্গে পড়েছে। স্কুল-কলেজে লেখাপড়া না হওয়ায় অনেক অভিবাবকই এখন কোচিং এর উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কোচংই এখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (সম্মান) ও এমনকি স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও এখন কোচিং-প্রাইভেটমুখী হয়ে পড়ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুযায়ী শিক্ষকদের নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ নেই। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড়জোর ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মৌলভীবাজারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী, কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই নিয়ম মানছেন না মৌলভীবাজারের অনেক শিক্ষক। তাঁরা ক্লাসের বাইরে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যেমন পড়াচ্ছেন, আবার অন্য প্রতিষ্ঠানের ৫০-৬০ জন করেও শিক্ষার্থী পড়াচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু শিক্ষার্থীরা বলেন তাদের স্কুলের একজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে তিনি তাদের পরীক্ষায় অকৃতকার্য করে রাখেন। যারা উনার কাছে পড়ে তাদেরকে তিনি পরীক্ষার আগে প্রশ্ন দিয়ে থাকেন এমনকি পরীক্ষার হলেও উত্তর বলেদেন।
সদর উপজেলার বাইরের শিক্ষার্থীরাও শহরে প্রাইভেট ও কোচিং পড়তে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। জেলার রাজনগর ও কমলগঞ্জ উপজেলার অনেক শিক্ষার্থীকে শহরে থাকাতে দেখা যায়।
শহরে কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, আমাদের এমপিওভুক্ত কোন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকলে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি আমি মনে করি শিক্ষকরা অন্য স্কুলের ১০ জন শিক্ষার্থী পড়াতে পারবে এমন আইন সংশোধন করে শিক্ষকদরে সম্পূর্ণ কোচিং পড়ানো বন্ধ রাখা উচিত।
তবে শিক্ষা কর্মকর্তার এমন বক্তব্যে আশ্বস্ত নন মৌলভীবাজারের সচেতন নাগরিক মহল। তারা বলেন, কর্মকর্তাদের নাকের ডগায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ধারা পরিচালিত হচ্ছে অনেক কোচিং সেন্টার। দেখেও না দেখার বান করছেন কর্মকর্তারা।
মন্তব্য করুন