১৯৭১ এর এই দিনে ২৮ মার্চ বৃহত্তর সিলেটের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয় কমলগঞ্জের শমশেরনগর থেকে ॥ এক ক্যাপ্টেনসহ ৯জন পাকা সেনাকে হত্যা করে প্রতিরোধকারী মুক্তি পাগল বাঙ্গালীরা

March 27, 2017,

কমলগঞ্জ প্রতিনিধি॥ ১৯৭১ সালের হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনির একটি দল ২৭ মার্চ বিকালে অতর্কিতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরে এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মিছিলকারী বাঙ্গালীদের হামলা চালায়। এসময় মানুষজন দৌড়ে পালিয়ে গেলেও ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ যাদুকর সিরাজুল ইসলাম কলার ছিলায় পা ফসকে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তখনই পাক সেনারা তাাঁর উপর ঝাপিয়ে পড়ে ব্যয়নট নিয়ে খুচিয়ে ও পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। জবাবে পরদিন ২৮ মার্চ স্থানীয় মুক্তি পাগল প্রতিরোধকারী বাঙ্গালীলা পরিকিল্পত হামলা চালিয়ে একজন ক্যাপ্টেনসহ নয়জন পাক সেনাকে হত্যা করেছিল। ২৮ মার্চ থেকেই বৃহত্তর সিলেটের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয় কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর থেকে।
১৯৭১ সালেল ২৭ মার্চ পাকবাহিনীর অতর্কিত হামলার সময় একজন বয়ষ্ক লোককে নির্মম এ হত্যার ঘটনায় রাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ও মুক্তি পাগল মানুষজন পরিকল্পিত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেন। স্থানীয় আওয়ামলীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফুর, মোজাহিদ ক্যাপ্টেন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান, মোজাহিদ ক্যাপ্টেন মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ, স্থানীয় ছাত্রনেতাসহ যুবকদের নিয়ে শমশেরনগর বাজারের তিনটি দালানে অ্যাম্বুশ স্থাপন করে পরিকল্পিত হামলার চিন্তা করেন। সেই হিসাবে প্রতিরোধকারী বাঙ্গালীরা মরহুম আমজাদ আলী ও মরহুম হাজী সজ্জাদুর রহমানের পিক আপ নিয়ে চাতলাপুর সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে ইপিআরের (বর্তমান বিজিবি) অস্ত্রসহ বাঙ্গালী সদস্যদের নিয়ে ও স্থানীয় লাইসেন্সধারী বন্দুক নিয়ে স্থানীয় গঙগারাম তেলীর দোতলা, স্টেশন রোডের আমান উল্যার দোতলা ও বর্তমান পুলিশ ফাড়ির দোতলায় তিনটি শক্ত এ্যাম্বুশ করা হয়। শমশেরনগর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় সড়কের উপর খালি মালগাড়ির একটি বগি রেখেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল।


২৮ মার্চ বিকাল তিনটার দিকে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলসহ একটি পিক আপে পাক সেনা বাহিনীর একটি দল শমশেরনগর হয়ে ভানুগাছ গিয়ে সন্ধ্যায় ফেরার পথে শমশেরনগরে প্রবেশ করলে তিনটি এ্যম্বুশ থেকে আচমকা এক সাথে গুলি ছোড়লে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলসহ ঘটনাস্থলেই ৯জন পাক সেনা মারা যায়। দুইজন পালিয়ে একটি বাসায় আত্ম গোপন করলে সেখান থেকে ধরে এনে মুক্তি পাগল বিক্ষোব্দ বাঙ্গালীরা তাদের হত্যা করে। এ ঘটনার পর পাক সেনারা শমশেরনগর সরকারী ডাক বাংলোয় একটি শক্ত ঘাটি স্থাপন করে। আর প্রতিরোধ আন্দোলনকারীরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরায় প্রবেশ করেন।
পরবর্তীতে স্থানীয় রাজাকার আল বদর, আল শামস ও মুসলিম লীগ নেতাদের প্রধান আরিফ মুন্সী ও তার হুকুম পালনকারী কামিল মিয়া চৌকিদারের সহায়তায় পাক সেনারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাড়ি থেকে নিরস্ত্র নিরিহ বাঙ্গালীদের ধরে এনে ডাক বাংলোর সামনের বট গাছের ডালে ঝুলিয়ে ও একটি নির্যাতন কক্ষে শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে পরে শমশেরনগর বিমান বন্দরের রানওয়ের উত্তর পশ্চিম কোণের বধ্যভূমিকে গুলি করে হত্যা করে।
পাক সেনারা সোনাপুর গ্রামের প্রতাপ পাল পিযুষ পাল, ঘোষপুর গ্রামের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা মোবাশ্বির আলী, কৃষ্ণপুর গ্রামের আওয়ামলীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আব্দুল গফুরের বাবা আব্দুল গনি, দুই ভাই আব্দুস শুকুর, আব্দুন নুর, শ্রীসূর্য্য গ্রামের রমেশ চন্দ্র দাস, যোগেশ চন্দ্র দাস, কৃপেশ রঞ্জন দত্ত, পতনউষারের আপ্তাব খান, আখতার খান, কেছুলুটি গ্রামের রুস্তুম আলী, রামপুরের খোকা মল্লিক ও পাখি মল্লিকসহ চৈত্রঘাট, মুন্সীবাজার, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরিহ অসংখ্য বাঙ্গালীকে শমশেরনগর বধ্যভূমিতে হত্যা করেছিল।
২৮ মার্চ শমশেরনগর প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা খালেকুর রহমান বলেন, সে সময়ের আন্দোলন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাদের কাঁঠের দোতলা ঘর ইরফান কুটির। তাছাড়া বাবা হাজী সজ্জাদুর রহমান পিক আপ দিয়ে চাতলাপুর সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে অস্ত্রসহ বাঙ্গালী ইপিআর সদস্যদের এনেছিলেন। রাজাকার প্রধান ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আরিফ মুন্সী তাদের পরিবারের সবার নাম পাক সেনাদের হাতে তুলে দিলে বাধ্য হয়ে স্বপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ায় পাক সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
শমশেরনগর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হাই বলেন, ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশে সর্ব প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে শমশেরনগরে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯জন পাক সেনাকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করেছিল। যাহা ছিল বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের উপর প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন। তার জবাবেই পরবর্তীতে স্থানীয় রাজাকার, আল বদর ও আল শামসের সহায়তায় পাক সেনারা বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে নিরিহ মানুষজনকে ধরে এনে ডাকবাংলোর বট গাছে ও নির্যাতন কক্ষে নির্যাতন করে পরে বিমান বন্দরের বধ্যভূমিতে হত্যা করেছে। আসলে সঠিক হিসাব আজও করা যায়নি। তবে অসংখ্য বাঙ্গালীকে পাক সেনারা শমশেরনগর বিমান বন্দরের বধ্য ভূমিতে হত্যা করেছে। সেই স্বীকৃতি হিসাবে বাংলাদেশ সরকার শমশেরনগরে একটি বধ্যভূমি স্মৃতি সৌধ ও সারা দেশে সম্মুখ সমরের স্মৃতি স্বরুপ একটি স্মৃতিসৌধ শমশেরনগর বিমান বন্দর এলাকায় স্থাপন করেছেন।
পতনউষার ইউনিয়নের শ্রীসূর্য্য গ্রামের শহীদ যোগেশ চন্দ্র দাসের ছেলে নারায়ন দাস বলেন, তাদের গ্রামের রাজাকার খলিলুর রহমানের ঈশারায় পাক সেনারা এপ্রিল মাসের এক রাতে বাবা, কাকাসহ অনেককেই ধরে নিয়ে ডাক বাংলোয় আটিকয়ে কয়েক দিন নির্যাতন করেছে। পরে বিমান বন্দরের রানওয়ের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করেছে।
সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী সতিঝির গাঁও গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান বলেন, দূর থেকে দেখেছেন প্রতিদিনই কোন না কোন গ্রাম থেকে নিরিহ বাঙ্গালীদের ধরে এনে শমশেরনগর ডাক বাংলোর নির্যাতন কক্ষে ও বটগাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করেছে পাক সেনারা। পরে নির্যাতিতদের হাত পা ও চোখ বেঁধে জিপে তুলে বিমান বন্দরের রানওয়েতে নিয়ে গেছে। দূর থেকে শুধুই গুলির শব্দ শুনতেন। ভয়ে কেউ গিয়ে আর লাশে কোন খবর করতে পারেনি।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শমশেরনগর ডাক বাংলোয় পাক সেনাদের একটি শক্ত ঘাটি স্থাপন করে বটগাছে ঝুলিয়ে ও একটি নির্যাতন কক্ষে ধরে আনা নিরিহ বাঙ্গালীদের শারীরিক নির্যাতন করতো। নির্যাতনের পর শমশেরনগর বিমান বন্দরের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ৪৫ বছর ধরে নিরব স্বাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে শমশেরনগর ডাক বাংলো আর দেড় শতাধিক বছর বয়সী মহিরুহ বট গাছটি।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com