১৪ আগষ্ট ও একটি ফোনকল
সায়েক আহমদ॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকান উদ্দিন বীরপ্রতীক ১৯৫১ সালের ১৪ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার থোল্লাকান্দি গ্রামের বড়বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের ১৪ই নভেম্বর E.P.R G Signalman (Wireless operator) পদে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে বিদ্রোহ করে মেজর নওয়াজেশ উদ্দিনের নেতৃত্বে ৬নং সেক্টর, রংপুরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, রণকৌশল ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকার ফোরকানউদ্দিনকে “বীর প্রতীক” খেতাবে ভূষিত করেন।
ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিককে বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করার জন্য অনুরোধ করলে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন। তিনি বলেন ১৯৭৫ সালের ১৪ আগষ্ট তিনি বিডিআর (বিজিবি) সদরদপ্তর, পিলখানায় অবস্থান করছিলেন। তখন তিনি বিডিআর সিগন্যাল স্কুলের ইন্সট্রাক্টর পদে কর্মরত ছিলেন। ১৪ আগষ্ট বিকালবেলা সিগন্যাল সেন্টার থেকে একজন সিগন্যালম্যান এসে ফোরকানউদ্দিনকে বললেন, ‘আপনি তাড়াতাড়ি সিগন্যাল সেন্টারে আসেন। আপনার একটি জরুরী ফোনকল এসেছে।’
ফোরকানউদ্দিন দ্রুত সিগন্যাল সেন্টারে গিয়ে ফোন ধরলেন। হ্যালো বলতেই একজন কর্মকর্তা গোছের কেউ ফোরকানউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান, তুমি কি বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসার অবস্থান চেনো?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘জ্বী স্যার, চিনি।’
ওপ্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘তুমি কি সেখানে যেতে পারবে?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘জ্বী, স্যার। যেতে পারব। কিন্তু আমাকে এখান থেকে বের হতে হলে তো পাস লাগবে।’
একথা বলার পর ওপ্রান্ত থেকে লাইনটি কেটে দেয়া হল। ফোরকানউদ্দিন ভীষণ অবাক হলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোন ফোনকল না আসায় তিনি অন্য কাজে মন দিলেন।
১৫ আগষ্ট ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ফোরকানউদ্দিন ৩নং গেটের কাছে গিয়ে দেখলেন কামানবাহী গাড়ি দাঁড়ানো। কামানের মুখ বিডিআর সদর দপ্তরের গেটের দিকে নিশানা করে আছে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন অন্যান্য বিডিআর সদস্যরা ভীতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। সবার কাছ থেকে জানলেন পিলখানা সদর দপ্তরের ৫টি গেটেই একই অবস্থা।
সবাই দ্রুত বিডিআর মহাপরিচালককে বিষয়টি অবহিত করলেন। মহাপরিচালক সব শুনে বললেন, ‘তোমরা শান্ত থাকো।’
বিডিআর সদস্যদের মধ্যে অনেকেই খুবই উত্তেজিত। কেন সদরদপ্তরের দিকে কামান তাক করে আছে?
ইতোমধ্যে রেডিওর মাধ্যমে অনেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবরটি জেনে ফেলেছেন।
মহাপরিচালক বিষয়টি উপলব্ধি করে আবারো বললেন, ‘বিষয়টি আমরা দেখছি। আবারো বলছি তোমরা শান্ত থাকো। একটি রক্তপাতকে কেন্দ্র করে আরেকটি রক্তপাত ডেকে আনা ঠিক হবে না।’
আপাতত পরিস্থিতি শান্ত হল। তবে বিডিআর সদস্যরা অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যদি বাহির থেকে কোন মিছিল আসে, তবে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন। কিন্তু পরবর্তীতে সে ধরণের কোন কিছু না হওয়ায় বিডিআর সদস্যরা প্রচণ্ড হতাশ হয়েছিলেন।
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শুনে আমি খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুর সাথে আমি একবার দেখা করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে পুত্রস্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনি সরাসরি দেখা করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ।’
আমি বললাম, ‘তাহলে ঘটনাটি বলুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন বলতে শুরু করলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে সরাসরি দেখা করার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। দেশ স¦াধীন হওয়ার পর আমি আমার ভাবনাগুলো লিখতে থাকি। হঠাৎ আমার লেখাগুলো তৎকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশ উদ্দিনের নজরে পড়ে। আমি লিখেছিলাম দেশ আজ তিন দলে বিভক্ত। ক দলে আছে লোভী মুক্তিযোদ্ধা ও লোভী আওয়ামী লীগ নেতা/কর্মী। খ দলে আছে পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা/কর্মচারী ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এবং গ দলে আছে দেশপ্রেমিক সৎ মুক্তিযোদ্ধা ও সৎ আওয়ামী লীগ নেতা/কর্মী। ক ও খ দলের স্বার্থান্বেষীরা একজোট হয়ে গ দলকে চরম আঘাত করছে। নওয়াজেশ উদ্দিন সাহেব আমাকে উৎসাহিত করেন লেখালেখির জন্য। তাঁরই উৎসাহে আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে সরাসরি দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি আমাকে ও সুবেদার মাজহারুল হককে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’
আমি বিস্ময় গোপন না রেখেই বললাম, ‘এটা তো একটা বিরাট ঘটনা। বঙ্গবন্ধু কি আপনাদের সাথে দেখা করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথে দেখা করেছিলেন।’
আমি বললাম, ‘তাহলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার পর তাঁর সাথে কী কী কথাবার্তা হয়েছিল, তা একটু বলুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমাদেরকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোরা রংপুর থেকে এসেছিস? নওয়াজেশ আসেনি কেন?’
বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বুকটা ধড়াশ ধড়াশ করে কাঁপছিল। আমিও প্রচণ্ড নার্ভাস ছিলাম। সে অবস্থায়ও আমি সাহস করে আমার লিখিত ফাইলটি বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়ে বললাম, ‘উনি আমাদেরকে আপনার সাথে দেখা করার জন্য পাঠিয়েছেন।’
বঙ্গবন্ধু আমাকে শিশু ফোরকান মনে করলেন। আমি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা একথা তিনি মোটেই মনে আনেননি। আমার লেখা পড়ে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা তুই লিখেছিস?’
কাঁপতে কাঁপতে আমার মুখ দিয়ে শুধু একটি শব্দ বের হল, ‘জ্বী!’
বঙ্গবন্ধু আমার লেখাটি পড়ে ভরাট এবং গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তুই ছেলে মানুষ। এত সব ভাবনা কিসের? বাঙ্গালী বাঙ্গালীর শত্রু হতে পারে না।’
বঙ্গবন্ধুর কথার উত্তরে আমার মুখ দিয়ে আর কোন কথাই বের হল না। তবে বঙ্গবন্ধু আমাকে যেভাবে আদর-স্নেহ করেছেন, যেভাবে কথা বলেছেন, আমার কাছে মনে হয়েছে যেন তিনি একটি শিশুর সাথেই আদর করে কথা বলছেন। আসলে আমার বয়স ছিল তখন মাত্র ২২। আমার গঠন ছিল সদ্য-তরুণ একজন কিশোরের মত। আমার অনুভূতি ছিল, আমি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ত উনি তা মনেই করছেন না। আমার মনে হয়েছে আমি যেন আমার বাড়িতেই আছি। বঙ্গবন্ধু যেন আমার একজন পরম শ্রদ্ধেয় অভিভাবক। যতক্ষণ ছিলাম আদর আপ্যায়নে মনে হয়েছিল আমি বঙ্গবন্ধুর পরিবারেরই একজন সদস্য।
বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য আমরা সর্বমোট পাঁচজন গিয়েছিলাম। আসার সময় তিনি আমার হাতে সবার জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে বললেন, ‘তোর সাব-সেক্টর কমান্ডারকে বলিস আমার সাথে সে যেন দেখা করে।’
এতটুকু কথা বলে ফোরকানউদ্দিন একটু থামলেন। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরপর কি আর বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার দেখা হয়েছিল?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তরে বললেন, ‘না। তবে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছানোর জন্য আমার লেখা ১৪টি পয়েন্ট নিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক চিত্তরঞ্জন দত্ত বীর উত্তম।’
আমি বললাম, ‘সে ঘটনাটা একটু বলুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘বিডিআরের নিয়মিত দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন তৎকালীন মহাপরিচালক। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে লিখা আমার ১৪টি পয়েন্ট তুলে ধরেছিলাম। মহাপরিচালক মহোদয় আমার দেয়া ১৪টি পয়েন্ট ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করেন এবং প্রেসিডেন্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে দেখা হলে এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন।’
[সায়েক আহমদ, শিশু সাহিত্যিক, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক। ০১৭১২-৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন