২রা জুলাই-সুবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বৃটিশ বিরোধী বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ বাংলা ও বাঙ্গাঁলির জাতীয় বীর শহীদ সিরাজুদ্দৌলার শাহাদাত বার্ষিকীঃ শ্রদ্ধাঞ্জলী
মুজিবুর রহমান মুজিব : অভিভক্ত ভারতবর্ষ-সুবে বাংলা-প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ-সভ্য জনপদ। ভারত-বাংলার অফুরান প্রাকৃতিক ধন সম্পদ এবং অপরূপ নিসর্গে আকৃষ্ট হয়ে যুগে যুগে এ দেশে এসেছেন বহু বিদেশী জাতি-উপজাতি-পর্য্যটক বনিকের দল। বিশ^বিখ্যাত বৃটিশ ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মিথ (ঠ.ঝসরঃয) প্রাচীনভারত বর্ষকে নৃতাত্বিক যাদুশালা-বলে অভিমত ব্যাক্ত করেছেন। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত যথার্থই প্রনিধান যোগ্য। প্রাচীন বাংলা প্রসঙ্গেঁ কবি বলেন-
“হেথা আর্য্য হেথা অনার্য্য
হেথা দ্রাবিড় চীন।
শকহুন দল পাঠান মুঘল
একদেহে হল লীন।”
বাংলা-বিহার-উড়িস্যা-সুবে বাংলার মধ্য যুগীয় শাসক নবাব আলীবর্দী খাঁ একজন বীর যোদ্ধা ও প্রজা বৎসল নৃপতি ছিলেন। এই বীর যোদ্ধাকে কর্ম্মজীবনের বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ ক্ষেত্রেই কাটাতে হয়েছে। মারাঠা দস্যু, বর্গী, ভাস্কর পন্ডিতের রোশানল ও হামলাকে দূঃসাহসের সঙ্গেঁ মোকাবিলা করেছেন প্রজা বৎসল নবাব আলীবর্দ্দী। কঠোর হস্তে বিদেশী আক্রমনকারি গনকে পরাজিত-বিতাড়িত-নিশ্চিহ্ন করে সুবে বাংলায় শান্তি প্রতিষ্টা করেছেন বাংলার নবাব আলী বর্দ্দী খাঁ। বাংলার নবাব আলীবর্দ্দি ছিলেন-অপুত্রক-তিন কন্যা সন্তানের জনক। বাংলার নবাব তাঁর প্রিয় প্রজা সাধারনকে নিজ সন্তানের মতই মনে করতেন। কন্যা আমিনা বেগমের প্রথমপুত্র মির্জা মুহাম্মদ সিরাজুদ্দৌলা-প্রিয় দৌহিত্র কে পুত্রের মত ¯েœহ করতেন বাংলার নবাব। সিরাজকেই দত্তক নিয়ে যুদ্ধ বিদ্যা, রাজ্য শাসন-রাজ্য পরিচালনায় শিক্ষা দিয়ে যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে গড়ে তুলছিলেন। এ সময় ইরাকের নযফ থেকে ভাগ্যান্বেসী হাভাতে পরিবারকে আশ্রয় এবং সুদর্শন ও বিনয়ী মোঃ জাফর আলীকে একশত টাকা বেতনে উমেদারের চাকরি দিলেন জনদরদি নবাব আলীবর্দ্দী। জাফর আলীর বিনয়াচরনে বিমুগ্ধ হয়ে বড় মন ও বড় মাফের মানুষ আলী বর্দী খাঁ তাঁর বৈমাত্রেয় ভগ্নি শাহী খানমকে মোঃ জাফর আলীর সঙ্গেঁ শাদীদেন। নযফি সৈয়দ বলে কথিত মোঃ জাফর আলীর পারিবারিক পদবী ছিল মীর। বাংলা ও বাঙ্গাঁলির মধ্য যুগীয় ইতিহাসের ঘৃনিত নাম, নিন্দিত নাম, বেঈমান মীর জাফর আলী খাঁন। বাংলাদেশে বিশ^াস ঘাতকের আরেক নাম মীর জাফর। বাংলার নবাব আলীবর্দ্দি দয়া পরবশ হয়ে মানবিক কারনে যে ভিনদেশী ভিখারীকে আশ্রয়, চাকরি, সম্মান আত্বীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে রাস্থা থেকে রাজ প্রাসাদে ঠাঁই দিয়েছিলেন সেই বেঈমান-মোনাফেক-নিমক হারাম-অর্থের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল বৃটিশ বেনিয়াদের কাছে। নবাব আলীবর্দ্দির বংশধরকে নির্বংশ করেছিল নির্ম্মমভাবে।
আজীবন লড়াই- সংগ্রাম ও বার্ধক্য জনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী খাঁ। তার সময় শেষ অনুধাবন করে তিনি তার উত্তর সূরী ও প্রিয় দৌহিত্র সিরাজুদ্দৌলাকে কাছে ডেকে এনে বল্লেন- “আমার মৃত্যো সন্নিকটে। তোমার কাছে আমার শেষ উপদেশ, তোমার শত্রুদের দমন করতে এবং বন্ধুদের মর্য্যাদা রাখতে সমস্ত অন্তর দিয়ে তুমি চেষ্টা করবে। দেশের জনগনের উন্নতি বিধান এবং অত্যাচার ও বিশৃঙ্খলা দমন করতে তোমাকে সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।-” জীবনের অন্তিম সময়েও মুত্যোপথযাত্রী বৃদ্ধ নবাব বাংলার প্রজাসাধারনের কল্যানের কথা বলেছেন- চিন্তা করেছেন-তরুন সিরাজকে ইংরেজদের ঔদ্যত্ব থেকে সাবধান ও সতর্ক থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল জোহরের নামাজের সময় আল্লাহ-রসুলের নাম নিতে নিতে মহান মৃত্যোকে আলিঙ্গঁন করেন নবাব আলীবর্দি খাঁ। এক সপ্তাহ রাষ্ট্রীয় শোক পালন শেষে ১৭৫৬ সারের ১৫ এপ্রিল-মনসুরুল মূলক-উপাধি ধারী মির্জা মোহাম্মদ সিরাজদ্দৌলা সুবে বাংলার নবাব হিসাবে সিংহাসন আরোহন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পর্য্যন্ত বাংলার স্বাধীন নবাব ছিলেন তিনি। পলাশীর যুদ্ধের পর হতভাগ্য নবাব রাজ্য-সিংহাসন হারা। অতঃপর তারই প্রাসাদে গৃহবন্দী। ২-রা জুলাই রাতে মাত্র চব্বিশ বৎসর বয়সে পৃথিবী থেকে চীর বিদায় নেন তিনি। মীর জাফর, মীর সাদেক আলী খান মিরন এর ইচ্ছা ও ইঙ্গিঁতে বেঈমান মোহাম্মদী বেগ নবাবকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
সুবে বাংলার নবাব হয়ে গৃহ বিবাদ এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কুটিয়াল দের বেআদবির সম্মুখীন হন স্বাধীন চেতা তরুন নবাব সিরাজুদ্দৌলা। দেশী-বিদেশী সকল ষঢ়যন্ত্র কঠোর হস্তে দমন করেন নতুন নবাব। কুটিয়াল-রা কোলকাতা দখল করলে কোন আলোচনা-আপোষের সুযোগ না দিয়ে স্বয়ং কোলকাতা অভিযান করেন বাংলার নবাব। কোলকাতা বিজয় করে প্রিয় দাদুর নামে কোলকাতার নূতন নামকরন করেন আলীনগর। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি স্বাধীনচেতা স্বাধীন নবাবের। সিপাহ সালার মীর জাফর আলী খাঁ ভাগ্যবান ধনকুবের জগৎশেঠ, শক্তিমান রায় দূর্লভ, কুচক্রী উমি চাঁদ গং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্ম্মচারী রভার্ট ক্লাইভ এর সঙ্গেঁ গোপন চুক্তি করে বাংলার নবাবীকে কোম্পানীর কাছে বিকিয়ে দেয় মীর জাফর চক্র। সেই মোতাবেক মাত্র হাজার তিনেক সৈন্য, গোটা কয়েক কামান নিয়ে রভার্ট ক্লাইব স্বসৈন্যে মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যুদ্ধ যাত্রা করেন। গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে কোন আলোচনার জন্য অপেক্ষা না করে দশ সহ¯্রাধিক পদতিক সহ প্রায় অর্ধলক্ষ নবাবী সৈন্য ৫৩টি কামান বিপুল সংখ্যক পদাতিক সৈন্য নিয়ে স্বয়ং যুদ্ধ যাত্রা করেন বাংলার নবাব। পলাশীর প্রান্তরে এসে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন -বৃহস্পতিবার বিনাযুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধের বিয়োগান্তক ভাগ্য বিপর্য্যয় হয়ে গেল সুবে বাংলার ভাগ্যাহত নবাব সিরাজুদ্দৌলার। পলাশীর প্রান্তরে সিপাহশালার মীর জাফরের নেতৃত্বে রাজা রাজ বল্লভ-রায় দূর্লভ-ঊঁমি চাঁদ, এয়ার লতিফের হাজার হাজার নবাব বাহিনী পুতুলের মত দাড়িয়ে ইংরেজদের রননৈপুন্য দেখছিলেন আর বাংলার নবাবের পতন কামনা করছিলেন। বীরের মত যুদ্ধরত অবস্থায় নবাবের বিশ^স্থ সেনাপতি মীর মদন যুদ্ধ ক্ষেত্রেই শাহদাত বরন করেন। নবাবের একান্ত অনুগত সেনাপতি রাজা মোহন লাল প্রান পন যুদ্ধ করে যুদ্ধের গতি যখন নবাব বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে এনেছিলেন তখন সেনাপতি মীর জাফর সেদিন যুদ্ধ বন্ধ করে রনাঙ্গঁন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন। বাংলার নবাব মাথার পাগরি খুলে নীচে রেখে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় কোম্পানীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারনের আহ্বান জানালে বেঈমান মীর জাফর পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ আল কোরআনের শফথ ও দোহাই দিয়ে পরদিন যুদ্ধে নামার অঙ্গীঁকার ব্যাক্ত করলে সরল বিশ^াসে বাংলার নবাব রনাঙ্গঁন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আদেশ দেন। বিশ^াস ঘাতক মীর জাফর গুপ্তচর মারফত এই সংবাদ ক্লাইভ শিবিরে পাঠালে ইংরেজ বাহিনী নবাব শিবিরে আক্রমন করে। নবাব সিরাজুদ্দৌলা পিছু হটে পূনঃ পরিকল্পনা ও শক্তি ও সৈন্য সংগ্রহের আশায় রাজধানী মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তন কনে। ইংরেজ শিবিরে কোম্পানীর বিজয় ডংকা বেজে উঠে। পলাশীর প্রান্তরে সুবে বাংলার স্বাধীনতা অস্থমিত হয়। মুর্শিদাবাদ ফিরে নবাব সিরাজুদ্দৌলা রাষ্ট্রীয় কোষাগার খুলে দিয়ে সৈন্য সংগ্রহের জন্য অনেককেই বিপুল পরিমান অর্থ বরাদ্দ করলেন। টাকা পয়সা নিলেও কেহই সৈন্য সংগ্রহ করে নবাবের কাছে ফিরে আসেন নি। স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজুদ্দৌলা কোম্পানী কিংবা বিশ^াস ঘাতক সিপাহ শালার মীর জাফরের কাছে আত্ব সমর্পন, কিংবা ঐক্য মতের সরকার গঠন কিংবা নবাবী ও মসনদকে ভাগ বাটোয়ারা কিংবা কোম্পানীর কুঠি নির্মান, সৈন্য সমাবেশ কিংবা বিনাশুল্কে বানিজ্যের অনুমতি প্রদান ও বাংলা ও বাঙ্গাঁলির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোন প্রস্তাব পাঠান নি, বরং পাটনায় গিয়ে সৈন্য সংগ্রহ করতঃ পূনরায় বৃটিশ বিতারন এবং বেঈমান মীর জাফর চক্রকে উচিত শিক্ষা দিতে মনস্থির করলেন। সেই মর্মে বাংলার হত ভাগ্য নবাব রাতের আধারে বেগম লুৎফুন্নেছা এবং তিন বৎসর বয়সী একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জহুরাকে নিয়ে নৌকা যোগে পাটনায় রওয়ানা হন। এই গমন-পলায়ন ছিলনা, ছিল রাজ্য উদ্ধারের জন্য শক্তি ও সৈন্য সংগ্রহ করতঃ পূনরাগমনের জন্য ছিল এই গমন। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক ভাবে পথেই গ্রেফতার হন তিনি। গ্রেপ্তার হওয়ার পরও প্রাণ ভিক্ষা চাননি নির্ভীক দেশ প্রেমিক রাজ্য হারা-সিংহাসন হারা সিরাজুদ্দৌলা। তাকে তারই জাফরগঞ্জ প্রাসাদে অসম্মানজনক ভাবে বন্দী করে রাখা হয়। ২-রা জুলাই রাতে মতান্তরে তেছরা জুলাই প্রাতে পাষান মোহাম্মদী বেগ ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে। সিরাজুদ্দৌলার লাশকে অসম্মান জনকভাবে হাতির পীঠে উঠিয়ে শহর প্রদক্ষিন করা হয়। দূঃখিনী মাতা আমেনা বেগম এর প্রাসাদ সম্মুখে লাশ নিয়ে আনন্দ উল্লাস করা হলে আমেনা বেগম মুর্ছা গেলেও মীর জাফর চক্রের কোন দয়া হয়নি। পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারি নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে ধর্মীয় বিধি বিধান মোতাবেক সসম্মানে গোসল, জানাজা, দোয়া, দুরূদ-জিয়ারত এর বিধান থাকলেও মির চক্রের ভয়ে কেউই এগিয়ে আসেন নি। হৃদয়বান মির্জা জয়নুল আবেদীন বাকাওয়াল সাহসের সঙ্গেঁ এগিয়ে এসে লাশের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন। খুশবাগের শাহী গোরস্থানে দাদু আলীবর্দী খাঁর সমাধির পাশে সমাহিত করা হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে। ইতিহাস গবেষক-পর্য্যটক গন নবাব সিরাজুদ্দৌলার রুহের মাগফিরাত কামনা করে কবর যিয়ারত করেন আর বেঈমান মীর জাফরের বাসস্থান-কবর গাহে নিমক হারামের দেউরি হিসাবে পদাঘাত ও ঘৃনা প্রদর্শন করেন।
২৩শে জুনের পলাশীর বিশ^াস ঘাতকতা এবং দুছরা জুলাই নবাব সিরাজুদ্দৌলার শাহাদাত বরনের পর সুবে বাংলার রাজনীতি ও সমাজ জীবনে গুনগত মৌলিক পরিবর্তন আসে। নবাবের বংশ কে নির্বংশ করার জন্য মীর জাফ-মীরন চক্র নবাবের কনিষ্ট ভ্রাতা মির্জা আক্রামুদ্দৌলা এবং মির্জা মাহদিকে নিষ্টুরভাবে হত্যা করে। ইংরেজদের সঙ্গেঁ চুক্তি মোতাবেক সিপাহশালার মীর জাফর আলী পুতুল নবাব হলেও রাজস্ব আদায় সহ সকল ক্ষমতার মালিক হলেন ক্লাইভ চক্র। বাংলার পুতুল নবাব হলেন কোম্পানীর ভাতা-বেতনভূক কর্ম্মচারি মাত্র। কোম্পানী এবং সুদখোর জগৎশেঠ চক্রের বল্গাহীন লুন্ঠন-শোসনে বাংলায় দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বাংলার ইতিহাসে কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মনন্তরে লক্ষলোক নাখেয়ে মারা গেলেও মীর চক্র বিলাস-ফ্যাসনে গাভাষান। দিল্লী থেকে গানবাজনা করতে আসা মুন্নিবাঈ-বুব্বু বাইকে ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ পুতুল নবাব মীর জাফর আলী শাদী মোবারক সুসম্পন্ন করে নবারের প্রাষাদেই ঠাই দেন।
নবাব সিরাজুদ্দৌলার শাহাদাত বরনের পর সুবে বাংলার নবাবী আর নবাব বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। নবাব আলীবর্দ্দী খার ভগ্নি শাহী খানমের গর্ভজাত সন্তান মীরজাফর পুত্র মীর সাদেক আলী খান এর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যোতে আলীবর্দি-সিরাজের সরাসরি বংশধর আর রইলেন না। অপদার্থ মীর জাফর রাজ্য পরিচালনায় অযোগ্যতার পরিচয় দিলে কোম্পানী মীর কাসেম কে বাংলার নবাব নিযুক্ত করে। স্বাধীনচেতা মীর কাসেম কোম্পানীর পুতুল নবাব হতে অস্বীকৃতি জানালে ইংরেজদের সঙ্গেঁ যুদ্ধ বেঁধে যায়। পরপর একাধিক যুদ্ধ অবশেষে বকসারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাংলার নবাব নিরুদ্দেশ হন। পরে দিল্লীর রাজপথে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। মীর জাফর পরবর্ত্তী নবাব বংশ-নবাব নজমুদ্দৌলা গং নবাব গন ছিলেন মীর জাফরের ঔরসজাত এবং মুন্নী বাই, বব্বু বাঈর গর্ভজাত সন্তান। এই বংশকে বাঈজী বংশ বলা চলে। এসব অপদার্থ নবাবদের কাজ ছিল বছর বছর সন্তানের পিতা হওয়া আর কোম্পানীর কাছ থেকে মাশোয়ারা খাওয়া। যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর অমলেন্দু দে- দীর্ঘ গবেষনার ফল ও ফসল হিসাবে-“সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে”- গবেষনাগ্রন্থে বলেন নর্তকী এবং রাজা মোহন লাল এর ভগ্নি আলেয়ার সঙ্গেঁ নবাবের বিয়ে হয়েছিল এবং আলেয়ার গর্ভে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিল। নবাবের বংশ রক্ষার জন্য মোহন লাল নবাবের শিশু পুত্রকে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গেঁর বিখ্যাত জমিদার ময়মন সিংহের জনৈক জমিনদারের কাছে গোপনে দত্তক দিয়ে যান এবং পরিচয় গোপন রাখার জন্য অমুসলিম নাম যুগল কিশোর রায় চৌধুরী রাখা হয়। কথা ছিল পরিচয় প্রকাশের আশংকা থাকলে স্থান ত্যাগ করতে হবে। সেই মর্মে পরিচয় প্রকাশের আশংকায় যুগল কিশোর স্থান ত্যাগ করে জমিদারি ক্রয় করতঃ সিলেটে কাজলশা আসেন। এলাকার বিশাল যুগল টিলাটি সিরাজপুত্র যুগল কিশোর রায় চৌধুরীর উজ্জল স্মৃতি বহন করছে। সাংবাদিক-কলামিষ্ট-বন্ধুবর আফতাব চৌধুরী সহ যুগল টিলায় গিয়ে শত বৎসরের ইতিহাসের সন্ধান করেছি, অজানা নবাব পুত্রের রুহের মাগফিরাত ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গায়েবি-জিয়ারত করেছি। সিলেটের বিশিষ্ট আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ভ্রাতৃপ্রতিম ই.ইউ. শহীদুল ইসলাম শাহীনের সঙ্গেঁও মত বিনিময় করেছি, তিনি এ ব্যাপারে গবেষনা করছেন। নবাব সিরাজুদ্দৌলার কন্যা বংশীয় অধঃস্থন বংশধর ঢাকাবাসি সাংবাদিক-লেখক নবাব আলী আব্বাসুদ্দৌলা এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষন করেন। নবাব জাদা আমার পেন ও-ফোন ফ্রেন্ড। এই নিয়ে ব্যাপক গবেষনা-পর্য্যালোচনা করা উচিত। কারন নবাব সিরাজ শুধুমাত্র বাংলার নবাব ও সামন্ত শাসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক-স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ। বাঙ্গাঁলির জাতীয় বীর।
সামন্ত যুগে সুবে বাংলার রাজভাষা ছিল ফার্সি। পলাশী উত্তর বাংলাদেশে নবাব সিরাজুদ্দৌলার যথাযথ মূল্যায়ন করে বাংলার প্রকৃত ইতিহাস রচিত হয়নি। বরং কোম্পানী ও ইংরেজদের ফরমায়েশ মোতাবেক কিছু মোসাহেব সিরাজ চরিত্রের উপর কাল্পনিক কলংক আরোপ করে কোম্পানী ও পলাশীর যুদ্ধের স্বপক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সৈয়দ গোলাম হোসেন তবাতবায়ী রচিক সিয়ার-উল মুতাখখিরিন-সিয়ার এক খানি প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ। ফারসি ভাষায় রচিত এই গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ করেছেন গ.জধুসড়হফ নামক একজন ফরাসী পন্ডিত। এভাবে তারিখ-ই-বাংলা, রিয়াজউস সালাতিন-গ্রন্থ সমুহে সিরাজ চরিত্রের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। ইতিহাস বিদ শ্রদ্ধেয় স্যার যদুনাথ সরকার, সরকারের সাবেক সচিব-প্রতœতত্ব বিদ শ্রদ্ধেয় আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া এই জাতীয় গ্রন্থের অনুবাদ এর মাধ্যমে বাংলাভাষি পাঠকদের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছেন। এ ব্যাপারে আমাদের বাংলা একাডেমী এগিয়ে আসতে পারেন। প্রথমা প্রকাশনী এগিয়ে এসছেন বলে প্রশংসা ও ধন্যবাদার্হ্য।
১৭৫৭ সালের দুছরা জুলাই সিরাজুদ্দৌলার শাহাদাত বরনের পর মির জাফর-জগৎ শেঠ চক্র নবাব এবং নবাবি কোষাগারের অর্থ সম্পদ ভাগ বাটোয়ারার পর বেহায়া বাপ বেটা মীর জাফর-মীর সাদেক দুজনেরই বদনযর পরল নবাব মহিষী এক কন্যা সন্তানের মাতা বেগম লুৎফুন্নেসার দিকে। করম আলী খান রচিত ফারসি ভাষার মূল গ্রন্থ মুজাফফর নামা-র বাংলা অনুবাদে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন-“ আগে যে আমি হস্তীপৃষ্টে আরোহন করেছি, সেই আমি এখন গর্দভের পৃষ্টে উপবিষ্ট হতে সম্মত হতে পারিনা”- ১৭৫৭ থেকে ১৭৯০ সালের নবেম্বর মাস পর্যন্ত বেঁচেছিলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। রাজরানী থেকে ভিখারীনি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছেন এই মহিয়সী রমনী। নিজের অর্থ সম্পদ লুন্ঠন করে নিয়ে মাসিক মাত্র ছয়শ টাকা ভাতা বরাদ্দ করে কোম্পানী। এছাড়া খুশবাগের শাহী কবর গাহের দেকভালের জন্য ৩০৫ টাকা ভাতা পেতেন তিনি। সিরাজ-লুৎফার একমাত্র কন্যা সন্তানকে বিয়ে দেন মীর আসাদ আলী খার সঙ্গেঁ। আসাদ উম্মে জহুরা দম্পতি চার কন্যা সন্তানের পিতা-মাতা হয়েছিলেন। কন্যা চতুষ্টয় হলেন, সরফুন্নেসা, আমাতুন নেসা, সাকিনা ও আমাতুল। চার কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে নবাব জামাতা মীর আসাদ আকস্মিকভাবে অতঃপর ১৭৭৪ সালে নবাব কন্যা উম্মে জহুরা ও মৃত্যুবরন করলে বেগম লুৎফুন্নেসা আল্লাহর উপর ভরসা করে অবর্ননীয় দূঃখ কষ্ট অপমান সয়ে কালাতিপাত করতে থাকেন তবুও স্বামীর কবর ও সংসার ছেড়ে যাননি। বেগম লুৎফা কোন নবাব কিংবা অতি উচ্চ বংশীয় কন্যা ছিলেন না কিন্তু একজন বধুমাতা হিসাবে একজন সুবে বাংলার পতিব্রতা মুসলিম রমনী হিসাবে যে উন্নত নৈতিকতা, নীতি ও মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা অতুলনীয়। আমেরিকার জনপ্রিয় ও সুদর্শন প্রেসিডেন্ট জন.এফ কেনেডি আততায়ীর গুলিতে আকস্মিক ও করুন মৃত্যোর পর মার্কিন ফার্স্ট লেডি স্বর্নকেশী জ্যেকুলিন কেনেডি, গ্রীক ধনকুবের নবোতিপর বৃদ্ধ জাহাজ ব্যাবসায়ী এরিষ্টটল ওনাসিস এর সঙ্গেঁ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নুতন জীবন শুরু করেন। অথছ পতিব্রতা এক বঙ্গঁললনা স্বামীর মৃত্যোর পর নূতন জীবনের সকল প্রস্তাব ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৭৯০ সালের নবেম্বর মাসে স্বামী শহীদ সিরাজুদ্দৌলার কবরের পাশে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় নবাব মহিষী বেগম লুফুন্নেছাকে।
তেইশে জুন পলাশী দিবস। দুছরা জুলাই শহীদ দিবস। জানিনা জাতীয় পর্য্যায়ে কিছু হবে কি না এই শহীদ দিবসে। গত তেইশে জুন পলাশী দিবসে জাতীয় পর্য্যায়ে কিছু হয়নি। কি প্রিন্ট, কি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। গত ২৫শে জুন জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক গোলাম আশরাফ খান উজ্জল এর -“পলাশী যুদ্ধ পরবর্ত্তী সিরাজ পরিবার”- শিরোনামে একটি প্রাসঙ্গিক ও তথ্যবহুল প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। ইনকিলাব এবং লিখক উভয়েই ধন্যবাদ পাওয়ার হকদার।
দুছরা জুলাই আঠারো সাল, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ বাংলা ও বাঙ্গাঁলির জাতীয় বীর, সুবে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার ২৬০ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে শহীদ সিরাজুদ্দৌলার উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। তেইশে জুন পলাশী দিবস এবং দুছরা জুলাই শহীদ দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপনের জন্য জাতির কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে জোর দাবী জানাচ্ছি- কেননা নবাব সিরাজুদ্দৌলা শুধুমাত্র একজন সামন্ত শাসকই ছিলেন না, সিরাজ ছিলেন বাংলা ও বাঙ্গাঁলির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিমূর্ত প্রতীক। একজন জাতীয় বীর এবং বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ।
[মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি ও মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]
মন্তব্য করুন