১৭ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী: কাছে থেকে স্বাধীনতার মহানায়ককে দেখা ও স্মৃতি কথা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ সতোরোই মার্চ দুই হাজার একুশ সাল বাঙ্গাঁলি জাতীয়তা বাদী আন্দোলনের আপোষহীন জনক স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী। সতেরোই মার্চের সাপ্তাহান্তেই ছাব্বিশে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বৎসর পূর্তিতে জাতি এবার মহা সমারোহে জাক জমকের সাথে স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তি উৎসব উদ্যাপন করছেন। মুজিব বর্ষে স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তি একটি স্বতন্ত্র আবেগ ও আবাহ সৃষ্টি করেছে। ভয়াবহ বৈশ্বিক ব্যাধি কোভিড নাইনটিন-করনার মাঝে ও আড়ম্ভর ও আন্তরিকতার সাথে জাতীয় ভাবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গাঁলি বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদ্যাপনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় কমিটি এ ব্যাপারে খুবই তৎপর ও আন্তরিক।
বঙ্গঁবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে মিডিয়া-গন মাধ্যম সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। পৃন্ট মিডিয়ায় বঙ্গঁবন্ধুর কর্ম ও জীবন দর্শন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা, কবিতা, স্মৃতি কথা প্রকাশিত হচ্ছে। হাল আমলে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আমাদের মিডিয়া ভূবনে পূর্ণতা এনেছে-শান শওকত-মান মর্য্যাদা-সৌকর্য্য ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার টক শো- আলোচনা-সাক্ষাতকার সমূহ সত্যিকার অর্থেই শিক্ষনীয়। বেতার ও আমার প্রিয় গণ মাধ্যম। ষাটের দশকে রেডিও সিলোন এর হিন্দি এবং আকাশ বানীর আধুনিক বাংলা গান গুনতাম। একাত্তোরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বৈশ্বিক ভাবে বেতারের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। নব্বইর দশকে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক ছিলেন আমার কবি বন্ধু জাফর আহমদ চৌধুরী। শাহবাগে তাঁর দপ্তরে আপেল মাহমুদ হানিফ সংকেত সহ বৈকালিক আড্ডা-আসর ছিল উপভোগ্য। কুলাউড়ার প্রবীন সাংবাদিক বাবু সুশীল সেন গুপ্ত ইতি পূর্বে একদিন প্রস্তাব দিলেন আমি সম্মত হলে সিলেট বেতার বঙ্গঁবন্ধু বিষয়ক আমার একটি সাক্ষাতকার নিতে চান।
বঙ্গঁবন্ধু বিষয়ক সাক্ষাতকার আমার মত একজন মফস্বলি অভাজনের নারাজ হওয়ার কোন কারণ নেই-বরং আমি নিজেকে গৌরবান্বিত ও সম্মানিত বোধ করলাম। ইতিপূর্বে আমার লেখক বন্ধু শামসুল করিম কয়েস সিলেট বেতারে চাকরি করতেন। তৎপূর্বে আহমদ জামান সাহেব আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্ব পালন কালে আমি সিলেট বেতারের সাহিত্যানুষ্টানে অংশ গ্রহণ করেছি। সিলেট বিতারে আমার লেখা নাটক ও প্রচারিত হয়েছে। শ্রীযুক্ত সেন গুপ্তের স্বর্গীয়া সহ ধর্ম্মিনী সিলেট বেতারের শিল্পী ছিলেন। সিলেট বেতার কর্তৃপক্ষের সঙ্গেঁ কথাবার্তা বলে দিনক্ষন ঠিক করলেও দূঃখ জনক ভাবে তারা কেউই আসেন নি।
স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ভোদ্ধ ত্রিশ চল্লিশোর্ধ বর্তমান মেধাবী প্রজন্ম-বিশেষতঃ সংবাদ কর্মি-সাংবাদিক-লেখক-গবেষক গন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গঁবন্ধুর কর্ম ও জীবন দর্শন প্রসঙ্গেঁ বিষদ-ব্যাপক ভাবে জানতে উৎসাহী। দেশ ও জাতির প্রকৃত ইতিহাস-সত্যানু সন্ধান একটি শক্তিশালী জাতি গঠন ও জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে মুক্ত বুদ্ধির চর্চার বিকল্প নেই বলে বর্তমান জ্ঞান পিপাসু মেধাবী প্রজন্ম মনে করেন।
বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবের মত বড় মাপের বিশাল মানুষের কর্ম ও জীবন দর্শন নিয়ে শত শত পুস্তক রচনা করা যায়, রচিত হচ্ছে ও কিন্তু তাঁকে নিয়ে স্মৃতি কথা- কাছে থেকে তাঁকে যেমন দেখেছি-জাতীয় স্মৃতি কথা লেখা খুবই কঠিন ও জটিল কাজ। সেটা বঙ্গঁবন্ধুর সহকর্মিদের পক্ষেই লেখা সম্ভব, কিন্তু পঁচাত্তোরের পনেরোই আগষ্ট সেনা অভ্যোত্থানে বঙ্গঁবন্ধু সপরিবারে তার মন্ত্রী সভা ও পরিবারের একাধিক সদস্য সহ সপরিবারের নির্মম ভাবে নিহত হন। তৎপরবর্তী কালে বার্ধক্য জনিত কারনে বঙ্গঁবন্ধুর সহকর্মি সহযোগিদের স্বাভাবিক মৃত্যোর পর তাঁর স্নেহ ধন্য সহকর্মিদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, বিশেষ করে বঙ্গঁবন্ধুর প্রিয় দল আওয়ামী লীগে।
গন্ড গ্রামে জন্ম নেয়া মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আমি। রসুলপুর থেকে ফরিদপুর-অনেক দুর। রাজনৈতিক কারন ছাড়া তাঁকে কাছে থেকে কথা বলা, ভক্ত, অনুরাগি হওয়ার উপায় ছিল না। গোল বাটা মুখ, আকর্ষনীয় পূরুষালি গোঁফ, ব্যাক ব্রাশ করা বাবরি চুল উজ্জল ফর্সা চেহারার, দীর্ঘদেহী সুঠাম শরীরের বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব একজন আকর্ষনীয় ব্যক্তি। হামেশা পাজামা পাঞ্জাবি মুজিব কোর্ট পরিহিত বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবের মুখে একটি মিষ্টি হাসি লেগে থাকত সব সময়। উজ্জল ফর্সা চেহারার মাঝে মুখ মন্ডলের কালো গোল তিল-আঁচিলটি মুখ মন্ডলের সৌন্দর্য্য ও আকর্ষন বাড়িয়ে দিয়ে ছিল।
বাষট্টি সালে মেট্টিক কেনডি ডেইট ছিলাম। আমরাই ছিলাম শেষ ব্যাচ। এরপর শুরু হয় এস.এস.সি. প্রথা। বাষট্টি সালে কুখ্যাত হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলনে ছাত্র হত্যার বিচার চাই বলে সেই যে রাস্তায় নেমেছিলাম, শ্লোগান ধরেছিলাম দিয়ে ছিলাম প্রায় ষাট্ট বছর পর সম্প্রতি মিছিল থেকে অবসর নিয়েছি। মাইক আর মিছিলের প্রতি আমার এক ধরনের মোহ ও মায়া ছিল। হাল আমলে মোহ আর নেই। মায়া মনে হয় এখন ও আছে। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় আমি লেখাপড়ার সাথে সাথে খেলা, লেখা, গান বাজনা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও সমাজ কর্মে সম্পৃক্ত ছিলাম। বাংলা ও বাঙ্গাঁলি প্রেমী ছিলাম। বাল্য-কৈশোর কালেই বাংলা ও বাঙ্গাঁলির স্বার্থ সংরক্ষন কারি নেতা হিসাবে বঙ্গঁ শার্দুল শেখ মুজিবের নাম শুনে আসছি তার কাজ ও আমাদের পসন্দ হত। তখন ছাত্র সংঘটন ছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। বাংলা ও বাঙ্গাঁলি এবং শেখ মুজিবের আপোষহীন নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমি ছাত্রলীগে যোগদান করি।
ছাত্র নেতা দেওয়ান নূরুল হোসেন চঞ্চল এবং আখতার আহমদ এবং ঢাকায় সিরাজুল আলম খাঁন, আশম রব ও আমাকে প্রভাবান্বিত করেন। আমার দীর্ঘদেহ ঝাকরা বাবরি চুল, বিশাল গোঁফ অসীম সাহস, উচ্চ কন্ঠে শ্লোগান ও অনল বর্ষী ভাষন সকলের নযর কাড়ত। ঢাকা ও সিলেটের ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে আমার সু-সম্পর্ক হয়ে যায়। ষাটের দশকের শুরুতে আমি মৌলভীবাজার কলেজ শাখা, অতঃপর মহকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হই। তখন নিয়মিত ছাত্রলীগের সম্মেলন হত। ঢাকায় সম্মেলনে যেতাম। তৎকালীন ইকবাল হলের মাঠে ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে বঙ্গঁবন্ধুকে দেখলাম। তাঁর বক্তৃতা শুনলাম। ষাটের দশকে এভডো ও প্রডোর কারনে দেশে কোন রাজনৈতিক দল বিকশিত হতে পারে নি। পাকিস্তানী ক্ষমতা লিপ্সু আমলাতন্ত্র ও সামরীক জান্টা গনতন্ত্র ও আইনের শাসনকে বুট চাপা দিয়ে দেশে ডান্ডাতন্ত্র ক্যায়েম করে। বাংলা ও বাঙ্গাঁলির দরদি ও বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গাঁলি জাতীয়তা বাদী আন্দোলনকে ধাপে ধাপে সংঘটিত করতঃ এগিয়ে নিয়ে যাবতীয় জেল ঝুলুমকে উপেক্ষা করে ছয়ষট্টি সালে বাঙ্গাঁলির মুক্তি সনদ ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্ম্মসূচী ঘোষনা করেন। এ সময় মৌলভীবাজারে আওয়ামী লীগের সাংঘটনিক কার্য্যক্রম ছিল না, হাতে গুনা দুই চারজন সমর্থক ছিলেন মাত্র। হিন্দু সমাজের মধ্যে দুই তিনজন আওয়ামী লীগ সমর্থক থাকলেও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ এর কতেক গুন্ডা এবং পান্ডা বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না।
তখন ছাত্র লীগ ছাড়া আওয়ামী লীগের এখনকার মত এত অঙ্গঁ কিংবা সহযোগী সংঘটন ছিল না। ফলতঃ ছাত্রলীগকেই একক ভাবে আন্দোলনে-সংগ্রামে দায়িত্ব পালন করতে হত। তবে বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে বঙ্গঁবন্ধুর স্নেহধন্য নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিবিদ দেওয়ান ফরিদ গাজি আওয়ামী লীগ সংঘটন ও ছয়দফা প্রচারে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমি তখনই সক্রিয় সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলাম। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাবেক সাধারন সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি তার সম্পাদনায় বের করেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংবাদপত্র বাংলার বানী। পত্রিকাটি প্রথমে সাপ্তাহিক ছিল। আমি বাংলার বানীর স্থানীয় প্রতিনিধি এবং অতঃপর দৈনিক বাংলার বানীর প্রতিবেদক ছিলাম। তখন আওয়ামী লীগ এর অফিস ছিল পুরানা পল্টনে। নিচ তালায় বাংলার বানীর অফিস। উপরে সমগ্র বাড়ি জুড়ে আওয়ামী লীগ অফিসে এক বিকালে মনি ভাইর বদৌলতে প্রথম শেখ মুজিবের মুখোমুখি হই। তখন ভাড়া করা এই বাড়ীতে লোকজনের এত আনাগুনা ছিল না। নেতা তাঁর নির্ধারিত কক্ষে বসতেন। এমন আহামরি সাজ সজ্জা নয়, সাধারন চেয়ার টেবিল। তখন বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব চেক মুজিব কোট পরিধান করতেন। আমার দেখা ও সাক্ষাত ছিল সাদা মাঠা। সহজ সরল ভাবে সস্নেহে কথা বল্লেন, আস্কর উল্লা ও আজিজ বেগ সাহেবের খবর নিলেন। প্রসঙ্গঁত উল্লেখ যোগ্য কর্মি বান্ধব নেতা বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর দলীয় কর্মিদেরকে সহোদর-সন্তানের মত স্নেহ মমতা করতেন, অনেকের নাম জানতেন। তাঁর নামে আমার নাম জেনে খুশী হলেন। আওয়ামী লীগ সংঘটক মির্জা আজিজ আহমদ বেগ এর চৌমুহনায় একটি ষ্টেশনারি দোকান এবং আস্কর উল্লাহর মুসলিম হেয়ার কাটিং সেলুন নামে একটি সেলুন ছিল। তারা দু’জনেই নিবেদিত প্রাণ আওয়ামী লীগ কর্মি ছিলেন। ঢাকায় বঙ্গঁবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই এর বেশ পরে তাঁর বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে-ধান মন্ডিতে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের বর্ধিত সভা ছিল নিউ মার্কেট ৪২, বলাকা ভবনে। আমি তখন মহকুমা ছাত্র লীগের সভাপতি আ.খ.সুজাউল করিম সেক্রেটারি। সিলেট জেলা ছাত্র লীগ এর সভাপতি সম্পাদক যথাক্রমে সদর উদ্দিন চৌধুরী এবং মকসুদ ইবনে আজিজ লামা। দু’জনেই অনল বর্ষীবক্তা। বর্ধিত সভায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সকল সভাপতি সম্পাদক স্বাধীন সমাজতান্ত্রীক পূর্ব পাকিস্তান এর পক্ষে প্রস্তাব পাশের জ্বালাময়ী ভাষন দেন। আমি নিজেও। ছাত্রলীগের একটি ক্ষুদ্রাংশ অখন্ড পাকিন্তান পহ্ণী ছিলেন। জগন্নাত কলেজ ছাত্র লীগের নেতা দীর্ঘ ও বিশাল দেহী এম.এ. রেজা তার বাহিনী নিয়ে স্বাধীনতা পহ্ণীদেরকে ভয় ভীতি প্রদর্শন করতঃ শোডাউন করেন। তুমুল সংঘর্ষ এড়াতে চূড়ান্ত ফয়সলার জন্য জন্য বত্রিশ নম্বরের বঙ্গঁবন্ধুর বাড়ি যেতে উভয় পক্ষ সম্মতি জানালে পায়ে হেঁটেই গভীর রাত্রে বত্রিশ নম্বরে রওয়ানা হলেন। নীচ তলার ড্রাইং রুম খুলে দেয়া হল। আমাদের নেতৃবৃন্দের সাথে আমার সু-সম্পর্কের সুবাদে আমি ও পিছু পিছু ছুটলাম। সাদা হাত কাটা সেন্ডো গেঞ্জি, আকাশী রং এর হাফ হাতা হাওয়াই সার্ট হাতে তার প্রিয় পাইপ সহ বঙ্গঁবন্ধু নেমে এলেন। ঘুম থেকে উঠে এলে ও তাঁর চেহারায় বিন্দু মাত্র বিরক্তির চিহ্ন নেই। নেতাদের পিছে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ফর্সা চেহারার হালকা পাতলা শেখ কামাল ও উপর থেকে নেমে এলেন। ধৈর্য্য সহকারে বঙ্গঁবন্ধু নেতাদের বক্তব্য শুনলেন। চীর কালের সাহসী নেতা আশম রব রেজা বাহিনীর বে-আদবির বিচার চাইলেন। ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, ডাকসুর ভিপি জি.এস উৎসাহী মফস্বল ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব যে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিলেন পঞ্চাশ বৎসর পর এখন ও আমার কানে বাজে। একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী, একজন রাজনীতিবিদ, একটি জাতির জনক হিসাবে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন তা ছিল ঐতিহাসিক-সঠিক-যৌক্তিক। তিনি বলেছিলেন ছাত্র সমাজের বাংলার স্বাধীনতার দাবীর সঙ্গেঁ তিনি নীতি গত ভাবে দ্বিমত পোষন করেন না, কিন্তু নির্বাচন না হলে, ছয় দফার মেন্ডেট না পেলে বিশ্ববাসির কাছে তিনি বিচ্ছিন্নতা বাদি নেতা হিসাবে পরিচিত হবেন, গন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। তাই আগে জাতির মেনডেট দরকার-জনরায় প্রয়োজন। প্রসঙ্গঁত উল্লেখ্য বঙ্গঁবন্ধু সত্তোরের সাধারন নির্বাচনকে ছয়দফার রেফারেন্ডাম হিসাবে ঘোষনা করে ছিলেন। বঙ্গঁবন্ধু শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন নির্ব্বাচন হলেই জাতি তাঁর পক্ষে রায় দেবেন। বঙ্গঁবন্ধুর আবেগময় যুক্তি পূর্ন যৌক্তিক বক্তব্য ছাত্রলীগের বিবাদ মান গ্রুপ হাসি মুখে মেনে নিলেন। ছাত্র লীগের বর্ধিত সভাটি মূলতবি ঘোষনা করা হল। আর সেই মূলতবি সভা অনুষ্টিত হয় নি, তাঁর প্রয়োজন হয়নি।
আমার প্রিয়, জন্ম ও কর্ম ভূমি মৌলভীবাজারে ও তাঁকে দেখেছি এখানে তিনি এসেছেন একাধিক বার, অর্ধশত বৎসর পর তার দিন তারিখ আর আমার স্মরন নেই। ষাটের দশকে সাংঘটনিক সফরে এখানে শাহ মোস্তফা সড়কস্থ লালটিনের বাংলার রেষ্ট হাউসে উঠেছিলেন, সভা করেছিলেন তৎকালীন জিন্নাহ হলে। লোক সংখ্যা ছিল খুবই কম। এখান থেকে সিলেটে দেওয়ান ফরিদ গাজি সাহেবের বাসা শেখ ঘাট চলে যান, তখন এই শহরে এত গাড়ী, মোটর সাইকেল ছিল না, একটি উইলিস জিপে চড়ে তিন সিলেট যান। কোন প্রটকল, নিরাপত্তা কর্মি, গাড়ি বহর ছিল না। বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব এই নিরুত্তাপ সভা, আড়ম্বর হীন অর্ভ্যথনা নিস্প্রান আপ্যায়নেও নাখোশ, নারাজ হন নি-উস্মা প্রকাশ করেন নি, ক্ষুদ্র হাসি উপহার দিয়ে ঔ দার্য্য দেখিয়েছেন রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সহমর্মিতা দেখিয়েছেন। আমি জীপ এর পিছে উঠে গাজী ভাইর বাসা সিলেট-শেখ ঘাটে যাই। সেখানে মিটিং-জন সমাবেশ ছিল। সত্তোরের সাধারন নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব এসেছিলেন মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সেদিন মাঠ নয় সারা শহরই ছিল লোকে লোকারন্য।
ছাত্রলীগ সভাপতি হিসাবে আমি সেই সভা মঞ্চে উঠেছিলাম। বক্তৃতা দিয়ে ছিলাম। আমার এখনও মনে আছে, বঙ্গঁবুন্ধ বলেছিলেন নৌকায় ইলিয়াস-আজিজকে ভোট দিলে আমি পাব-আমাকে নৌকা মার্কায় ভোট দিন। জেলার জনগন তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সবকটি আসনেই তাঁর প্রার্থীগণকে বিজয়ী করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে একবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব হেলিকপ্টার যুগে মৌলভীবাজার এসে ছিলেন। স্থানীয় আনসার ফিল্ডে, বক্তৃতা দিয়েছিলেন। হেলিকপ্টারে তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদ এবং প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা। তখন মঞ্চে উঠা, বসা এবং শ্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ এর মধ্যে উত্তেজনা-সৃষ্টি হয়। শ্লোগান পাল্টা শ্লোগান হতে থাকে। আমি মঞ্চে উঠে ছিলাম-আমাকে কেউ আটকায় নি, শ্লোগান-পাল্টা শ্লোগান ও বিশৃংঙ্খলার মাঝে বঙ্গঁবন্ধু ইংরেজীতে বলে ছিলেন-মাই মিটিং ইজ মাই মিটিং তিনি বিশৃংঙ্খলা ও পাল্টা শ্লোগান পসন্দ করেন নি। তাঁর অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ও আওয়াজে সভায় নিরবতা নেমে আসে। শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটিং সমাপ্ত হয়। পরদিন ভাষানী পহ্ণী ঢাকাই পত্রিকা হক কথা সংবাদ ছেপেছিলেন-বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ইংরেজী ঘোষনা।
এই ভাবে দুরে থেকে কাছে থেকে দেখে তার মূল্যবান কথা শুনে বঙ্গঁবন্ধুর মত বড় মাপের উচ্চ পর্য্যায়ের নেতার কর্ম ও জীবন দর্শনের যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব নয়, সেই ক্ষমতা, যোগ্যতা ও আমার-আমাদের নাই। তাঁর সংগ্রামী কর্ম ও জীবন দর্শন বলে, বাংলা ও বাঙ্গাঁলির সংগ্রামী ইতিহাসে প্রমান মিলে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব একজন নিখাঁদ দেশ প্রেমিক, সাচ্চা গনতন্ত্রী, দেশ ও জনদরদি, কর্মি বৎসল, বড় মনের বড় মাপের নেতা ছিলেন। উপমহাদেশের তিনজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ গনতন্ত্রের মানষ পুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আফ্রো এশিয়ার মেহনতি মানুষের মুক্তি দূত মৌলানা আব্দুল হামদ খাঁন ভাষানী, লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক বাংলার বাঘ-শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এর সময় কালে বঙ্গঁবন্ধুর রেড়ে উঠা, তিনি তাঁদের কনিষ্ট ছিলেন, তাঁরা তাঁর বয়ো: জ্যেষ্ট ছিলেন, তিনি তাঁদের স্নেহধন্য ছিলেন। নেতৃত্বের দৌড়ে, সময়ের দাবীতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কারনে বঙ্গঁবন্ধু তাঁর অতুলনীয় দেশ প্রেম, সাংঘটনিক দক্ষতা, বাগ্মিতা, কর্মি বাৎসল্য, ত্যাগ তিতিক্ষা, সর্ব্বোপরি তাঁর ক্যারিস মাটিক ব্যক্তিত্বের কারনে টুঙ্গিঁ পাড়ার খোকা, শেখ লুৎফুর রহমান এর প্রিয় পুত্র জাতির পিতা এক ও অদ্বিতীয় নেতা হয়েছেন, বঙ্গঁবন্ধু হয়ে স্বাধীনতার মহান স্থপতি হিসাবে দেশ-বিদেশে খ্যাতিও স্বীকৃতি পেয়েছেন। আন্দোলনের নেতা বঙ্গঁবন্ধু, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, শোষন হীন সোনার বাংলা, গনতন্ত্র ও আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ও সুশাসন। তাঁর সরকারামলে বাহাত্তোর সালের সংবিধানে জনগনের এসব মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকলেও তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা কঠোর ভাবে দল ও দেশের দায়িত্ব ভার নিয়ে উন্নয়নের মহা সড়কে এসে, দেশীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাঝে ও দূর্নীতি ও দুঃশাসনে, কাউয়া ও পাপিয়া কালচারের জোয়ারে সবই প্রশ্নবিদ্ধ ম্লান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নেত্রী শেখ হাসিনার-দূর্নীতিকে জিরো টলারেন্স এর ঘোষনা দেশবাসী কর্তৃক প্রশংসিত নন্দিত হলেও দূর্নীতিবাজ-অর্থ লুন্ঠন-পাচারকারি পি.কে.হালদাররা এখনও প্রশান্তিতেই আছেন। দূর্নীতি নির্মূল নয় নিয়ন্ত্রিতই হয় নি। বঙ্গঁবন্ধুর স্বপ্নের-সোনার বাংলা-গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই-কারন কাঁঠালের আমস্বত্ব-এবং সোনার পাথর বাটি হয় না। বঙ্গঁবন্ধু স্বয়ং দূর্নীতিবাজ ও চাটার দলের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন। আমি একজন সত্তরোর্ধ অসুস্থ বয়োঃ বৃদ্ধ হলেও স্মৃতি শক্তি এখনও প্রতারনা করেনি বরং প্রখরই আছে। এ রচনা আমার স্মৃতি থেকে লেখা হলেও অসত্য নয়-অসম্পূর্ণতা থাকতে পারে। বর্ত্তমান প্রজন্মের দাবীতে “আমার দেখা বঙ্গঁবন্ধু” কিছু অলিখিত কথা ও কাহিনী সবিনয়ে প্রকাশ করলাম।
বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকীতে-স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তিতে তাঁর উজ্জল স্মৃতির প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি, পচাত্তোরের পনেরোই আগষ্টের জঘন্যতম সেনা অভ্যোত্থানে শাহাদাত বরণ কারি তাঁর পরিবার সদস্য বর্গের ও রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তিতে একাত্তোরের অকুত ভয় বীরদেরকে সালাম জানাই, অমর শহীদানগণকে স্মরন করি সশ্রদ্ধচিত্তে। মহান মালিক তাঁদের বেহেশত নসিব করুন-এই মোনাজাত সহ-আমিন।
[ষাটের দশকের সাংবাদিক ও ছাত্র লীগ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা। সিনিওর এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব ও জেলা আইনজীবী সমিতি।]
মন্তব্য করুন