“২০ ডিসেম্বর ৭১” স্থানীয় শহীদ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ একাত্তোরের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাও বাঙ্গাঁলির জাতীয় জীবনের হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাসে স্মরনীয় অধ্যায়। একাত্তোরের ছাব্বিশে মার্চ থেকে ষোলই ডিসেম্বর এর পড়ন্ত বিকেল পর্য্যন্ত সমগ্র দেশ ও জাতি জীবন বাজি রেখে মরনপন লড়াই করে ছিনিয়ে আনেন প্রিয়তম-চীর কাংখিত স্বাধীনতা। একাত্তোরের ষোলই ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর এতদাঞ্চলীয় আঞ্চলিক অধিনায়ক লেঃ জেঃ আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি তার নিয়ন্ত্রনাধীন ছিয়ান্নব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং আরোরার কাছে আনুষ্টানিক নিঃশর্ত আত্বসমর্পনের মধ্যে বাংলাদেশের সসস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের আনুষ্টানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। ইতিপূর্বে চার নম্বর সেক্টারাধীন মৌলভীবাজার অঞ্চল মুক্ত হয় আটই ডিসেম্বর। ঐদিন আনুষ্টানিক ভাবে মৌলভীবাজারের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ও মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন মহকুমা সদর থেকে নির্বাচিত তৎকালীন এম.পি.এ. তৎপর এম.সি.এ.এম আজিজুর রহমান (সাবেক সাংসদ, সি.ইন.সি.স্পেশিয়াল এর বীর মুক্তিযোদ্ধা, জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান।) ইতিপূর্বে একাত্তোরের তেইশে মার্চ পাক প্রজাতন্ত্র দিবসে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস-প্রটেষ্ট ডে- ঘোষনা করেন। ছাত্র লীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দেশ ব্যাপী প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচী হিসাবে আমরা স্থানীয় ভাবে প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচী পালন করি। মহকুমা ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি দেওয়ান আবুল ওয়াহাব চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশাল ছাত্র-যুব-জনজমায়েতের প্রধান অতিথি হিসাবে আমি আনুষ্টানিক ভাবে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা, পাকিস্তানী জাতির জনক মিঃ জিন্নাহর ছবি পুড়িয়ে বাঙ্গাঁলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ছবি উড়াই। মহুমূহু জয় বাংলা শ্লোগান এবং আনন্দ-উত্তেজনা উচ্ছাস এর ছবি ক্যেমেরা বন্দী করে রেখে ছিলেন মুক্তাষ্টুডিও কর্তৃপক্ষ। সেই আবেগ-উত্তেজনা-আনন্দময় স্মৃতি এখনও স্মৃতি কাতর করে। বিমোহিত বিমুগ্ধ করে।
আট ডিসেম্বর মৌলভীবাজার অঞ্চল মুক্ত হওয়ার পর প্রিয় শহরে ফিরে আসি। শহরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে নি। থমথমে অবস্থা। আমার মুসলিম কোয়ার্টারস্থ পৈত্রিক বাসগৃহ ছাব্বিশে মার্চ ভোরে খান সেনারা আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য ঘেরাও করে। ষাটের দশকের শুরু থেকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে আমার ছাত্র রাজনীতির শুরু। ৬২ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাবেক সাধারন সম্পাদক রাজনৈতিক তাত্বিক সিরাজুল আলম খাঁন স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্টার লক্ষে গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন। তাঁর সততা ও দেশ প্রেমে উদ্ভোদ্ভ ও তার ভক্ত ছিলাম। ঐ দশকের প্রথমে কলেজ শাখা অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্র লীগের সভাপতি ছিলাম। স্বাধীনতা ও নিউক্লিয়াস পহ্ণী শ্লোগান প্রদানের কারনে পাক গোয়েন্দা পুলিশের বদ নজরে ছিলাম। টার্গেট ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাসাটি লুট হলে স্বাধীন বাংলায় আমার স্মরনার্থী জীবন শেষ হল না, বিশিষ্ট বন্ধু আজিজুল হক ইকবাল ও শেখ আব্দুর রব এর বাসায় উঠলাম। দু’বাসা ভাগ করে থাকতাম। তখন খাওয়া-গোসলের কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না। পারিবারিক স্বচ্ছলতার কারনে সার্বক্ষনিক ভাবে দেশও দলের কাজে ব্যস্ত থাকতাম। রুজি-রুজগার-দুনিয়া দারির চিন্তা ছিল না।
বিশে ডিসেম্বর কুয়াশা ঢাকা শীতের সকাল। ঐ দিন আমি আমার প্রিয় বন্ধু রব এর শাহ মোস্তফা সড়কের বাস ভবন রসিদ ব্রাদার্স এ রাত্রি যাপন করি। সাত সকালে দ্রিম-দ্রিম-ভমভম ভোমভোম আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গেঁ গেল। ঘরের দরজা জানালা কেঁপে উঠল। আমি পালংক থেকেছি টকে নীচে পড়লাম। ঘুম ভেঙ্গেঁই মনে হল কোথাও এয়ার এ্যাটাক-এয়ার রেইড় হচ্ছে এবং বিমান হামলা মোকাবিলার জন্য এইচ, এম.জি. হাই মেশিন গানের আওয়াজ হচ্ছে। কিন্তু ১৬ইং ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্ব সমর্পনের পর চার দিনের মাথায় এসব কি কোথা থেকে আওয়াজ হচ্ছে। অনুমান করলাম মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এলাকায় আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। কাপড় পরিধান করে শীতের কুয়াশা ডাকা সকালে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে থ-কিং কর্তব্য বিমুঢ়, নির্বাক, নিস্তব্দ হয়ে গেলাম। তখন মোবাইল নয় প্রয়োজনীয় টেলিফোনও ছিলনা। যা দেখলাম তাঁর বিষদ-বিস্তারিত-হুবহু ব্যাখ্যা দেয়া এই প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর অসম্ভব ব্যাপার। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে একদল গৃহ ফেরত মুক্তিযোদ্ধা ক্যেম্প করে অবস্থান করেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা রহিম বক্স খোকার বাসা শাহ মোস্তফা সড়কস্থ বক্স ভিলা কয়েক মিনিট এর পথ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম তাহির বক্স সাহেব এর পুত্র রহিম বক্স খোকা খুবই হাসি খুশী প্রানোচ্ছল তরুন এবং আমি সহ সকলের সঙ্গেঁ খুবই সুসম্পর্ক যুক্ত ছিল। স্বাধীন বাংলায় মায়ের কোলে ফিরে এসে নিজ বাসা বক্স ভিলায় যায় নি রহিম বক্স খোকা। মুক্তি বাহিনী এবং ক্যাম্প জীবনের শৃংঙ্খলার জন্য ক্যেম্পেই থেকে গিয়েছিল। মৌলভীবাজার শহরের প্রিয় মুখ গনক কানু বাবু তাঁর বাই সাইকেল সহ এখানে এসেছিলেন, সামনের সড়ক দিয়ে যাচ্ছিছেন। সহজ সরল কানু বাবু হয়ত নিজের হাত নিজে কোন দিন গুনেন নি, বিশে ডিসেম্বরের মাইন দূর্ঘটনায় বাই সাইকেলসহ তাঁর শরীর খন্ড বিখন্ড হয়ে যায়। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ক্যম্প-এ-হাই পাওয়ার এ্যন্টি ট্যাংক মাইন বিস্ফোরিত হলে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এর চাল উড়ে গিয়ে হাই স্কুলের মাঠের মাঝখানে পতিত হয়। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এর দক্ষিন সম্মুখস্থ বাউন্ডারি ওয়াল প্রচন্ড আওয়াজ ভেঙ্গেঁ পড়ে। মানুষের পোড়া মাংসের গন্ধ এবং ধোয়ায় এলাকাটি অন্ধকার হয়ে যায়। দূঃসংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, রিক্সা শ্রমিক সহ সাধারন মানুষের উপস্তিতি সহমর্মিতাও সহযোগিতা ছিল লক্ষ করার মত। একাত্তোরের প্রিয় সংযোদ্ধাদের এই দূর্ঘটনার সংবাদে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ছুটে আসেন এতবছর পর সকলের নাম স্মরণ করা সম্ভব নয়, তাছাড়া স্বল্প পরিসরে সকলের নাম উল্লেখ করাও সম্ভব নয়। তবুও স্থানীয় এম.পি এবং সি.ইন.সি, স্পেশিয়াল এর বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.আজিজুর রহমান, সি.এন.সি স্পেশিয়াল এর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আহাদ চৌধুরী (পরে অধ্যক্ষ। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের দীর্ঘদিনের সফল চেয়ারম্যান) এবং সৈয়দ মহসিন আলীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য (সৈয়দ মহসীন পরে দীর্ঘদিনের পৌরপতি, সাংসদ, মন্ত্রী, পরলোকে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা অন্ত প্রাণ ব্যক্তি ছিলেন) বিশে ডিসেম্বর এর মাইন বিষ্ফোরনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ সংলগ্ন পূর্ব দক্ষিনাংশে সমাহিত করা হয়। লাশ সমুহ ছিন্ন ভিন্ন হওয়াতে হিন্দু মুসলিম গণকে এক সাথে সমাহিত করা হয়। না কবর না শ্বশান এই বীর যোদ্ধা ও বীর শহীদানের শেষ ঠিকানার আমি নাম দিয়েছিলাম সমাধি। যারা এই দেশও জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেলেন তাঁদের নিজস্ব কোন শেষ ঠিকানা স্মৃতি চিহ্ন রইল না, এটা নিতান্তই দূঃখ ও বেদনাদায়ক ব্যাপার। ফেঞ্চুগঞ্জের শহীদ সুলেমান সহ চব্বিশ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার শেষ ঠিকানা সমাধি এটি। মমতাজ ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে আমার ব্যক্তিগত অর্থায়নের বৃক্ষায়ন ও পুষ্পায়ন এর একটি প্রকল্প আছে আমার, বন্ধুবর সৈয়দ মহসীন আলী পৌর চেয়ারম্যান এর দায়িত্বে থাকা কালে আমার উদ্যোগে সমাধি এলাকায় বৃক্ষরোপন করি। আশির দশকের চারা গাছ গুলি এখন পূর্ণ বৃক্ষে পরিণত হয়ে কবর গাহকে ছায়ায়-মায়ায় আগলে আছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে তিনফুট সীমানা প্রাচীর করে দেয়া আছে।
২০শে ডিসেম্বর দুই হাজার এক সালে তৎকালীন পৌরপতি মাহমুদুর রহমান সাহেব বিশে ডিসেম্বরের চব্বিশ জন শহীদ এর নাম সম্বলিত শহীদ মিনারাটি শুভ উদ্ভোধন করেছিলেন। এই চব্বিশ জন শহীদ হলেন- ১। শহীদ সুলেমান মিয়া, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট, ২। শহীদ রহিম বক্স খোকা, ৩। শহীদ ইয়ানূর আলী, ৪। শহীদ আছকর আলী, ৫। শহীদ জহির মিয়া, ৬। শহীদ ইব্রাহিম আলী, ৭। শহীদ আব্দুল আজিজ, ৮। শহীদ প্রদীপ চন্দ্র দাশ, ৯। শহীদ শিশির রঞ্জন দেব, ১০। শহীদ সত্যেন্দ্র দাস, ১১। শহীদ অরুন দত্ত, ১২। শহীদ দিলীপ দেব, ১৩। শহীদ সনাতন সিংহ, ১৪। শহীদ নন্দলাল বাউরী, ১৫। শহীদ সমীর চন্দ্র সোম, ১৬। শহীদ কাজল পাল, ১৭। শহীদ হিমাংশু কর, ১৮। শহীদ জিতেশ চন্দ্র দেব, ১৯। শহীদ আব্দুল আলী, ২০। শহীদ নুরুল ইসলাম, ২১। শহীদ মোস্তফা কামাল, ২২। শহীদ আশুতোষ দেব, ২৩। শহীদ তরনী দেব, ২৪। শহীদ নরেশ চন্দ্র ধর। এলকাটি পরিত্যক্ত, অন্ধকার থাকায় দিনে বেকার ভবঘুরে বাউন্ডেল নেশাখোর, জুয়াড়ি এবং ভ্রাম্যমান বারবনিতা দের আড্ডা খানা বসত। এই শহীদ মিনার এলাকায় এককালে গরুর বাজারও বসেছে। আমি এই নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবেদন লিখেছি, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ আবেদন করেছি, শেষ মেস পুলিশি সহায়তা চাইলে পুলিশি তৎপরতা ও অভিযানে উপদ্রব কিছুটা হ্রাস পায়। বর্তমান পৌর মেয়র আলহাজ্ব মোঃ ফজলুর রহমান দায়িত্ব নেয়ার পর অনেকাংশে অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
নিকটস্থ শিশু পার্ক ছিল ফুচকা বাজার ও নিশি কন্যাদের নিরিবিলি চলাফেরার কেন্দ্র। ফুচকাবাজার এখন পৌর শিশু পার্ক-ফুলের বাগান হওয়াতে এই আপদ ও আবর্জনা থেকে পৌরবাসি মুক্তি পেয়েছেন। পৌর মেয়র আলহাজ্ব মোঃ ফজলুর রহমান জানালেন আমাদের দাবীর প্রেক্ষিতে এই শহীদ সমাধি এলাকায় একটি বৃহদাকারের প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। পৌর মেয়র সাহেবের এই মহতি কার্য্যক্রমে সমর্থন জানিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।
বিশে ডিসেম্বর স্থানীয় ভাবে শহীদ দিবস হিসাবেই উদ্যাপিত হয়। রাজনৈতিক সামাজিক সংঘটন, মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজ দিবসটি সশ্রদ্ধ চিত্তে উদ্যাপন করেন। শহীদানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
একাত্তোরের বিশে ডিসেম্বরের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাইন বিস্ফোরনের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতঃ তাঁদের রুহ ও আত্বার মাগফিরাত-শান্তি ও সদগতি কামনা করছি।
[মুক্তিযোদ্ধা,সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট, সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]
মন্তব্য করুন